পূর্ব প্রকাশিতর পর
ভাষা একটা প্রকাশ মাধ্যম— ব্যক্তিবিশেষের প্রয়োজনে যতখানি, সমাজের প্রয়োজনে ততোধিক। সমাজবাসী সকল মানুষের মধ্যে সংযোগ সাধনের মাধ্যম হিসাবেই এর প্রাধান্য। লেখক-সাহিত্যিক মাত্রই সমাজ সচেতন মানুষ। নিজস্ব অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধির কথা যখন বলেন, তখনও দশজনকে অর্থাৎ সমাজকে উদ্দেশ্য করেই বলেন। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ যা-কিছু লিখেছেন সমস্তই দশের জন্যে, দেশের জন্যে। কাজেই তাঁদের সমাজ-সচেতন বলব না কেন— বিশেষ করে দেশ, সমাজ যখন তাঁদের অনেক কথাকেই সাগ্রহে গ্রহণ করেছে। আবার অপর এক শ্রেণীর লেখক আাছেন যাঁরা সমাজ যা ভাবছে, বলছে, চাইছে সমাজবাদীদের হয়ে সাদামাটা কথায় তাই প্রকাশ করছেন। দশের কথা তাঁরা দেশের সুমুখে তুলে ধরছেন। এঁরা তো সমাজ-সচেতন বটেই। উভয় শ্রেণীর লেখকরাই ভাষার শক্তিবৃদ্ধি করেছেন। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ যেমন বাংলা গদ্যের মহিমা এবং মাহাত্ম্য বাড়িয়েছেন, শেষোক্ত লেখকরাও তেমনি থেকে থেকেই কিছু অভিনবত্বের আমদানি করেছেন। আসল কথা, ভাষাকে সমাজের প্রকাশ মাধ্যম হিসেবেই দেখতে হবে। সমাজ যেমন বদলাবে, ভাষাও তেমনি বদলাবে। সেজন্যে সাবধানতার প্রয়োজন আছে— লক্ষ্য রাখতে হবে, ভাষায় যদি ইতরতা দেখা দেয় তাহলে বুঝতে হবে যে সমাজ ইতর হয়ে আসছে।
চলিত ভাষার কথা আগেই উল্লেখ করেছি; কিন্তু বলা প্রয়োজন যে রবীন্দ্রনাথ যে চলিত ভাষা ব্যবহার করেছেন তা প্রকৃতপক্ষে অচলিত ভাষা— কেন না, সে ভাষা প্রাকৃতজনের ভাষা নয়, একান্ত ভাবে তাঁর নিজস্ব ভাষা। অপরের মুখে সে ভাষা ছোট মুখে বড় কথা বলে মনে হবে। প্রমথ চৌধুরী যিনি চলিত ভাষা প্রচলনের উদ্দেশ্যে রীতিমতো একটা আন্দোলন চালিয়েছিলেন, তারও ভাষা সুশিক্ষিত উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজের বৈঠকখানায় মজলিশি ভাষা. বলা নিষ্প্রয়োজন, চলিত ভাষা বৈঠকখানার ভাষা নয়, পথে ঘাটের, হাটে বাজারের ভাষা—নইলে চলিত ভাষাও কালে অচল হয়ে যায়।
ভাবলে অবাক লাগে, চলিত ভাষা নিয়ে যখন কোনো আন্দোলন দূরে থাক্, কারো মুখে তেমন উচ্চবাচ্যও শোনা যায়নি সেই তখন রবীন্দ্রনাথের সমকালীন এক মহাযশস্বী ব্যক্তি খাঁটি চলিত ভাষায় প্রচুর লিখেছেন, নানা গুরুতর বিষয়ের আলোচনা করেছেন, গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। খাঁটি নির্জলা চলিত ভাষার ব্যবহার বিবেকানন্দ যে ভাবে করেছেন তাঁর পূর্বে বা পরে আর কেউ তা করেননি। (ক্রমশ)