অশোক ঘোষ
কোভিড-১৯ মহামারির পর, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গেও তাল মিলিয়ে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে এক অভূতপূর্ব রূপান্তর ঘটেছে। ভারতীয় অর্থনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়।
Advertisement
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উত্থানে পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদন ও সরবরাহের নতুন পথ তৈরি হয়েছে এবং এর ফলে অনলাইন গিগ কর্মী ও ফ্রিল্যান্সারদের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে। শহর এবং গ্রাম—উভয় ক্ষেত্রেই গিগ প্ল্যাটফর্মগুলি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উপাদানে পরিণত হয়েছে, যা প্রচলিত নিয়োগকর্তা-কর্মচারী সম্পর্কের সীমারেখাকে অস্পষ্ট করে দিয়েছে। মুদি সামগ্রী, গৃহস্থালি সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা, গণপরিবহন থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার জন্য রিমোট কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ—গিগ কর্মীরা পরিষেবার প্রসার ঘটাচ্ছেন এবং মানুষের হাতে দ্রুততর ও সহজতরভাবে রিসোর্স পৌঁছে দিচ্ছেন।
Advertisement
তবে ভারতীয় অর্থনীতিতে গিগ কর্মীরা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলেও, তাদের জন্য পর্যাপ্ত নীতিমালা, নিয়ন্ত্রণ, শ্রম আইন এবং উপযুক্ত আইনি কাঠামোর অভাব এখনো স্পষ্ট।
ভারতে গিগ কর্মী বলতে কী বোঝায়?
২০২০ সালে, ভারতের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গিগ কর্মীকে সংজ্ঞায়িত করে বলেন, ‘যিনি কোনো প্রচলিত নিয়োগকর্তা-কর্মচারী সম্পর্কের বাইরে থেকে কাজ করেন বা কোনো নির্দিষ্ট কাজের ব্যবস্থার অংশ হিসেবে আয় করেন।’
২০২২ সালে, নীতি আয়োগ “India’s Booming Gig and Platform Economy” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, ২০২০–২১ অর্থবছরে ভারতে গিগ কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭.৭ মিলিয়ন, যা ২০২৯–৩০ সালের মধ্যে ২৩.৫ মিলিয়নে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
তবে, শহরের প্রতিদিনের পরিষেবা (যেমন: হোম ডেলিভারি বা ডেইলি কমিউট) সত্ত্বেও, এই গিগ কর্মীদের ৯৮ শতাংশই বছরে ৫ লক্ষ টাকার কম আয় করেন। এর মধ্যে প্রায় ৭৭.৬ শতাংশ কর্মীর বার্ষিক আয় ২.৫ লক্ষ টাকার কম।
তাদের আয় নির্ভর করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলির একতরফা অ্যালগরিদমিক নিয়ন্ত্রণের ওপর—যা তাদের কাজের মূল্যায়ন, রেটিং, ও বেতন ঠিক করে।
ফ্লেক্সিবিলিটির নাম করে, ন্যূনতম মজুরি, পেইড ছুটি, স্বাস্থ্যবিমা, এবং অন্যান্য সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হন। কোভিডের সময় তারা ফ্রন্টলাইন কর্মী হিসেবে কাজ করলেও, এখনো তারা সমাজ ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত।
আজ শহর এবং গ্রামীণ উভয় এলাকাই যখন শেষ মাইল পরিষেবার জন্য প্ল্যাটফর্ম-নির্ভর হয়ে উঠছে, তখন শাসনের ভার জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অস্বচ্ছ অ্যালগরিদমের দিকে সরে যাচ্ছে।
ভারতে গিগ কর্মীদের জন্য বিদ্যমান নীতি কাঠামো
২০২০ সালে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় “Code on Social Security”-এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো গিগ কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসে।
এই প্রেক্ষিতে, ২০২৩ সালে রাজস্থান সরকার একটি যুগান্তকারী আইন পাস করে—”Rajasthan Platform Based Gig Workers (Registration and Welfare) Act”—যার মাধ্যমে গঠিত হয় একটি ওয়েলফেয়ার বোর্ড এবং একটি তহবিল।
তবে এই উদ্যোগ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বাস্তবায়ন এবং কাঠামোগত দিক দিয়ে এতে ঘাটতি রয়ে গেছে।
সমালোচকরা তুলে ধরেছেন কিছু মূল সীমাবদ্ধতা—
‘প্রাইমারি নিয়োগকর্তা’, ‘অ্যাগ্রিগেটর’, ও ‘গিগ কর্মী’—এই তিনটি শব্দের সংজ্ঞা অস্পষ্ট।
বোর্ডকে অর্থ সহায়তার জন্য প্ল্যাটফর্ম থেকে সেস আদায়ের ব্যবস্থায় জটিলতা।
কর্মীদের অধিকার নিশ্চিত করার কোনও বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা নেই।
অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রে কর্মী কেবল বোর্ডের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করতে পারে, প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে নয়।
এই আইন একটি বড় পদক্ষেপ হলেও, এতে একমুখী শাসনের ছাপ রয়ে গেছে, যেখানে সিদ্ধান্ত, মজুরি নির্ধারণ এবং নিয়ম তৈরির ক্ষমতা প্ল্যাটফর্মের হাতে রয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে গিগ কর্মীদের অবস্থা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দ্বারা গিগ কর্মীদের শোষণ কমাতে নানারকম আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছে।
অনেক দেশের আদালত ও আইনসভা গিগ কর্মীদের “কর্মচারী” বা “নির্ভরশীল কনট্রাক্টর” হিসেবে পুনঃশ্রেণিবদ্ধ করছে।
যুক্তরাজ্যের ‘Uber v Aslam (2021)’ মামলায়, সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে Uber চালকরা আসলে কোম্পানির কর্মী এবং তাদের ন্যূনতম মজুরি ও পেইড লিভ পাওয়ার অধিকার আছে।
স্পেনের Ley Rider আইন খাবার ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মকে রাইডারদের স্থায়ী কর্মসংস্থান দিতে, অ্যালগরিদম প্রকাশ করতে এবং শ্রমিক অধিকার স্বীকার করতে বাধ্য করে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (EU) প্রস্তাব করেছে যে, গিগ কর্মীকে কর্মী ধরে নিতে হবে, যদি না প্ল্যাটফর্ম তা প্রমাণ করতে পারে যে তারা স্বতন্ত্র।
দক্ষিণ কোরিয়ার ফেয়ার ট্রেড কমিশন অ্যালগরিদমিক বৈষম্যের কারণে রাইড-হেইলিং কোম্পানিগুলিকে জরিমানা করেছে।
নীতিগত সুপারিশ ও ভবিষ্যতের পথ
ভারতের উচিত একটি আধুনিক ও সমন্বিত নীতি কাঠামো তৈরি করা, যেখানে প্রযুক্তি, শ্রমিকের অধিকার, এবং নাগরিক পরিষেবাকে একত্রিত করা হবে।
গিগ কর্মীদের অবকাঠামোর অংশ হিসেবে বিবেচনা করে তাদের উপর প্রয়োগযোগ্য সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।
একটি সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে একটি Platform Utilities Commission (PUC) গঠন করা, যা বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক CERC বা টেলিকম নিয়ন্ত্রক TRAI-এর মত কাজ করবে।
এই কমিশনের অধীনে থাকবে—
অ্যালগরিদমিক স্বচ্ছতা
মূল্য নির্ধারণ
পরিষেবার গুণমান
কর্মী অধিকারের বাস্তবায়ন
প্ল্যাটফর্মকে আইনি বাধ্যবাধকতার আওতায় এনে তাদের অ্যালগরিদম কীভাবে কাজ দেয় এবং আয় নির্ধারণ করে তা জানানো বাধ্যতামূলক করতে হবে।
এই তথ্য যেন রেগুলেটর ও কর্মী—উভয়ের কাছে সহজে উপলব্ধ ও যাচাইযোগ্য হয়, তা নিশ্চিত করা দরকার।
উপসংহার
সময়ের দাবি হচ্ছে— বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল সামাজিক প্রকল্প থেকে বেরিয়ে এসে একটি শক্তিশালী, অধিকারভিত্তিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নীতি কাঠামো তৈরি করা।
ভারতের বর্তমান গিগ কর্মী নীতি কাঠামোতে যে অভাব দেখা যায় তা ইচ্ছার নয়, বরং যথাযথ রেগুলেটরি কাঠামোর ঘাটতির ফল।
প্ল্যাটফর্মভিত্তিক কাজকে শুধু প্রযুক্তির সুযোগ হিসেবে না দেখে এটিকে দেশের মূল অবকাঠামো হিসেবে ভাবার সময় এসেছে।
শুধুমাত্র সদিচ্ছার ওপর নয়, আইনের মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে, ভারত একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, জবাবদিহিমূলক, এবং আন্তর্জাতিক স্তরে প্রাসঙ্গিক ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রের মডেল তৈরি করতে পারে।
Advertisement



