পুলক মিত্র
তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ নিয়ে প্রতিনিয়ত বিশ্বজুড়ে চর্চার অন্ত নেই। তবে সম্পত্তির জন্য নয়, এই মুহূর্তে টেসলা কর্তা ইলন মাস্ক খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সংঘাতের কারণে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ইলন মাস্ক – দুজনেই এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত নাম। একজন বিশ্বের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রেসিডেন্ট, আর অন্যজন প্রযুক্তি ব্যবসার রাজা, টেসলা বা স্পেসএক্সের মতো সংস্থার কর্ণধার।
মাস্কের সঙ্গে তাঁর আর কোনও সম্পর্ক নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। ইলনকে নানা কু-বিশেষণে ভূষিত করার পাশাপাশি তাঁকে হুঁশিয়ারিও দিয়ে চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অথচ ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সমর্থন থেকে তাঁর হয়ে প্রচার – সবই করেছিলেন মাস্ক। প্রতিদান হিসেবে বন্ধুকে নিজের পাশে রাখতে আস্ত একটা নতুন প্রশাসনিক দফতরই তৈরি করে ফেলেছিলেন ট্রাম্প। তারপর হঠাৎই বন্ধুত্বে চিড় এবং চরম তিক্ততা।
তবে দুজনের সম্পর্ক বরাবরই মসৃণ ছিল, তা বলা যাবে না। ২০১৬ সালে মার্কিন মসনদে বসার পর মাস্ককে হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করেন ট্রাম্প। কিন্তু ২০১৭ সালে ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিলে, মাস্ক প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। এরপর দুজনের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলেও, তা কখনও প্রকাশ্যে আসেনি। ২০২১ সালে ক্যাপিটল হামলার পর ট্রাম্পের ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ২০২২ সালে মাস্ক টুইটার কিনে নেন, ট্রাম্পের ট্যুইটার অ্যাকাউন্টটি আবার খুলে দেওয়া হয়। তখন মনে হয়েছিল, সম্পর্কের বরফ গলতে চলেছে। কিন্তু ট্রাম্প নিজের তৈরি ট্রুথ সোশ্যাল-এ থাকতে চান বলে জানিয়ে দেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের বিশাল অনুদানও দেন মাস্ক। কিন্তু সংঘাত প্রকাশ্যে আসে ২০২৫-এ, যা এখন রীতিমতো রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক যুদ্ধের চেহারা নিয়েছে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয়বারের মেয়াদের একেবারে শুরুর দিকে তাঁর বন্ধু মাস্ককে প্রশাসনের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। সরকারি ব্যয়ে কাটছাঁট করতে নবগঠিত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দক্ষতা বিভাগের সরকারি দক্ষতা বিষয়ক দফতর (ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা ডিওজিই)-এর দায়িত্ব পান মাস্ক।
মাস্ক এতটাই ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন যে, ডেমোক্র্যাটদের অনেকেই তাঁকে ‘প্রেসিডেন্ট ইলন’ বলে ডাকতে শুরু করেন। গত ফেব্রুয়ারিতেও ফক্স নিউজে পাশাপাশি বসে সাক্ষাৎকার দেন ট্রাম্প ও মাস্ক। তখন মাস্কের প্রশংসা করে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘তিনি একজন নেতা।’ প্রত্যুত্তরে মাস্ক বলেছিলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্টকে ভালোবাসি।’ আর মে মাসে মাস্ক ট্রাম্প প্রশাসনের কর ও ব্যয় প্রস্তাবনা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করতে থাকেন।
ট্রাম্পের কর ও ব্যয় বিলকে ‘জঘন্য’ বলে কটাক্ষ করেন মাস্ক। এরই মধ্যে মহাকাশ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স, যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্টারলিঙ্ক সহ মাস্কের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করে দেন ট্রাম্প। তিনি লেখেন, “বাজেটে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থ সাশ্রয় করার সবচেয়ে সহজ উপায় ইলনের প্রতিষ্ঠানগুলির সরকারি ভর্তুকি ও চুক্তি বাতিল করা।”
মাস্ক ইতিমধ্যে বলেছেন, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছতে স্পেসএক্সের রকেট ব্যবহারের যে উদ্যোগ আমেরিকা নিয়েছে, তিনি তা বাতিল করার পরিকল্পনা করছেন। মার্কিন সিনেটে ট্রাম্পের সই করা কর ও ব্যয় বিল আটকে দিতে রক্ষণশীল আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারেন মাস্ক, এমনটিও শোনা যাচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর ও ব্যয় বিলকে কেন্দ্র করে গত কয়েক সপ্তাহের নানা ঘটনাক্রম এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রাম্পকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেও ছাড়েননি মাস্ক। মাস্ক দাবি করেছেন, ‘এপস্টেইন ফাইল’-এ ট্রাম্পের নাম রয়েছে। বিতর্কিত ‘এপস্টেইন ফাইল’ হল, যৌন অপরাধের মামলায় বিচারাধীন অবস্থায় আত্মহত্যা করা জেফরি এপস্টেইনের মামলা-সংক্রান্ত নথিপত্র। এসব নথিতে জেফরি ও তাঁর সহযোগীদের ভ্রমণের নথি, কাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, সবকিছুর বিস্তারিত রয়েছে। এপস্টেইন ফাইলের কিছু অংশ গোপন রাখা হয়েছে।
মাস্কের অভিযোগ, যৌন কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত জেফরি এপস্টেইনের সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। শোনা যায়, এপস্টেইনের বিলাসবহুল বিমান ‘লোলিটা এক্সপ্রেস’-এ চেপে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন দেশ সফর করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। চলতি বছরের গোড়ায় ওই ফাইলের একাংশ প্রকাশ্যে আনা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ফাইলের পুরো অংশ প্রকাশ্যে আনার দাবি জানিয়েছেন টেসলা কর্তা।
‘বড় সুন্দর’ বিল নিয়ে মাস্কের লাগাতার বিরোধিতার জেরে গত ৫ জুন তাঁর সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধের হুঁশিয়ারি দেন ট্রাম্প। এ প্রসঙ্গে নিজের সমাজমাধ্যম সংস্থা ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ তিনি লেখেন, ‘‘আমাদের বাজেটের কোটি কোটি ডলার সাশ্রয় করার সহজ উপায় হল ইলনের সরকারি ভর্তুকি এবং চুক্তি বাতিল করা।’’ মাস্কের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘স্পেসএক্স’-এর চুক্তি বাতিলের কথাও বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। এর পরেই ‘টেসলা’র শেয়ারে নামে ধস। এক দিনে ১৫ হাজার কোটি ডলার হারায় মাস্কের বৈদেশিক গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের ‘বড় সুন্দর’ বিল আইনে পরিণত হলে মাস্কের ব্যবসার বিরাট ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বিলটিতে সরকারি ভর্তুকি কমানোর উল্লেখ থাকায় তাঁর ব্যাটারিচালিত গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা ‘টেসলা’র শেয়ারে পাঁচ দিনে ২০ শতাংশ পতন দেখা গিয়েছে। এই আর্থিক ধাক্কার জেরেই ট্রাম্প-মাস্কের বন্ধুত্ব রাতারাতি শত্রুতায় পরিণত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিলে মার্কিন নাগরিক নন, এমন ব্যক্তিরা যদি আমেরিকায় উপার্জিত টাকা নিজের দেশে পাঠাতে চান, তবে তার উপর পাঁচ শতাংশ কর চাপানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে এইচ-১বি ভিসা এবং গ্রিনকার্ড নিয়ে বসবাসকারীরা সমস্যায় পড়বেন, যা নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে ‘টেসলা’-কর্তার।
এই বাজেট বিলে তিনটি বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যেগুলো সরাসরি মাস্কের ব্যবসায় প্রভাব ফেলবে। এগুলি হল –
১. ইলেকট্রিক গাড়ির ওপর কর ছাড় তুলে দেওয়া হবে। টেসলা কিনলে ফেডারেল সরকার থেকে ৭,৫০০ ডলারের কর ছাড় মিলত। এই ভর্তুকির কারণে টেসলার দাম অনেক কম পড়ে, তাই বিক্রিও হয় প্রচুর। এই ভর্তুকি তুলে দিলে, টেসলা অনেক বেশি দামে কিনতে হবে, তাই বিক্রিও কমে যাবে।
২. কর্পোরেট কর কমানো হবে অর্থাৎ বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কর ২১ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হবে। এই সুবিধা মাস্কের কোম্পানিগুলোও পাবে। কিন্তু মাস্কের মতে, এতে সরকারের আয় কমবে আর বাজেট ঘাটতি বাড়বে প্রায় ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলার।
৩. ৮৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা বাজেট। প্রতিরক্ষায় কেন এত বিপুল অর্থব্যয়, প্রশ্ন তুলেছেন মাস্ক। তার বদলে কেন টেসলাকে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে না।
এই বিল নিয়ে এক্স পোস্টে ট্রাম্পকে আক্রমণ করে মাস্ক লিখেছেন, “এটা অর্থনীতির সঙ্গে প্রতারণা এবং পরিবেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আমেরিকা ইলেকট্রিক গাড়ির দৌড়ে চিন ও ইউরোপের পিছনে পড়ে যাবে।”
আসলে মাস্ক বরাবরই গ্রিন এনার্জি যেমন সৌরশক্তি বা বৈদ্যুতিক গাড়ির পক্ষে। আর ট্রাম্প পেট্রোল, ডিজেল বা তাপবিদ্যুতে ভরসা করে। ফলে ট্রাম্প তার বাজেটে তেল কোম্পানিগুলোর সুবিধার জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে, যা মাস্কের পছন্দ হয়নি। কারণ তাতে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবসা মার খাবে। অন্যদিকে ট্রাম্পও তেল কোম্পানিগুলোর কথা ভেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে চাইছেন। কারণ, ওই দেশগুলিতে ট্রাম্পের নিজের বহু ব্যবসাও রয়েছে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর হল, মাস্ক এবার নিজেই রাজনীতিতে নামার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলছেন, “মধ্যপন্থী, প্রযুক্তিমনস্ক, ভবিষ্যৎ-ভাবনা সম্পন্ন একটি নতুন রাজনৈতিক দল গড়া দরকার।” তিনি ট্রাম্পের “ইমপিচমেন্ট”-এরও দাবি তুলেছেন। এই দ্বন্দ্ব দেখে চিন্তায় পড়ে গেছেন রিপাবলিকানরা, মাস্ক যদি সত্যি দল তৈরি করেন, তাহলে ভোট ভাগাভাগিতে ডেমোক্র্যাটদের জেতার রাস্তা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মাস্ক-ট্রাম্প দ্বৈরথের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়তে পারে আমেরিকার ‘সিলিকন ভ্যালি’তে। সেখানকার তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলিতে বিপুল সংখ্যায় ভারতীয়েরা চাকরি করেন। ফলে এর আঁচ তাঁদের গায়ে লাগার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউই।
ট্রাম্পের অনুমোদিত ওই বিলের যে বিষয়গুলি নিয়ে মাস্কের আপত্তি ছিল, তার অন্যতম হল রেমিট্যান্সের উপর করের হার হ্রাস। ভারতীয়রা বিদেশে চাকরি করে যে টাকা দেশে পাঠান, তাকে রেমিট্যান্স বলে। যে সব দেশ থেকে ভারতে রেমিট্যান্স আসে, সেই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আমেরিকা।
২২ মে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ ‘হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভস’-এ কর হ্রাস সংক্রান্ত ‘জনকল্যাণমূলক বিলে’ অনুমোদন দেওয়ার পরে ট্রাম্প বলেছিলেন’ “এটি একটি বড় এবং সুন্দর বিল’’ (ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট)। এর পরই ট্রাম্পের সঙ্গে মাস্কের বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে।
বিলের প্রাথমিক খসড়ায় রেমিট্যান্সের উপর করের হার পাঁচ শতাংশ ধার্য করার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু পরে তা কমিয়ে সাড়ে তিন শতাংশ করা হয়। এই নীতি কার্যকর হলে সুবিধা হবে ‘গ্রিন কার্ড’ বা ‘এইচ১বি’ ভিসা নিয়ে আমেরিকায় কাজ করা ভারতীয়দের। করের হার কমলে তার সামগ্রিক সুফল মিলবে ভারতীয় অর্থনীতিতেও। বিশ্বব্যাঙ্ক এবং ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারত শুধুমাত্র ২০২৪ সালেই প্রায় ১২৯০০ কোটি ডলার (১১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি) রেমিট্যান্স পেয়েছে। এই সংখ্যাটি পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেট-অঙ্কের কাছাকাছি!
১০ বছরে ভারতের সামগ্রিক রেমিট্যান্স ৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে আমেরিকায় কর্মরত ভারতীয়দের থেকে এ দেশে এসেছে প্রায় ১ লক্ষ কোটি ডলার। মাস্কের নীতি মানা হলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ত ভারতীয় অর্থনীতিতে। নতুন বিলের ফলে অভিবাসী-অর্থে ‘কোপ’ কম পড়লেও তার ধাক্কা পুরোপুরি এড়াতে পারবে না ভারত। সাড়ে তিন শতাংশ কর কার্যকর হলেও, সামগ্রিকভাবে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স হারাবে ভারত।