• facebook
  • twitter
Tuesday, 26 August, 2025

নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস তাঁর আদর্শ বা কর্মপন্থা অবলম্বন করেনি

নেতাজি আতঙ্কে ভুগে

ফাইল চিত্র

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

স্বাধীন ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় কংগ্রেস শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার জন্মলগ্ন থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সবকিছুই অনুকরণ করেছে। কিন্তু হিংসুটে দৈত্যের মতো কংগ্রেস সরকার কখনওই তাঁর নাম বা তাঁর কৃতিত্ব বা ভূমিকাকে জনসমক্ষে স্বীকার করেনি। পাঠককূলকে সবিনয়ে এ কথাই জানাতে চাই, স্বাধীন ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে যে দুটি দিনকে রাষ্ট্রীয় দিবস বলে পালন করা হয়, এক) ১৫ আগস্ট লালকেল্লায় স্বাধীন ভারতবর্ষের পতাকা উত্তোলন করা। দুই) ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবসে দিল্লির রাজপথে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করা। স্বাধীন ভারতবর্ষের ক্যাবিনেটে প্রথম সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রত্যেক বছর এই দু’টি দিনকে রাষ্ট্রীয় সম্মানের সঙ্গে পালন করা হবে।

কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর নেতাজির ফিরে আসার আতঙ্কে ভোগা জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব এই সমস্ত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থেকে সুকৌশলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নাম বাদ দেওয়া হয়। যাতে তাঁর নাম কোনওভাবেই সামনে না আসে সেই ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছিলেন কংগ্রেসের তৎকালীন ম্যানেজাররা। আজাদ হিন্দ ফৌজের সামরিক অভিবাদন গ্রহণরত নেতাজির ছবি ভারতীয় জনতার স্মৃতিতেই অবশ্যই রয়েছে। ১৯৪৩ সাল আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্ণধার (প্রধানমন্ত্রী) হিসেবে নেতাজি তাঁর সৈন্যবাহিনীর সামনে সামরিক বেশে অভিবাদন গ্রহণ করেছিলেন। একটি দেশ এবং জাতিকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে এই সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করা জাতি এবং দেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক ছিল অন্তত ওই সময়ে। এবং ভারতীয় হিসেবে সেই কাজটি প্রথম করেছিলেন নেতাজিই। ১৯৪৩ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর এই প্রাজ্ঞতা ও দূরদর্শীতা কংগ্রেসের কোনও নেতার মধ্যে দেখা যায়নি।

সুভাষচন্দ্র বসুই প্রথম ডাক দিয়েছিলেন ‘দিল্লি চলো’ এবং লালকেল্লায় স্বাধীন ভারতের পতাকা তোলো। ভারত স্বাধীন হল, কিন্তু নেহরুর চক্রান্তে নেতাজির ঘরে ফেরা হল না। এবং নেহরু ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সকাল ৬টায় লালকেল্লায় গিয়ে স্বাধীন ভারতের পতাকা তুললেন। কিন্তু একবারের জন্যও স্বীকার করলেন না, লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলনের পরিকল্পনা ছিল এক বঞ্চিত বঙ্গসন্তানের। নেহরুর পথ ধরে এ দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীরাও আজও লালকেল্লায় পতাকা তুলে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। নেহরুর পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীদের ধারণা, তাঁরা প্রথম প্রধানমন্ত্রীর রীতিই বহন করে চলেছেন। অথচ এই পরিকল্পনা সবটাই নেতাজির মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল, তা ইতিহাসের গভীর অতলেই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনও জায়গাতেই তাঁর নাম বা পরিকল্পনার কথা ঘুণাক্ষরেও স্বীকার করে না কংগ্রেসের নেতৃত্ব তথা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কোনও কেন্দ্রীয় সরকার।

প্রথমত, এমনই দুর্ভাগ্য যে লালকেল্লার সামনে নেতাজির মূর্ত্তি স্থাপনের কথা ভাবেনি তাঁরা। দ্বিতীয়ত, ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সাল থেকে শুরু হওয়া সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করার যে রীতি, সেটাও সেই সময় অবিকল অনুকরণ করা হয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিবাদনের দৃশ্য থেকেই। কিন্তু সেখানেও চরম উপেক্ষিত হয়েছেন নেতাজি তথা তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ। যেন মনে হয়, এই কুচকাওয়াজ বা সামরিক অভিবাদনের বিষয়গুলি কংগ্রেসের ম্যানেজারদের সুচারু পরিকল্পনার ছাপ। ছাপ যুব এবং দেশপ্রেমিকরা এই সামরিক অভ্যর্থনার দৃশ্য দেখে উৎসাহিত হয়েছেন, কিন্তু কংগ্রেস সরকার জনগণকে কখনওই জানতে দেয়নি যে ১৫ আগস্ট ও ২৬ জানুয়ারি এই আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের পরিকল্পনা তথা ভাবনার কাণ্ডারি ছিলেন নেতাজিই। ১৯৪৩ সালে সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ সরকারের বাহিনীকে রাস্তায় নামিয়ে প্যারেড করিয়ে সামরিক অভ্যর্থনা গ্রহণ করে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলি সহ ব্রিটিশ সরকারকে বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে ভারতীয়দের এই সামরিকবাহিনী বিশ্বের কোনও সৈন্যবাহিনীর চেয়ে কম নয়।

সুভাষচন্দ্র বসুর প্রাজ্ঞতা ও দূরদর্শীতা সর্বজনবিদিত ছিল, কংগ্রেস নেতৃত্বেও তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি ও বিচক্ষণতাকে সমীহ করতেন স্বয়ং গান্ধিজিও। সেইজন্যই ১৯৩৯ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে, দেশ গড়তে পরিকল্পনার কমিশন গঠন করতে হবে।’

স্বাধীন ভারতে কংগ্রেসীরা সরকার গড়েই পরিকল্পনা কমিশন বা যোজনা কমিশন তৈরি হয়েছিল পরবর্তী সময়ে। কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সুভাষের এই ভাবনার কদর বা কৃতজ্ঞতা কোনওটাই স্বীকার করা হয়নি। ভাষার ক্ষেত্রে স্বাধীন ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দি হবে, কিন্তু হিন্দি বর্ণমালা তৈরি হবে রোমান হরফে, কিন্তু নেহরু, সেই ভাবনা কার্যকর করেননি। সেই জন্যই পঞ্চাশের দশকে দক্ষিণ বারতে হিন্দিকে রাষ্ট্রীয় ভাষা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। অথচ সুভাষচন্দ্র বসুর আতঙ্কে ভুগে নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস পার্টি নেতাজির আদর্শ বা কর্মপন্থা অনেকাংশেই অবলম্বন করেননি। যদি তা করা হত, তাহলে ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের চেহারাই অন্যরকম হত। সুভাষচন্দ্রের মতামত জাতীয় কংগ্রেস গ্রহণ করলে, পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান তৈরি হত না। কারণ তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় গড়ে উঠুক ভারতবর্ষ। বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর, সংখ্যালঘুদের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বশাসিত ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন নেতাজি।

স্বাধীনতার সময়ে তাঁর কথা বিবেচনা করলে দেশের দ্বিখম্ডিত হওয়াকে অনেকাংশেই আটকানো সম্ভব হত। সুভাষ আতঙ্কে ভোগা ক্ষমতালোভী জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা নেতাজিকে সম্পূর্ণ ব্রাত্য করে নিজেদের সুবিধামতো মতামত ও ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ফলে স্বাধীনতার এত বছর পরও ভারতবর্ষকে সম্মুখীন হতে হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও উগ্র সন্ত্রাসবাদের মতো কঠিন সমস্যাগুলির। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ব্রিটিশ সরকারের স্বাধীনতা প্রদানের প্রস্তাবের কথা জানান। পরের বছরই কংগ্রেসের সভাপতি পদে গান্ধিজির প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারিয়ে জয়ী হয়েও স্বেচ্ছায় পদত্যাগকরেন। সেই সময়ও দেশের জনগণের প্রতি তাঁর সতর্কবার্তা ছিল দেশভাগের।

মাতৃভূমির বিভাজনের পরিকল্পনা যাতে কানওভাবেই ব্রিটিশ সরকার তথা কংগ্রেসের একাংশ সফল না হয়, সেই লক্ষ্যে ফরওয়ার্ড ব্লকের গঠন করেন তিনি। ১৯৪১ সালে কলকাতার বাড়ি থেকে ব্রিটিশ পুলিশকে বোকা বানিয়ে চলে গেলেও, বিদেশে বসেই আপসহীন স্বাধীনতার কথা দেশবাসীকে নিয়মিত জানিয়ে সজাগ করতেন সুভাষ। কিন্তু ১৯৪৫ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যর্থতায় নেতাজিকে দেশ ছাড়তে হয়, ফলে তারপর ব্রিটিশ সরকারের ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও কংগ্রেসের স্বার্থান্বেষী মহলকে আর দেশভাগের সিদ্ধান্তে বেশি প্রতিবাদের সম্মুখীন হতেহয়নি। ফলে একটি ভূখণ্ডকে জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে তিন টুকরো করে স্বাধীনতার প্রথম উৎসব উদয়াপিত হয়েছিল। বাংলা ও পাঞ্জাবের স্বাধীনতাকামী মানুষকে নিজভূমে পরবাসী করে ‘রিফিউজি’ প্রতিশব্দের উপহার ছিল স্বাধীনতার প্রাপ্তি। যেখানে ১৯০ বছরের পরাধীনতা কাটিয়ে স্বাধীনতা আনন্দে মাতোয়ারা হওয়া উচিত সমগ্র ভারতবাসীর।

News Hub