• facebook
  • twitter
Sunday, 27 July, 2025

দাদাঠাকুর শুধু জনপ্রিয়ই ছিলেন না, শ্রদ্ধাও পেয়েছিলেন

দারিদ্রের সঙ্গে পাল্লা লড়েও দাদাঠাকুর আজীবন মানুষ হাসিয়ে ৮৭ বছর বয়সে ১৩৭৫ -এর জন্মদিনেই অমৃতলোকে পাড়ি দেন।

ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

বাংলা রসসাহিত্যের একমেবাদ্বিতীয়ম শিল্পী শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর আত্মজীবনী ‘ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর’ (১৯৯৬)-এ রসিকতা করে বলেছেন একই নামের দু’জন কখনও বিখ্যাত হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ তিনি রবীন্দ্রনাথের নাম উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় কোনো রবীন্দ্রনাথ বিখ্যাত না হলেও দ্বিতীয় শরৎচন্দ্র বিখ্যাত তো বটেই, জনপ্রিয়ও হয়েছিলেন। তিনি শরৎচন্দ্র পণ্ডিত(১৮৮১-১৯৬৮)। আমজনতার কাছে তিনি দাদাঠাকুর নামেই পরিচিত ছিলেন। অবশ্য কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক হিসাবে প্রতিষ্ঠার পর আরও এক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৮২-১৯৪৫) ঔপন্যাসিক হিসাবে বাংলাসাহিত্যে এলেও তাঁকে পাওয়া যায় একমাত্র সাহিত্যের ইতিহাসে। কিন্তু শরৎচন্দ্র পণ্ডিত তথা দাদাঠাকুর আজও স্বমহিমায় স্মরণে বরণীয়। অথচ তিনি হাসির গান ও কবিতা ছাড়া সাহিত্যের কোনো ধারাকেই সমৃদ্ধ করেননি। কিন্তু আপন পাণ্ডিত্যে সেকালের সাহিত্যরথী ও মহারথীদের পাশাপাশি বলা ভালো একটু বেশিই জনপ্রিয় ছিলেন।

দাদাঠাকুর ১২৮৮ বঙ্গাব্দের ১৩ বৈশাখ বীরভূমের শিমলান্দী গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় বাবা-মাকে হারানোর কাকা রসিকলাল পণ্ডিতের অপত্যস্নেহে তিনি লালিত-পালিত হন। দারিদ্র ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। সেজন্য তিনি বেশিদূর পড়াশুনা করতে পারেননি। জঙ্গিপুর হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করে দাদাঠাকুর এফ. এ. পড়ার জন্য বর্ধমান রাজ কলেজে ভর্তি হন। স্কুলে হাফ বেতন দিতে হলেও কলেজে কোনো বেতন না লাগায় তাঁর পক্ষে পড়াশোনায় সুবিধেই হয়েছিল। কিন্তু আহারাদির জন্য দাদাঠাকুরকে এক পুলিশের ছেলেকে প্রাইভেট পড়াতে হতো। সেখানেও বিপত্তি ঘটে। সেই পুলিশের আরেকটি পাঁচ-ছ বছরের শিশুকে বিনে পয়সায় পড়াতে একরকম বাধ্যই হন তিনি। কলেজে পড়া এবং কায়ক্লেশে আহারাদির ব্যবস্থা করা দুটি বিষয় তাঁর পক্ষে সামলানো সম্ভব হয়নি। অর্থের দারিদ্র পীড়িত করলেও মনের দারিদ্র তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। যদি বিদ্যাসাগরের মতো চারিত্রিক দৃঢ়তার আটপৌরে দ্বিতীয় কোনো বাঙালি থেকে থাকেন, তবে তিনি শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। বিলাসিতার ছিটেফোঁটা তার শরীরকে স্পর্শ করতে পারেনি। কোনোদিন জামা পড়েননি, খালিপায়ে হেঁটেছেন। অথচ জমিদার থেকে লাটসাহেব কারও কাছে মাথা নোয়াননি।

দাদাঠাকুর দুটি কারণে স্মরণীয়। একটি তাঁর সেকালের জঙ্গিপুরের মতো অনুন্নত এলাকা থেকে ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করে প্রকাণ করা, অন্যটি হাস্যরস পরিবেশনের একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করা। মাত্র ৫০ টাকা পুঁজি নিয়ে ৪৬ টাকায় কাঠের পুরোনো প্রেস ও ছাপাখানার সরঞ্জাম কিনে জঙ্গিপুর সংবাদ প্রকাশ করেন। সেই ২০-২১ বছরের তরতাজা যুবক নিজের উদ্যোগে কী কঠোর পরিশ্রম ও অসীম ধৈর্যে পত্রিকাটি চালাতেন, তা তাঁর ছাপাখানা চালানোর কথা থেকে জানা যায় : ‘আমার ছাপাখানার আমি প্রোপাইটার, আমি কম্পোজিটর, আমি প্রুফ- রিডার, আমিই ইঙ্কম্যান। কেবল প্রেস-ম্যান আমি নই,—সেটি ম্যান নয়, উইম্যান। অর্থাৎ আমার অর্ধাঙ্গিনী।’ দাদাঠাকুর গ্রামগঞ্জের খবরই শুধু নয়, সামাজিক অবিচার ও অনাচারের বিরুদ্ধে সরস-ব্যঙ্গে কবিতার আকারে সংবাদ পরিবেশনের একটি নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ঈশ্বর গুপ্তের ভূমিকা স্মরণ করা যেতে পারে। এছাড়া পত্রিকাটিতে দাদাঠাকুরের দেশপ্রেমী হিসাবেও বিশেষ ভূমিকা ছিল। এমনকি সেকালের চা বাগানের শ্বেতাঙ্গ মালিকদের এদেশীয় শ্রমিকদের উপর নৃশংস অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী সচল ছিল। তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রের জন্য একাধিক বার তাঁকে ইংরেজ শাসকের রোষানলে পড়তে হয়েছিল।

রঙ্গভরা বঙ্গদেশে এখন রাজা নেই, তাঁর রসিক ভাঁড়ও নেই। কিন্তু রসিক মানুষ আছে। রাজদরবার না থাকলেও জনদরবার সর্বত্র। এদিকে আবার বাংলা সাহিত্যে হাস্যরস সাদরে সমাদৃত হয়নি। হাসি তখনও হাস্যকর। অথচ মানুষ হাসতে চায়, হাসাতে চায়। কিন্তু হাসানোর রঙ্গ-রসিক কোথায়? এই অভাব পূরণ করার জন্যই যেন দাদাঠাকুরের আবির্ভাব। তাঁর উপস্থিতি মানেই হাসির ফোয়ারা কিংবা উষ্ণ প্রস্রবণ । হাস্যরসের অফুরন্ত ভাণ্ডার দাদাঠাকুরের মধ্যে আবাল্য হাস্যরস সৃষ্টির ক্ষমতা বিস্ময়কর বৈকি! অভ্যন্ত সহজে তাঁর বিধিদত্ত প্রতিভায় সৃষ্ট হাস্যরসে রঙ্গই মুখ্য, ব্যঙ্গ নয়। তিনি একইসঙ্গে হাস্যরসের ধারক এবং বাহক। হাস্যরসকে জনপ্রিয় করার জন্য দাদাঠাকুর ১৩২৯ বঙ্গাব্দে সাপ্তাহিক ‘বিদূষক’ পত্রিকা বের করেন। লেখক থেকে কম্পোজিটর, মুদ্রাকর, প্রকাশক সবই তিনি। তিনিই আবার রঘুনাথ গঞ্জের পণ্ডিত প্রেসে ছাপিয়ে কলকাতার রাস্তায় হকারি করতেন। তাঁর হাস্যরস সৃষ্টি বিস্ময়কর ক্ষমতা পরবর্তীকালে প্রবাদের মতো মানুষের মুখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন :

১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কে জিতবে? দাদাঠাকুরের কথায় জার্মানি (যার Money) এবং জার্মান (যার Man) যেদিকে থাকবে।
২) বহরমপুর মিউনিসিপ্যালিটি নির্বাচনে নীলমণি ভট্টাচার্য ও রমণীমোহন সেনের মধ্যে কে জিতবে? দাদাঠাকুর বললেন, রমণীর (Raw Money) সঙ্গে নীলমণি (Nil Money) পারবে কেন?
৩) দাদাঠাকুরের কথায় কলকাতা অদ্ভুত শহর। সেখানে নিত্যরাস, নিত্যঝুলন। কারণ, ট্রামে বাসে যেমন rush, তেমনি ঝুলন।
৪) এক সভায় শরৎচন্দ্র দাদাঠাকুরকে রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘কীহে, বিদূষক শরৎচন্দ্র….।’ দাদাঠাকুরও কম নন। তিনিও বলেছিলেন, ‘কীহে চরিত্রহীন শরৎচন্দ্র…..’
৫) প্রচণ্ড শীতের এক সভায় খালি গায়ে আসায় সকলের কৌতূহল নিরসনের জন্য দাদাঠাকুর ট্যাঁক থেকে একটি পয়সা বের করে বলেছিলেন পয়সার গরমে এসেছি।
৬) বিদূষক’-এর একটি কবিতার পুত্রবধূ শাশুড়িকে বলেছে, ‘আঁতুর হইতে কলেজ খরচা/ হিসেব করিয়া চার হাজার/ বাবার নিকট নিয়েছ গুনিয়া/ পুত্রের দাবী কেন আবার?’

এই রকম কত দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দারিদ্রের সঙ্গে পাল্লা লড়েও দাদাঠাকুর আজীবন মানুষ হাসিয়ে ৮৭ বছর বয়সে ১৩৭৫ -এর জন্মদিনেই অমৃতলোকে পাড়ি দেন। অথচ তিনি দীর্ঘদিন মৃতলোকে অমৃতের আস্বাদ বিলিয়ে অমর হয়ে রয়েছেন। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর সুদীর্ঘ ৮৫ বছরের জীবনে বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখজনের মতো দাদাঠাকুরকে জনাকয়েক মহাপুরুষের একজন হিসাবে বিশেষিত করেছেন। সেদিক থেকে অন্য শরৎচন্দ্র যে জনপ্রিয় শরৎচন্দ্রের থেকে স্বতন্ত্র, সে বিষয়টি ভাষাচার্যের অভিমতেই প্রকট হয়ে ওঠে।