রবিবারের ব্রিগেড জনসভা জানিয়ে দিল সিপিএম এবং তার সহকারী চার দল রাজ্যে আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সিপিএম দুর্বল হলেও যে নেতিয়ে পড়েনি, তা এই জনসভা থেকে বোঝা গেল। তীব্র তাপদাহ সত্ত্বেও ব্রিগেডে জনসমাগম ভালই হয়েছিল। দূরদুরান্ত থেকে মানুষ আবার বামেদের ডাকে সাড়া দিয়ে ব্রিগেডমুখী হয়েছিল। ২০২৬-এ রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন এখনও অনেক দূরে— পাক্কা একবছর বাকি। সুতরাং তার আগেই বামেদের এই জনসভা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ রাজ্যে এখন চরম অশান্তি চলছে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের ওয়াকফ আইনের সংশোধনকে কেন্দ্র করে তা প্রত্যাহারের দাবিতে মুর্শিদাবাদ, মালদা এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় ব্যাপকভাবে হিংসার ঘটনা ঘটে। মারমুখী জনতা চরম উন্মত্ততার পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয় এবং তাদের বিষয়সম্পত্তি ধ্বংস করে।
ফলে কয়েক হাজার মানুষ নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে। পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায়, আধা সামরিক বাহিনী নামানো হয়। বিশেষ করে সামশেরগঞ্জ, ধুলিয়ান এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ভাঙড়ে সংঘর্ষ ও লুঠপাট এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তাছাড়া চরম দুর্নীতি, জ্বালিয়াতি, কারচুপি এবং অর্থের বিনিময়ে হাজার হাজার শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করে শিক্ষা দপ্তর। কিন্তু মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়ে যায়। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তাছাড়া ৩২ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ নানা কারণে ঝুলে রয়েছে।
তাই সিপিএম রাজ্যের তৃণমূল সরকারের অপশাসন এবং পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য ব্রিগেডে সভা করার এই সময়টাই বেছে নেয়। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে সিপিএম ব্রিগেডে জনসভা করেছিল— তাতেও জনসমাগম বাম নেতাদের খুশি করেছিল। অত্যন্ত উৎসাহী উজ্জীবিত বাম নেতারা ভেবেছিলেন বিধানসভার এই নির্বাচনে তাদের ভালো ফলই হবে। কিন্তু ভোটের ফলাফল বের হলে দেখা গেল সিপিএমের ভোটের ঝুলি শূন্য! বহুবছর পর রাজ্য বিধানসবায় বামেদের কোনও মুখ নেই— যা তাদের কমরেডদের চরম হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়। সেবার অবশ্য বামেরা কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে লড়েছিল। কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের এই মিতালি রাজ্যের মানুষ বিশেষ ভাবে বাম মনোভাবী মানুষজন মেনে নেননি। তাই বলে যে দল ৩৪ বছর রাজ্য শাসন করল, সেই দল একুশের ভোটে একটি আসনও পাবে না, তা অনেকের ভাবনার বাইরে ছিল।
তাই রবিবারের ব্রিগেডে জনজোয়ার দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক বামেরা হয়তো বা ২০২৬ নির্বাচনে শূন্য ঝুলি দেখবে না। বক্তারা কড়া ভাষায় তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কঠোর সমালোচনা করেন দেশকে রসাতলে নিয়ে যাওয়ার কারণে। তাঁরা বলেন, গত ১৪ বছরে বর্তমান তৃণমূল সরকার শ্রমনীতি ও মেহনতি মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। কর্মসংস্থান দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। বেকারিত্ব বাড়ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্যাসিস্ট কায়দায় শাসন চালাচ্ছেন। পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। আইনের শাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি চরমে উঠেছে— আর মমতার সরকার অসহায় হয়ে তা দেখছে।
তাই বাম নেতারা তাঁদের কর্মী এবং সমর্থকদের নির্দেশ দেন এখন থেকেই গ্রামেগঞ্জে গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তৃণমূল শাসকের দুর্নীতি, শিক্ষক নিয়োগে লক্ষ লক্ষ টাকার ঘুষ নেওয়া ও নানা অপকর্মের কথা মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাদের বলতে হবে তৃণমূলের এই স্বৈরাচারি সরকার যেন কিছুতেই ২০২৬ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে না পারে। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অভিযোগ করেন রাজ্যে কোনও শাসন নেই— চারদিকে অশান্তি ও হাহাকার। এই সরকারকে ২০২৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত করতেই হবে। সেই সঙ্গে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করেন।
তবে সিপিএমের এবার বাড়তি সুবিধা হল প্রচুর সংখ্যক শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীরা বাম আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দলে ঢুকেছে। তাঁরাই দলের ভবিষ্যৎ। সুতরাং ২০২৬ নির্বাচনে যদি সিপিএম এবং তাদের সহকারি চার দল এই যুবক-যুবতীদের নির্বাচনের কাজে লাগাতে পারে, তাহলে ছাব্বিশের নির্বাচনের ফলাফলের ঝুলি হয়তো শূন্য যাবে না। এই আশায় বুক বাঁধছে সিপিএম। তাদের মানুষের কাছে যেতে হবে, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।