প্রসঙ্গ: ‘মহামান্য’ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, সব পাখি মাছ খায় দোষ হয় মাছরাঙার

Written by SNS April 4, 2024 12:20 pm

ড. কুমারেশ চক্রবর্তী

বেচারা প্রাক্তন বিচারপতি মহামান্য অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়! বর্তমান বিজেপি নেতা! আমি বুঝতে পারছি না কেন যে বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষে আমাদের হাইকোর্টের এই প্রাক্তন বিচারপতি মশাই কে মানুষ এত গালমন্দ করছেন, নিন্দে করছেন? (অবশ্য অনেক প্রশংসাও কুড়োচ্ছেন)আমার তো মনে হয় তিনি কোন দোষই করেননি! তিনি তো শুধু তাঁর একশ্রেণীর পূর্বসূরীদের অনুসরণ করেছেন মাত্র! যারা এর আগে বারবার শাসকদলের পক্ষে কিংবা অতি প্রভাবশালী ক্ষমতাশালী ব্যক্তির পক্ষে রায় দিয়েছেন৷ এবং পরবর্তীকালে সুবিধা ভোগ করেছেন! তা, কাজ করলে পুরস্কার পাবেন এটাই তো স্বাভাবিক? সুতরাং অভিজিৎ বাবু মাত্র তাই করেছেন! তাহলে তাঁর দোষটা কোথায়?

এই ঘরানার সূচনা হয়েছিল প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির আমলে৷ এখন যারা প্রবীণ তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অজিত নারায়ণ রায়ের কথা? তাঁকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল ৬ জন বিচারপতিকে টপকে৷ পর্দার আড়ালে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি৷ ফলে প্রধান বিচারপতি এ এন রায় ইন্দিরা গান্ধির স্বপক্ষে একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলায় রায় দিয়েছিলেন৷ যদিও পরবর্তীকালে তার ফল ভালো হয়নি৷ শেষ পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি করে শ্রীমতি গান্ধি অবস্থার মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন৷ ব্যর্থ হয়েছিলেন৷ তার প্রতিফল হয়েছিল ভয়ংকর৷ সেবার নির্বাচনে কংগ্রেস প্রায় মুছে গিয়েছিল৷ ইন্দিরা গান্ধি, সঞ্জয় গান্ধি সহ গান্ধি পরিবারের প্রায় সকলেই নির্বাচনে মারাত্মকভাবে পরাজিত হয়েছিলেন৷ জনতা দলের সরকার তৈরি হয়েছিল৷ যথারীতি ইন্দিরা গান্ধি, তার পুত্র সঞ্জয় গান্ধি এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের জেলে যেতে হয়েছিল৷ তবে সেই ঘটনা থেকে ইন্দিরা গান্ধি শিক্ষা নিয়েছিলেন৷ কারণ তাঁর রক্তে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, তার রক্তে ছিল গণতন্ত্রের ঐতিহ্য৷ তাই সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন৷ ভারতের গণতন্ত্র তাকে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিল পূর্বের থেকে আরও মহিমান্বিত করে৷ পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধি আর খুব একটা ভুল করেননি, তাই তিনি যথা সময় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন৷ তার আমলেই ভারত আন্তর্জাতিক রাজনীতির মানচিত্রে একটা শক্তপোক্ত অবস্থান দখল করেছিল, শক্তিশালী হয়েছিল সামরিক বাহিনী, ভারত হয়েছিল পারমাণবিক শক্তির অধিকারী, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য৷ কোন সন্দেহ নেই ইন্দিরা গান্ধির অনেক জন বিরোধী কাজ ছিল৷ তেমনি অনেক বেশি ইতিবাচক ইতিহাস ছিল৷ কিন্ত্ত পরবর্তী যুগে শুরু হলো একচেটিয়া শুধু দেওয়া নেওয়ার ইতিহাস এবং দুর্ভাগ্যবশত সেই বিষাক্ত বিষে সবুজ হয়ে গেল বিচার বিভাগের এক অংশ৷

বলা বাহুল্য ভারতের স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা সারা পৃথিবীর কাছে প্রশংসিত৷ এটা ভারতের পক্ষে গর্বের বিষয়৷ আমাদের দেশের নির্ভীক সাহসী আইনজ্ঞ মানবিক বিচারপতিগণ ভারতের গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার এবং জনগণের ন্যায় বিচারকে রক্ষা করে চলেছেন৷ কিন্ত্ত তার মধ্যেও মাঝে মাঝে কাল সাপ ঢুকে পডে় বিচারব্যবস্থার অতি ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে৷ যার উদাহরণ আমরা বারবার পেয়েছি৷ আসুন সেগুলোকে নিয়ে আমরা একটু নাড়াচাড়া করি৷

আশা করি কুখ্যাত গুজরাট দাঙ্গার কথা আমরা ভুলে যাইনি৷ সেই দাঙ্গার সময়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সুবিখ্যাত নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি৷ যথারীতি তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছিল, সেই দায় থেকে তাকে সেই সময়ে মুক্তি দিয়েছিলেন বিচারপতি অজয় মানিকরাও খানউইলকর৷ গণহত্যার তদন্তে গঠিত সিটে তিনি ছিলেন প্রধান এবং তিনি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ক্লিনচিট দিয়েছিলেন৷ সেই মামলায় নিহত পরিবারেরা আপিল করতে করতে চলে এলেন সুপ্রিম কোর্ট৷ লড়াই চলল দীর্ঘ ২২ বছর৷ সুপ্রিম কোর্টে তখন অন্যতম বিচারপতির আসন অলংকৃত করে আছেন গুজরাটের সেই মান্যবর বিচারপতি অজয় মানিকরাও খানউইলকর৷ আর মাননীয় নরেন্দ্র মোদি তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী৷ ২০২২, ২৪ জুন তিনি পাকাপাকিভাবে মোদিজিকে গুজরাট দাঙ্গা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে দিলেন৷ ফলে তিনি পুরস্কৃতও হলেন৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে গঠিত কমিটি অজয় মানিকরাওকে লোকপালের চেয়ারপারসেনের পদে প্রতিষ্ঠিত করলেন৷ একে ‘দিল্লির ময়ূর সিংহাসন’ আখ্যা দেওয়া যায় ! শুধু গুজরাট দাঙ্গা নয় এর জন্য মাননীয় বিচারপতি মশাইকে অনেক অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে৷ তিনি একের পর এক বিজেপির পক্ষে রায় দিয়েছেন৷ সরকারের পক্ষে পি এম এল এ, ইউ এ পি এ, এফ সি আর এ প্রভৃতি মামলায় বিরোধীদের বক্তব্যকে দূর-মুস করে সরকার পক্ষে রায় দিয়েছেন৷ যেখানে শুধু গণতন্ত্র বিপন্ন হয়নি ব্যাক্তি অধিকারও অনেক অংশেই লঙ্ঘিত হয়েছে৷

এবার আসুন সেই বিখ্যাত বাবরি মসজিদ মামলার কথা বলি৷ যে ৫ বিচারপতির বেঞ্চ অযোধ্যা মামলায় রাম মন্দিরের স্বপক্ষেই রায় দিয়েছিলেন এবং রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিলেন তার অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগই৷ তিনি অবসর নেবার মাত্র চার মাসের মধ্যেই মহামতি মোদি তাকে রাজ্যসভার সদস্য করে পুরস্কৃত করলেন৷

কেরলের রাজ্যপাল পি সদাশিবম কে মনে পডে়? তিনি ছিলেন এককালে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি! সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলায় অমিত শাহের বিরুদ্ধে যে এফ আই আর জারি হয়েছিল সেই মামলা তিনি খারিজ করে দিয়েছিলেন৷ ২০১৩ জুলাই থেকে ২০১৪ এপ্রিল পি সদাশিবম সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন৷ এবং কর্মজীবন থেকে অবসরের পরে যথারীতি কেরলের রাজ্যপাল !
বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় তৎকালীন বিখ্যাত সব বিজেপি নেতারা অভিযুক্ত হয়েছিলেন, যার মধ্যে ছিলেন এল কে আদবানি, মুরলী মনোহর জোশি, কল্যাণ সিং, উমা ভারতী প্রমূখ প্রায় ৩২ জন নেতা নেত্রী৷ কিন্ত্ত ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এদের সবাইকে একেবারেই নিঃশর্ত যাকে বলে বেকসুর খালাস করে দিলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার যাদব৷ এবং পুরস্কার কি পেলেন? উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকারের রাজ্যের উপ লোকায়ক্ত পদ৷ যে পদে অর্থ এবং মর্যাদা দুই পর্য্যাপ্ত৷

বিচারপতি খান উইলকরের আরো একটি কৃতিত্বের মাইলস্টোন হলো এফসিআরএ বা বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন কে বৈধ বলে ঘোষণা করা৷ যার ফলে অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া মাদার টেরিজার মত বহু সংস্থা আর্থিক সংকটের মধ্যে পতিত হলো৷

সাম্প্রতিককালে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত মামলার রায় হলো বারানসীর জ্ঞান-ভাবী মসজিদে হিন্দুদের পূজা অর্চনা করার অধিকার এবং সেখানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকে দিয়ে সার্ভে করার অনুমতি৷ এই রায় দিয়েছিলেন বারানসীর জেলা বিচারপতি এ, কে বিশেশ্বর৷ অবসরের পর তিনি কি পেলেন? উত্তরপ্রদেশে বিজেপি পরিচালিত ডক্টর শকুন্তলা মিশ্র ন্যাশনাল রিহাবিলিটেশন ইউনিভার্সিটির লোকপালের পদ৷ এটাও একটি রাজকীয় সিংহাসন৷

কথায় বলে না, মহাজনেরা যে পথে যায়—! প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সেই পথেই ধাবিত হয়েছেন! তা, কি এমন অন্যায় তিনি করেছেন? ভাবুন তো! বরং তাঁর উত্তরসুরীদের তুলনায় তিনি সামান্য একটা লোকসভার আসন পেয়েছেন মাত্র, পেয়েছেন বলা ভুল একটা আসনের টিকিট পেয়েছেন মাত্র৷ তাঁকে রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লড়াই করতে হবে৷ এ তো রাজ্যসভার রাজভোগ নয়, যে মনোনীত হলেই নির্বাচিত হয়ে গেল৷ সুতরাং এক্ষেত্রে আমি তো অভিজিৎবাবুকে দোষারোপ করতে পারি না, বেচারা অভিজিৎবাবু!

গত প্রায় দু’বছর ধরে তিনি সরকার বিরোধী বিভিন্ন মামলায় যে রায় দিয়েছেন সেটা ভালো না মন্দ এই বিচার করার দুঃসাহস আমার নেই৷ তবে সেই রায়ে একটা যে রাজনৈতিক গন্ধ ছিল এটা অভিজিৎবাবু নিজেই প্রমাণ করে দিয়ে গিয়েছেন৷ কারণ এইসব মামলার রায়ের সময় সরকারপক্ষ সরাসরি না হলেও সরকারি শাসক দল প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বলেছেন যে, অভিজিৎবাবু যেসব রায় দিয়েছেন এগুলি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং এর পেছনে একটা সুগভীর রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে৷ এটাও অভিজিৎবাবু স্বীকার করেছেন৷ মেয়াদ শেষ হবার আগেই হাইকোর্টের বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে বিজেপি দলে যোগ দিয়ে মাননীয় বিচারপতি মশাই বিরোধীপক্ষের সেই অভিযোগকেই সত্যের বেদীতে প্রতিষ্ঠা করলেন৷ এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো বলেছেন, লোকসভার বিরোধী নেতা কংগ্রেস সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী৷ তিনি বলেছেন, “মাননীয় প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগদান করে সবচেয়ে সুবিধে করে দিলেন তৃণমূল কংগ্রেসকে, এতদিন ধরে তৃণমূল কংগ্রেস যে অভিযোগ করে আসছিল অভিজিৎ বাবু সেই অভিযোগের উপর সিলমোহর দিলেন, তাকে মান্যতা দান করলেন৷”

এক্ষেত্রে অভিজিৎবাবু বড়জোর আক্ষেপ করে বলতে পারেন, সব পাখি মাছ খায় দোষ হয় মাছরাঙার!