ছায়াচিত্র গৃহের নামকরণে রবীন্দ্রনাথ

Written by SNS May 8, 2024 12:55 pm

শিবশঙ্কর দাস

বাংলা সংস্কৃতির প্রাণপ্রতিমা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ তাঁর শিল্পকর্ম, তাঁর কবিতা, তাঁর নাটক, তাঁর ছোটগল্প, তাঁর উপন্যাস, তাঁর প্রবন্ধ রচনা, তাঁর গান, তাঁর নামকরণ বাঙালির প্রাণের সমাজ, আত্মার আহার্য্যে বেঁচে থাকার প্রেরণা৷ তাঁর আদর্শ চন্দ্র-সূর্যর মতো চিরন্তন সত্য, তিনি বাঙালি, আমরা গর্বিত৷
অসংখ্য বাহারি ও অপূর্ব নামের সৃষ্টি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর বিশেষ খ্যাতি অসংখ্য পরিবরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও হূদ্যতার জন্য অনেক সময়েই হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁকে শিশুদের নামকরণ করতে হতো৷ এ থেকে তিনি কিছুতেই রেহাই পেতেন না, কখনও বিরক্ত হলেও তাঁর সহজাত গুণে তা অতিক্রম করে নামকরণ করতেন৷ শুনেছি রবীন্দ্রনাথ এমন অনেকের নামকরণ করেছেন, যাঁরা পরবর্তীকালে কৃতি ও যশস্বী হয়েছেন৷ অসংখ্যের মধ্যে অন্যতম নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন৷

কোনও এক সময় সম্ভবত এমন একটা অবস্থা কবিগুরুর এসেছিল, যখন সেখানে তাঁর পরিচিত কারও সন্তান হতো সঙ্গে সঙ্গে বোধহয় চিঠি লিখে কিংবা সাক্ষাতে নামকরণের অনুরোধ জানাতেন তাঁরা৷ ব্যাপারটা এমন একটা পর্যায়ে গিয়েছিল, যখন কবি নিজেই যথেষ্ট বিপন্ন বোধ করতেন৷ তাই তাঁর লেখা চিঠি থেকে একথা জানা যায়৷

রবীন্দ্রনাথের বহু গ্রন্থের নামকরণেও আমরা তাঁর শিল্পকার্য, তাঁর প্রয়োগবিদ্যা, খুঁটিনাটি লক্ষ্য করেছি৷ অসংখ্য নামের মধ্যে আছে গীতাঞ্জলি, গীতালী, চৈতালী, চিত্রাঙ্গদা, মালঞ্চ, কণিকা ইত্যাদি৷ আবার অন্যদিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি সেকেলে নাম একালে অনেকেরই পছন্দ নয়৷ আঙ্গুরবালা, গিরিবালা, কাদম্বিনী, গোলাপিবালা ইত্যাদি৷ আবার একালের ছেলেদের ও মেয়েদের অনেকের নামই (টিঙ্কি, পিঙ্কি, রিঙ্কি) সেকেলে মানুষদের খুশি করতে পারে না৷ তবে রবীন্দ্রনাথ রসিকতা করে বলেছেন এমন অনেক নাম আছে, যা পুংলিঙ্গ না স্ত্রীলিঙ্গ বোঝা দায়৷ যদি না তার নামের সঙ্গে ‘পদ’, ‘চরণ’ প্রসাদ জাতীয় (দুর্গা, তারা, ফাল্গুনি, কালী, শ্যামা, কাজল, উমা ইত্যাদি) একটা কিছু না লাগালে সময় বিশেষে নাম শুনে নয়, চাক্ষুস না করলে বোঝার উপায় নেই নামকরণটি কোনও লিঙ্গের৷

বিশ্বেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরি ছিলেন অখণ্ড বাংলার দিনাজপুরের অন্তর্গত হরিপুরের জমিদার৷ তাঁর মেজো কন্যার নামকরণ ‘সুস্মিতা’ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিশ্বেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরি পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ছিল এবং তাঁদের সঙ্গে চিঠিও আদানপ্রদান হত৷ এক সময় সম্ভবত নামকরণের চাপে অস্থির কবিগুরু রসিকতা করে চিঠি লিখেছিলেন, ‘বিপন্ন বোধ’ করছেন তিনি৷

রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা করেন না ভালোবাসেন না এমন বাঙালি আছে, এ কথায় আমার বিশ্বাস নেই৷ সেই শ্রদ্ধা ভালোবাসার টানেই পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য শ্রদ্ধেয় প্রকাশচন্দ্র নান এবং মনোরঞ্জন ঘোষ মহাশয় অনুরোধ করেছিলেন কবিকে হাতিবাগানের নতুন সিনেমা হলের (ছায়াচিত্র গৃহ) নামকরণের জন্য৷ সে অনুরোধ রক্ষা করেছেন কবি৷ ছায়াচিত্র গৃহের নাম করেন ‘রূপবাণী’ ১২ই জুলাই ১৯৩২ সাল৷ কিন্ত্ত ওইদিন দ্বারোদঘাটন হলো না৷ ঠিক হল ওই শুভকাজ করবেন রবীন্দ্রনাথ নিজে৷ দিন ঠিক হল ১৯ ডিসেম্বর ১৯৩২৷ কবি এলেন দ্বারোদঘাটন অনুষ্ঠানে৷ লিখলেন, ‘রূপবাণীর প্রতি কবির আশীর্বাদ সার্থক হউক৷’ এদিনই কবি কাজি নজরুল ইসলাম উপস্থিত থেকে গেয়েছিলেন মাঙ্গলিক গীতি৷

পরবর্তীকালে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এসেছিলেন ‘রূপবাণী’ সিনেমা হলে ১৯৩৪ সালের ১ ডিসেম্বর, শনিবার৷ প্রেক্ষাগৃহ পরিদর্শনের পর যাওয়ার সময় পরিচালকবর্গকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিলেন৷ রূপবাণীর প্রেক্ষাগৃহ দেখলাম আধুনিক কালের যাবতীয় আয়োজন এই গৃহটিকে সুন্দর করিয়াছে মানুষের আনন্দ উপভোগের দিক হইতে ইহার প্রয়োজনীয়তা৷ অল্প নয়, আমি এই রূপবাণীর দীর্ঘজীবন ও উত্তরোত্তর উন্নতি কামনা করি৷

অবশেষে একথা বলা অনস্বীকার্য যে, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে বহু চিত্রগৃহের ন্যায় এই চিত্রগৃহ বন্ধ৷ মানুষ আজ তার আনন্দের রসদ দূরদর্শন, ইন্টারনেট, মোবাইল ইত্যাদির থেকে সংগ্রহ করে প্রেক্ষাগৃহগুলিকে করেছে ধ্বংসপ্রাপ্ত৷