শোভনলাল চক্রবর্তী
বিশ্বগুরুর আচরণ কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে মুখ খুলেছেন সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত। পাশাপাশি আমিষ-নিরামিষ, খাদ্যাভাস নিয়ে বাড়াবাড়ি ধর্ম পালনের পথ হতে পারে না বলেই জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন ‘‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস বলে গিয়েছেন, যত মত তত পথ।’’ এ দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ মেটাতে সব পক্ষকে এগিয়ে আসার জন্য যেমন তিনি সওয়াল করেছেন, তেমনি স্বদেশিয়ানার হাত ধরে আত্মনির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।বিজেপি নেতাদের দাবি, নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে ‘বিশ্বগুরু’ হয়ে উঠেছে ভারত। আর আরএসএসের ‘শতবর্ষ যাত্রা’ সম্মেলনে সঙ্ঘপ্রধান বলেন, ‘‘বিশ্বগুরু মানেই এই নয় যে সে হাতে ছড়ি নিয়ে শেখাতে বসবে। বিশ্বগুরুর আচরণ হবে নম্র, নিজের আচরণে অন্যকে শেখাবে।’’ এই প্রসঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখায় জোর দিয়েছেন ভাগবত। গত এক দশকের মোদী শাসনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্কের ক্রমশ অবনতি হয়েছে। ভাগবত বলেন, ‘‘পড়শি দেশগুলি অতীতে ভারতের অংশ ছিল। তাই প্রতিবেশী দেশের উন্নয়নের জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া কর্তব্য। কারও চাপে নয়, নিজের ইচ্ছেয় আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের উন্নতি প্রয়োজন।’’ ভারতকে তার পরিধি বাড়াতে পরামর্শ দেন ভাগবত। তাঁর মতে, ভারত এমন একটি দেশ যে নিজের ক্ষতি উপেক্ষা করে অন্যের ভাল করতে এগিয়ে এসেছে। যারা ক্ষতি করেছে, তাদেরও সাহায্য করেছে।বিজেপি শাসনে ধর্মীয় কট্টরবাদ, ধর্মে ধর্মে বিভেদ বাড়ছে বলে সরব বিরোধীরা। বিশ্বে যে কট্টরবাদ বাড়ছে তা মেনে নিয়েছেন ভাগবত। তাঁর কথায়, ‘কট্টরবাদ বাড়ছে। যা কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কোনও ধর্মই অন্যের ধর্ম পরিবর্তনের কথা বলে না। পাশাপাশি ধর্মে-ধর্মে দূরত্ব কমাতে দু’পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে।’ ভাগবতের মতে, ‘‘খাওয়া-দাওয়া, আমিষ-নিরামিষ দিয়ে ধর্ম বিচার ঠিক নয়। তেমনি জল, শ্মশান ও মন্দির নিয়ে বিভেদ করা উচিত নয়। কারণ, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস বলে গিয়েছেন সব ধর্মের লক্ষ্য এক। তিনি ইসলাম মতে সাধনা করে তা প্রমাণ করে দিয়েছেন।’’ শুল্ক-লড়াইয়ের আবহে আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলার ডাক দেন ভাগবত। বলেন, ‘আত্মনির্ভর হওয়ার অর্থ এই নয় যে আমদানি বন্ধ করা। আমদানি-রফতানি চলতেই থাকবে। স্বদেশির অর্থ যে পণ্য ভারতে তৈরি হচ্ছে তা বিদেশ থেকে না আনা। বিদেশ থেকে সেই পণ্য এলে তা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়প্রভাব ফেলবে।’ বিজেপি (জনসঙ্ঘের উত্তরসূরি) ক্ষুদ্র থেকে নানা ছোট-বড় দলের সঙ্গে জোট/বোঝাপড়া করতে করতে এই বৃহদায়তনে পৌঁছেছে। এই দলগুলির বেশির ভাগই আঞ্চলিক— ভাষা, জাতপাত এমনকি, সম্প্রদায়নির্ভর। অনেকেই রাজ্যের হাতে ‘অধিক ক্ষমতা’র দাবিদার। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদীও অনেক সময় তা-ই চেয়েছেন।
Advertisement
এই ‘নতুন পরিস্থিতি’তে সঙ্ঘেরও প্রয়োজন হল ‘যুক্তরাষ্ট্র’ বা মুসলিম/খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ‘গুরুজি’র বলা, বাঞ্চ অব থটস-এ সঙ্কলিত চরম অভিমতগুলির কিছুটা সংশোধন। বর্তমান সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত খানিকটা সেই চেষ্টা করেছেন। ২০১৮ সালে জানিয়েছিলেন, বাঞ্চ অব থটস-এ প্রকাশিত বেশ কিছু অভিমত প্রেক্ষাপট-নির্দিষ্ট, চিরকালীন নয়। গত জুলাই মাসে দিল্লিতে মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও ইমামদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি ভারতে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সংহতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার উপরে জোর দেন, কেননা ‘উভয়েরই ডিএনএ এক’। এর আগে, কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মনে ভয় জাগাতে হিংসাত্মক কার্যকলাপকে ‘গুন্ডামি’ আখ্যাও দিয়েছিলেন। আরএসএস-এর শতবর্ষে, ভাগবতের এ সব বক্তব্য কি নিছক কথার কথা, না কি মনের? প্রবল সন্দেহ জাগে, রাজ্যগুলির যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রমবর্ধমান তাচ্ছিল্য ও নীরবতা দেখে। মণিপুর-সহ নানা প্রান্তে সম্প্রদায়গত হিংসায় দেশের সংহতি সঙ্কটজনক হলেও এই আমলে এক বারও জাতীয় সংহতি পরিষদ-এর মিটিং ডাকা হয়নি। কোনও নির্দিষ্ট ভাষা/ধর্মকে মিশিয়ে ‘বিদেশি চিহ্নিত করে’ আইনি ও সামাজিক হুমকিতে কী ভাবে আক্রান্তের মনে ভয় জাগানো হয়, বাঙালি সংখ্যালঘু পরিযায়ী শ্রমিকরা সম্প্রতি ভালই টের পেয়েছেন! মুখে যা-ই বলুন, ভাগবত জানেন, বোতল থেকে বেরোনো দৈত্যকে ফের বোতলে পোরা অসম্ভব। মোহন ভাগবতের ৭৫তম জন্মদিনে নরেন্দ্র মোদী এ বার খুব করে তৈল মর্দন করলেন। আরএসএস-এর বর্তমান সঙ্ঘচালকের বন্দনা করে তাঁকে কার্যত সংগঠনের ঊর্ধ্বে বসিয়ে দিলেন। আরএসএস-এর ব্যক্তিপুজোর বিরোধিতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী মোহন ভাগবতকে নিয়ে কলম ধরলেন। লিখলেন, সঙ্ঘের গত একশো বছরের যাত্রায় মোহন ভাগবতের জমানায় সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে। স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার দিনেই যে মোহন ভাগবতের জন্মদিন, তা মনে করালেন। মোহন ভাগবতকে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর মন্ত্রে সামাজিক ঐক্যকে মজবুত করার কাজে নিয়োজিত পরশমণি হিসেবে আখ্যা দিলেন।
Advertisement
আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা হেগরেওয়ার আজকের সঙ্ঘচালকের এমন ব্যক্তিপুজো দেখলে কী বলতেন? বলা বাহুল্য, নরেন্দ্র মোদী ও মোহন ভাগবত নিজেদের সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় শুরু করার চেষ্টা করছেন। গত লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে বিজেপি ও আরএসএস-এর মধ্যে ক্ষমতার সংঘাত শুরু হয়েছে। এ হল তাতে ইতি টানার চেষ্টা।
নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ নিজেদের পছন্দের কাউকে গত এক বছর ধরে বিজেপির সভাপতির আসনে বসাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০২৪-এর জানুয়ারিতে বিজেপি সভাপতি পদে জে পি নড্ডার মেয়াদ ফুরোলেও তাঁর উত্তরসূরি নিয়ে বিজেপি-আরএসএস’এর ঐকমত্য হয়নি। মোদী-শাহকে এমন অসহায় অবস্থায় আর কখনও দেখা যায়নি। গত এক দশক মোদীর দাপটে কোণঠাসা হয়ে থাকা আরএসএস ফের বিজেপিতে ছড়ি ঘোরাতে চাইছে। কারণ, গত লোকসভা নির্বাচনে ‘চারশো পার’-এর লক্ষ্য নিয়ে দু’শো চল্লিশে থেমে যাওয়ার পরে নরেন্দ্র মোদীর ধার, ভার ও দাপট, তিনটিই কমেছে। সঙ্ঘও নতুন করে নিজের গুরুত্ব বোঝানোর সুযোগ পেয়েছে। গত ১১ জুলাই ভাগবত নিজেই বলেছিলেন, পঁচাত্তরে পা দেওয়ার অর্থই হল, অবসরের সময় এসে গিয়েছে। সেই মোহন-বাণী নরেন্দ্র মোদীর কপালে ভাঁজ ফেলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। নতুন প্রজন্মের হাতে দায়িত্বের হাতবদলের মোড়কে মোহন ভাগবত কী ভাবে আডবাণীকে বানপ্রস্থে পাঠিয়ে তাঁর হাতে বিজেপির নেতৃত্ব তুলে দিয়েছিলেন, তা মোদীর থেকে ভাল কেউ জানেন না। দেরি না করে ১৫ আগস্ট লাল কেল্লার প্রাচীর থেকে নরেন্দ্র মোদী আরএসএস-এর গত একশো বছর ধরে ব্যক্তিনির্মাণ ও রাষ্ট্রনির্মাণে ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। অথচ, গত এক দশকে নরেন্দ্র মোদী আরএসএস-এর গুণাগুণ সম্পর্কে একটি বাক্যও ব্যয় করেননি। নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দফতরে যাননি। সেই মোদীই এখন আরএসএস-এর শরণাপন্ন।
গত মার্চে তিনি নাগপুরে গিয়ে হেগরেওয়ার, গোলওয়ালকরদের স্মৃতিমন্দিরে মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন। আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত সাম্প্রতিক কালে নিরামিষ-আমিষ প্রসঙ্গে নানা জায়গায় নানা কথাই বলেছেন, এমনকি এ কথাটিও যে: খাবারের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। শুনে যদি কেউ ভাবেন হিন্দুত্বের মতাদর্শ প্রচার-প্রসারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানটি বোধ হয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গোঁড়ামি থেকে বেরোচ্ছে, তবে মস্ত ভুল হবে। সরসঙ্ঘচালকের মন্তব্যে প্রতিটি তথাকথিত সোজাসাপটা ‘অশ্বত্থামা হত’-র সঙ্গে একটি সমস্যাবহুল ‘ইতি গজ’ সর্বদাই জুড়ে থাকে; যেমন, খাদ্যের সঙ্গে ধর্ম সম্পর্কহীন, কিন্তু ধর্মীয় উৎসব-ব্রত-উপবাসের সময় মাংস বিক্রি বা আহার অনুচিত। তিনি বললেন, সরকারি নীতিতে নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস তুলে ধরা উচিত, যদিও সঙ্গে এই তথ্যও দিলেন যে হিন্দু সমাজের ৭২ শতাংশ মানুষ মাংস খান। ভারতীয় সমাজের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, ভারতীয় হিন্দু সমাজও কোনও একশৈলিক অস্তিত্ব নয়। ভারতীয় হিন্দুদের খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র দেখে বিস্ময় জাগতে বাধ্য, যুগ যুগ ধরে তাঁদের ধর্মীয়-সামাজিক জীবনে আমিষ-নিরামিষের সহাবস্থান কী ভাবে আচরিত ও রক্ষিত হয়ে এসেছে।
একই ধর্মাবলম্বী মানুষ দেশের উত্তরাংশে হয়তো পুজো-উৎসবে নিরামিষ খাচ্ছেন কিন্তু পূর্ব ভারতে মাছ-মাংসের চল, আবার কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী বহু ভারতীয় হিন্দু কেবল ব্রত-উপবাসেই নয়, আজীবন নিরামিষ আহারে তৃপ্ত। বিবিধের মাঝে এই মিলন সম্ভব হতে কোনও দিন কোনও সরকারি নীতির প্রয়োজন পড়েনি— ভিন্ন ধর্মের ভারতীয়রা তো বটেই, একই ধর্মের নানা জাতিগোষ্ঠীর ভারতীয়রাও আবহমান কাল ধরে পরস্পরের খাদ্যাভ্যাসের বিভিন্নতাকে সম্মান করেছেন— ধর্মীয় রীতি বা সমাজপ্রথা অক্ষুণ্ণ রেখেই। আমিষ-নিরামিষের এই দ্বন্দ্বকে শুধু জিইয়ে রেখে নয়, তাকে ঘনীভূত করে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তার কেন্দ্রে নিয়ে আসাই বিজেপির লক্ষ্য— খাদ্যাভ্যাস এক দৃশ্যমান সামাজিক আচরণ বলেই তার মাধ্যমে মানুষে মানুষে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজন করা সহজ। বিজেপির এই নিরামিষ-নীতিপুলিশির গোড়াটি বাঁধা আছে আরএসএস-এর মতাদর্শে; তার পুরোধার মুখ থেকে সরকারি নীতিতে নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস প্রচার-প্রসারের ‘পরামর্শ’ নির্গত হওয়ার গুরুত্বও সহজেই অনুমেয়। যুগলালিত সামাজিক অভ্যাস পাল্টানো সহজ নয়, কিন্তু মানুষের পাতে সরকার তথা রাষ্ট্রের হাত যাতে এসে না পড়ে— সতর্কতা জরুরি।মোহন ভাগবতের ক্ষুরধার রাজনৈতিক মস্তিষ্ক জানে, সঙ্ঘের মাহাত্ম্য বজায় রাখতে হলে উগ্র হিন্দুত্বের যজ্ঞের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে চলতে হবে।
অযোধ্যায় রামমন্দির হয়ে গিয়েছে বলে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। সেই হিন্দুত্বের ধুনুচি-নৃত্যে মোদী সরকারেরও লাভ। কারণ, তার ধোঁয়ায় সরকারের যাবতীয় ব্যর্থতা ঢাকা পড়ে যায়। বিজেপি এখনও কাশী-মথুরা আন্দোলন নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। অতীতে রামমন্দির আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সঙ্ঘ প্রথমে সক্রিয় হয়েছিল। পরে বিজেপি মাঠে নামে। কাশী-মথুরার ক্ষেত্রেও হয়তো তা-ই হবে। তাৎপর্যপূর্ণ হল, কাশী ও মথুরা দুই-ই উত্তরপ্রদেশে। নতুন করে কাশী-মথুরার মন্দিরের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে তাতে উত্তরপ্রদেশের গেরুয়াধারী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হবেন সবচেয়ে বেশি। মোহন ভাগবত এখন পঁচাত্তরে বাধ্যতামূলক অবসরের কথা বলছেন না।
কিন্তু আরএসএস কি সুকৌশলে নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক উত্তরসূরির উত্থানের মঞ্চ তৈরি করে দিচ্ছে? মোহন ভাগবত কি আরও এক বার বিজেপিতে প্রবীণ থেকে নবীন প্রজন্মে দায়িত্ব হাতবদলের ঘুঁটি সাজিয়ে রাখছেন?
Advertisement



