• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

ভাইফোঁটা! বোনফোঁটা নয় কেন?

শুধু ভাইফোঁটা নয়, বোনফোঁটাও শুরু হোক। বন্ধন আরো দৃঢ়তা পাক। বোনের সুরক্ষায় এটা ভাইদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠুক।

প্রতীকী চিত্র

সুকান্ত পাল

শারদ উৎসবের মরশুমে বাঙালির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ভাইফোঁটা। ভাইদের মঙ্গল কামনায় সব বোনেরা ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে তার দীর্ঘায়ু কামনা করে। ভাই-বোনের এক পবিত্র সম্পর্ক সব দেশই আছে। এটি একটি লোকাচার। আমরা প্রত্যেকেই জানি এই লোকাচারের যম-যমুনা ও কৃষ্ণ-সুভদ্রার ভাই বোনের দুটি পৌরাণিক কাহিনি।

Advertisement

শুধু বাংলাতেই নয়, সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে অঞ্চলভেদে এই অনুষ্ঠান বিভিন্ন নামে পরিচিত। কোথাও ভাইদুজ, কোথায়ও ভাইয়াদুজ, কোথাও ভাউবিজ, ভাই বিজিন্তায়া, যম দ্বিতীয়া, হস্তভোজনামু, নেপালে ভাইটিকা প্রভৃতি। যে নামেই এই উৎসবকে অভিহিত করা হোক না কেন এর মধ্যে রয়েছে ভাইবোনের মধ্যে এক পবিত্র সম্পর্কের সূত্র। ভাইদের কপালে বিজয়টিকা পরিয়ে দিয়ে তাদের সার্বিক মঙ্গল কামনা করাই এই উৎসবের মূলসূত্র। এক পারিবারিক স্নেহ ও ভালোবাসার বন্ধন অটুট থাকে। কোনোরকম বিপদ যেন ভাইদের জীবনে না নেমে আসে— এই প্রার্থনাই আন্তরিকভাবে বোনেরা করে।

Advertisement

এই উৎসবের ধর্মীয় অনুষঙ্গ যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার থেকে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক সামাজিক অনুষঙ্গ। ভাই বোনদের মধ্যে এক সুসংহত ও গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক এই অনুষ্ঠানে দৃঢ়তা পায়।

কিন্তু এই সময়ে এসে কয়েকটি বেয়াড়া প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। আপাতভাবে দেখতে গেলে এই অনুষ্ঠানে বা লোকাচারে কোনও খারাপ কিছুই চোখে পড়ে না। পড়ার কথাও নয়। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এটা ভীষণভাবে চোখ-সওয়া ও মন-সওয়া হয়ে গেছে। চেতনার দুয়ারে জং ধরলে এরকম অনেক কিছুই সয়ে যায়। এই লোকাচারের মধ্যে পুরুষ আধিপত্যের মন্ত্র কি ধ্বনিত হয় না? এই পুরুষতান্ত্রিকতার ধ্বনি তো সেই বৈদিক যুগ থেকেই চলে আসছে। একটা সমাজে তো নারী পুরুষের সবারই মঙ্গল আকাঙ্ক্ষিত! সবার কপালেই তো বিজয়টিকার আলিম্পন আঁকা উচিত। বোনেদের যাতে কোনও বিপদ আপদ না হয়, তারা যেন দীর্ঘ আয়ু লাভ করে সেই কামনা কি ভাইরা করে না?

আজ এই সময়ে, এই সমাজে যতই আমরা বলি না কেন যে, আমরা আধুনিক হয়েছি। নারী পুরুষের সমান অধিকার। সে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র। কিন্তু কী দেখছি? একসময় নারীদের রক্ষা করার জন্য শিভ্যালরির ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। তবে আমরা কি আমাদের বোনদের জন্য এই লোকাচারকে পারস্পরিক দুদিক থেকেই পালন করতে পারি না? শুধু ভাইদের জন্যই একটি দিনের উৎসবে আমরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে কপালে বোনের দেওয়া ফোঁটা নিয়ে ঘুরে বেড়াবো?

আমার বোনেরা এখন এই অত্যাধুনিক যুগেও যে ভীষণভাবে অসহায়। প্রতিদিন আমার বোনেরা যত্রতত্র ধর্ষিত হচ্ছে, পাচার হয়ে যাচ্ছে, পতিতাপল্লিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে, কর্মস্থলে যৌন হেনস্থার সম্মুখীন হচ্ছে, এমন কী বাড়িতেও কী তারা সুরক্ষিত আছে? প্রশ্ন অনেক।

আমার বোনেরা কোনও প্রতিষ্ঠানে কোনও বেনিয়ম দেখলে প্রতিবাদের কন্ঠ তুললে তাকে ধর্ষিত হয়ে খুন হয়ে যেতে হচ্ছে। বোনেরা যদি একটু শখ করে সন্ধ্যাবেলায় বেরোয় তবে তাকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ভাবা যায়! এই পৃথিবীর মাটিতে কী দিন, কী রাত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের পদচারণার যে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক অধিকার তাকে এইভাবে চোখ রাঙিয়ে ভাইফোঁটার আনন্দে মেতে ওঠার কোনো কারণ আছে কি?
এবার একটু বোঝার দরকার আছে, এই বোনেরা কাদের দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছে? কারা অত্যাচার করছে? তারাও তো কারুর না কারুর ভাই বা দাদা! তাহলে যে বোনেরা ভাইদের মঙ্গল কামনায় সারাদিন উপোষ করে ভাইয়ের কপালে গভীর মমতা, স্নেহ ও ভালোবাসায় ফোঁটা দিচ্ছে সেই বোনেরা হেনস্থার শিকার হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, কী করে? দায় কি শুধু বোনেদের?

বোনেদের মঙ্গল কামনা করে, তার দীর্ঘ আয়ু কামনা করে, তাকে বুক দিয়ে যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার থেকে রক্ষা করার অঙ্গীকার করে বোনের কপালে ভাইরা জয় তিলক কেন এঁকে দেবে না? পুরাণগত এই উৎসবের উৎস যেভাবেই হোক না কেন, সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও লোকাচারের রীতিনীতি তো সব সময়ই পাল্টায়। সময়ের দাবিতে তাকে পাল্টাতেই হয়। এতে সমাজ গতি পায়।

তাই শুধু ভাইফোঁটা নয়, বোনফোঁটাও শুরু হোক। বন্ধন আরো দৃঢ়তা পাক। বোনের সুরক্ষায় এটা ভাইদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠুক। এতে সমাজ ও সভ্যতার উজ্জ্বলতা বাড়বে বৈ কমবে না।

Advertisement