• facebook
  • twitter
Monday, 12 May, 2025

চল্লিশ বছর পরও

ভোপালে সেই ক্ষত আজও বহন করে চলেছে সেই শহরের নাগরিকরা। যক্ষ্মা, হাঁপানির মতো নানা অসুস্থতা নিয়ে জীবন নির্বাহ করে চলেছে মানুষ। কেন্দ্রীয় সরকার বা মধ্যপ্রদেশ সরকারের কোনও হেলদোল নেই।

ফাইল চিত্র

চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে। ভোপাল গ্যাস-দুর্ঘটনার রেশ এখনও টেনে বেড়াতে হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। আজও ন্যায় বিচারের দাবিতে পথে নামতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর। মধ্যরাতে ভোপালের ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানায় গ্যাস লিক হতে শুরু করে। পরের দিন সকালে কর্মব্যস্ত শহরে লোকমুখে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার কথা। তখন মোবাইল ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ নয়। এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের খবর ছড়াতে অনেকটা সময় লেগেছিল। ঠিক কী ঘটেছে, তা বুঝে উঠতে কেটে গিয়েছিল কয়েকটা দিন। কিন্তু বিষ-গ্যাস ছড়াতে বেশি সময় লাগেনি। যে ক্ষতি আজও বহন করে চলতে হচ্ছে। ন্যায় বিচার পাননি ভোপালবাসী। স্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি— সমস্ত দিক থেকেই বঞ্চিত তাঁরা। চল্লিশ বছর পরও তাই ‘ভোপাল কা ইনসাফ করো’ প্ল্যাকার্ড হাতে পথে নামতে হচ্ছে তাঁদের। পালন করতে হচ্ছে নীরবতা। যে গ্যাস দুর্ঘটনা চল্লিশ বছর আগে হয়েছে, তার জেরে এখনও নতুন প্রজন্মকে নানা রোগে ভুগতে হচ্ছে। কোনও ক্ষতিপূরণ নেই, প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্বাস্থ্যের এই হাল— এর প্রতিকার কীভাবে সম্ভব? ফের একই প্রশ্ন ভোপালবাসীর। যদিও এর জবাব অধরা।

ভোপাল গ্যাস-কাণ্ডের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বিরাট মিছিলে শয়ে শয়ে মানুষ পা মেলান। ইউনিয়ন কার্বাইডের বন্ধ কারখানার গেট পর্যন্ত মিছিলে হাঁটেন স্থানীয় পুরুষ, মহিলা, শিশু প্রত্যেকে। দিনভর নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সেই ভয়ঙ্কর দিনটিকে তাঁরা পিরে দেখেছেন। চার দশক আগের সেই পুরনো দিনটি এখনও তাঁদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবু এই দিনটিতে নিজেদের দাবি আরও জোরালো করে তুলে ধরেন গ্যাসপীড়িতরা। ‘কর্পোরেট অপরাধ’ লিখে কুশপুতুলও পোড়ানো হয় মিছিলের পর। গ্যাস কাণ্ডের জেরে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ সহ একগুচ্ছ দাবিতে প্রস্তাব গৃহীত হয় সমাবেশ থেকে। ‘ভোপাল গ্যাস পীড়িত সংঘর্ষ সহযোগ সমিতির সভায় গৃহীত এই প্রস্তাবে সায় দেন গ্যাসপীড়িতরা। শুধু প্রতিবাদই নয়, ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষারও ব্যবস্থা করে এই সমিতি। সমাবেশে গৃহীত প্রস্তাবের অন্যতম দাবিগুলি হল, গ্যাসপীড়িতদের মাসে পাঁচ হাজার টাকা পেনশন, সঠিক চিকিৎসা, পুনর্বাসন, যুবদের কর্মসংস্থান।

ভোপাল গ্যাস-দুর্ঘটনা এক জঘন্য ‘কর্পোরেট অপরাধ’। পরিবেশের কথা মাথায় রাখাই হয়নি। এই অপরাধের জেরেই স্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনৈতিক অবস্থা— সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আজকের ছেলেমেয়েরা। বিপর্যয় আজও বহমান। এখন অন্তত ভাবা দরকার, কীভাবে ন্যায়বিচার পাবেন এই দুর্গতরা?

প্রত্যক্ষদর্শী এক চিত্র সাংবাদিক জানান, ‘তিন তারিখে হামিদিয়া হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে বুঝতে পারি কী দুর্বিষহ অবস্থা। পরপর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। এই ঘটনার প্রকোপ কতটা মারাত্মক এবং তীব্র তা বোঝা গিয়েছিল পরে। প্রথমে জানা গিয়েছিল, আট-দশজন প্রাণ হারিয়েছেন। ৪০ জন অসুস্থ। ক্রমশ তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে।’

ভোপালে সেই ক্ষত আজও বহন করে চলেছে সেই শহরের নাগরিকরা। যক্ষ্মা, হাঁপানির মতো নানা অসুস্থতা নিয়ে জীবন নির্বাহ করে চলেছে মানুষ। কেন্দ্রীয় সরকার বা মধ্যপ্রদেশ সরকারের কোনও হেলদোল নেই। স্বেচ্ছাসেবী কিছু সংগঠন এগিয়ে এলেও তাদের সীমিত ক্ষমতায় এত বড় বিপর্যয়ের পরবর্তী প্রভাব মোকাবিলার ক্ষমতা নেই। ভোপাল গ্যাস-বিপর্যয়কে পরবর্তীকালে অনেকে চেরনোবিলের পরমাণু-বিপর্যয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু চেরনোবিলে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছিল দেশ, সে ভাবনায় এখানে অনেক ঘাটতি ছিল। গ্যাস-বিপর্যয়ে ভোপালের চরম ক্ষতির বোঝা এখনও টেনে নিয়ে যাচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। এমন অসহায় অবস্থা সত্যই নিন্দনীয়।