সুবীর পাল
‘বেলা বয়ে যায়, ছোট্ট মোদের পানসি তরী, সঙ্গে কে কে যাবি আয়।’ বাংলার এই আবেগপূর্ণ অতি জনপ্রিয় গানটির সঙ্গে কোথায় যেন একসূত্রে বাঁধা পড়ে গেছে সাম্প্রতিকতম তিলোত্তমা নগরীতে ঘটে যাওয়া স্বদেশী আতিথ্যে বৈদেশিক আমন্ত্রণের।
সঙ্গীতের শব্দগত অর্থে তো আকাশ জমিন ফারাক। কিন্তু কোনও বিদেশী ভূখণ্ডে সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈদেশিক সম্পর্কের পরিস্থিতি যদি আরও উন্মুক্ত হওয়ার বৃত্ত ক্রমেই প্রসারিত হয় তখন এই গানের কলিটা মনে অবশ্যই গুনগুনিয়ে ওঠে বৈকি।
বর্তমান বিশ্বে প্রকৃতই আমাদের দেশ ভারতের থেকে ধারে ও ভারে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে বেলারুশ নামে একটি ছোট্ট রাষ্ট্র। ভারত ও বেলারুশ বন্ধুত্বগত ইস্যুতে আবার বরাবর সহমত পোষণ করে এসেছে। দুজনেরই চিরন্তন কমন বন্ধু কিন্তু আবার এক। তা হলো রাশিয়া। এ’বিষয়ে আমেরিকার রক্ত চক্ষু পুরোপুরি না-পছন্দ ভারত ও বেলারুশের। এমনকি সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে রুশ বনাম ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধও এই দুই দেশের রাশিয়া প্রীতিতে ঘাটতি পড়তে দেয়নি একচুল। তাছাড়া সমগ্র বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনেতারা কায়মনোবাক্যে স্বীকার করেন যে ভারতের সঙ্গে বেলারুশের সম্পর্ক বরাবরই উষ্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ।
সেই বেলারুশের রাষ্ট্রদূত কলকাতায় প্রথমবারের মতো বুধে পা দিলেন। এই শহরে এসেই প্রথম যে কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে প্রকাশ্যে বললেন তা হলো, ‘আমার দেশ বেলারুশ। আপনাদের দেশের থেকে বেলারুশ আকারে অনেকটাই ছোট। তাই বলে আপনাদেরকে অন্তরের সঙ্গে আমাদের আলিঙ্গন করতে একটুও দ্বিধা নেই। আমাদের হাত বাড়ানো রয়েছে। আপনারা অনুগ্রহ করে হাতে হাত মেলান। বেলারুশ আপনাদের ডাকছে। আমাদের দেশে ভারতীয়দের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যুগ যুগ ধরে অত্যন্ত নিবিড় ও আন্তরিক। বেলারুশের প্রকৃত অন্তরাত্মার এক ভালো অকৃত্রিম বন্ধু হলো ভারতবর্ষ। আমাদের উদ্দেশ্য হলো এই বন্ধুত্বকে দ্বিপাক্ষিক স্তরে আরও মজবুত করা।’
ভারতের নয়া দিল্লির বসন্ত বিহারে অবস্থিত বেলারুশের দূতাবাস। সেই ভবণের বর্তমান সর্বময় কর্তা হলেন মিখাইল কাস্কো। তিনি পদমর্যাদায় ভারত সহ নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূত হিসেবে বেলারুশের তরফে নিযুক্ত। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার এই ভারতীয় উপমহাদেশের উপর বেলারুশ সরকার বন্ধুত্বমূলক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অনেকাংশেই নির্ভর করে এই বিদেশি রাষ্ট্রদূতের উপরে। তাই হয়তো মিখাইল কাস্কো কলকাতাতে এসেই ভারত সম্পর্কে পঞ্চমুখ হলেন, সঙ্গে ভারতীয়দের সামগ্রিক ভাবে আমন্ত্রণ জানালেন বেলারুশে পাড়ি জমাতে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তত্ত্বাবধানে কলকাতায় বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট বুধবার শুরু হয়েছে। দুই দিন ব্যাপী এই বাণিজ্যিক মহাযজ্ঞে আমন্ত্রিত অন্যান্য বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে মিখাইল কাস্কোও উপস্থিত ছিলেন। এসবই তো ওপেন সিক্রেট। কিন্তু অষ্টম বার্ষিক এই বাণিজ্যিক মহাযজ্ঞ শুরু হবার ঠিক আগে তিনি সটান মিলিত হোন কলকাতার স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের একাংশের সঙ্গে। সেখানেই তিনি ভারত সম্পর্কে তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ‘আজকের ভারত অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় অথচ প্রবল শক্তিশালী দেশ। এই দেশের আর্থিক বুনিয়াদ সারা বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্তের। আসুন আপনারা আমাদের সঙ্গে নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করুন। দুই দেশের মধ্যে বৈদেশিক বানিজ্য আরও বেশি মাত্রায় গড়ে তুলুন। আর এখানেই তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুয়ারে এসে উল্টে পুঁজি নিবেশের আহ্বান জানিয়ে বসলেন নিজের রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের মাধ্যমে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অর্জুনের পাখির চোখ যদি হয় এই বঙ্গে দেশি ও বিদেশি লগ্নি টানার, ঠিক সেই বাণিজ্য মহাসমাবেশে সশরীরে উপস্থিত হবার একেবারে প্রাক মুহূর্তে কলকাতার মাটিতে বসেই আঞ্চলিক পুঁজি নিজের দেশে হাইজ্যাক করে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসের নিপুণ মুন্সীয়ানা দেখালেন মিখাইল কাস্কো। হয়তো এইসব দক্ষতার কারণেই মিখাইল কাস্কো বেলারুশ প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর অনেক বেশি আস্থাভাজন।
পূর্ব ইউরোপের এই দেশটির সীমানার অপর প্রান্তে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেন, পোল্যান্ড, রাশিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া উল্লেখযোগ্য। এই দেশের অধিকাংশ নাগরিক হলেন খ্রিস্টান। অরণ্য ও হদ্র সমৃদ্ধ এই দেশের অধিবাসীরা ৮০ শতাংশই জাতিগতভাবে বেলারুশীয়। এই ভূখন্ডটি বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্র দখল করে নেয়। সর্বশেষ ১৯৯১ সালে রাশিয়ার হাত থেকে মুক্তি পায়। এই দেশটি আবার রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্যতম গঠনকালীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির অধিকারী। এর আয়তন ৮০.২০০ বর্গমাইল। আর মোট জনসংখ্যা মাত্র ৯১ লক্ষ। এই দেশে দুটি সরকারি ভাষা। একটা রুশ ভাষা অপরটি বেলারুশীয়। এদের মুদ্রার নাম রুবেল।
মজার বিষয় হলো দেশটি আকারে অনেক ছোট হলেও এর মুদ্রার মূল্য কিন্তু চমকে দেওয়ার মতো মূল্যবান। আমেরিকার ১ ডলার সমান বেলারুশের রুবেল মাত্র ৩.২৭। যেখানে ভারতীয় টাকার মূল্য মার্কিন ১ ডলারের সমতুল্যে৮৭.৩৪ টাকা। অন্যদিকে ১ বেলারুশ রুবেল সমান ভারতীয় অর্থে মূল্য দাঁড়ায় ২৬.৭২ টাকা। সুতরাং সহজেই অনুমেয় মুদ্রাগত অবস্থানে ভারতের থেকে বেলারুশের অবস্থান অনেকটাই সুদৃঢ়।
ভারত বন্ধু এই দেশটিতে বিগত বছরের প্রথমার্ধে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৫.৫%। আর বছর শেষে তা কমে দাঁড়ায় ৫.২%। আবার বিশ্ব অর্থনীতিতে এখানকার জিডিপির মূল্য ০.০৭%। প্রধানত এখানকার খনিজ উৎপাদন ও ভারি শিল্প বেলারুশের আর্থিক স্তম্ভের মূল পরিকাঠামো। কৃষিক্ষেত্রে খুব ব্যাপকতা না থাকলেও দুগ্ধ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে এই রাষ্ট্র পৃথিবীতে একদম এক নম্বরে।
বেলারুশের রাষ্ট্রদূত মেনে নেন, আমাদের দেশে চাল উৎপাদন একেবারে তলানিতে রয়েছে। কিন্তু এই রাজ্যে উন্নতমানের চাল উৎপাদন বহু দেশের কাছে ঈর্ষণীয়। বেলারুশে এর ব্যাপক চাহিদা ও কদর তো হিমালয় তুঙ্গ। আপনাদের অনুরোধ করবো বেলারুশে চাল রফতানি করার জন্য এগিয়ে আসুন। এরজন্য বৈদেশিক নিয়ম মেনে সবরকমের সুযোগ সুবিধা আমরা রফতানিকারকদের দিতে প্রস্তুত। এখানকার স্থানীয় চাল রফতানিকারকদের প্রতি তাঁর আবেদন, ‘গুণগত মান বজায় রেখে উন্নত মানের চালের ক্ষেত্রে আপনাদের বৈদেশিক বাণিজ্যে আগ্রহ থাকলে বেলারুশে অন্তত চাল ক্রেতার অভাব হবে না।’
২০২০ সালে সে দেশের সাধারণ নির্বাচন ঘিরে সারা দেশ জুড়ে আভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী তদানীন্তন বিরোধী নেত্রী সভিয়াতলানা সিখানৌস্কায়া দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। সেই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কিছু দেশের সঙ্গে বেলারুশের কূটনৈতিক সম্পর্ক হিমশীতল হয়ে পড়ে। মূলতঃ এহেন নানাবিধ কারণে বেলারুশের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে লাল ফিতের ফাঁস ক্রমশঃ জটিল আকার ধারণ করে। নিজের দেশে ভিসা সংক্রান্ত সমস্যা কথা স্বীকার করে নেন মিখাইল কাস্কো। তাঁর মন্তব্য, ‘আমাদের দেশে ভিসার বিষয়ে কিছুটা নাক উঁচু রয়েছে আভ্যন্তরীণ নীতিগত কারণে। কিছু কিছু দেশের ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট বিধিনিষেধ এখনও কঠোর ভাবে বিদ্যমান। আবার এটাও ঠিক আমাদের অনুশাসন মানতে রাজি হওয়া সুশীল পর্যটককে ভিসা প্রদান করতে আমরা সবসময় প্রস্তুত। কারণ বেলারুশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এক সুন্দর দেশ। পর্যটন এখানকার আর্থিক সমৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ফলতঃ সঠিক পর্যটকদের আমরা ভিসা দিতে গড়িমসি করি না।’
একইসঙ্গে তিনি আভাস দেন, ভারতীয়দের ভিসা প্রদান যাতে আরও সরলীকরণ করা যায় তারজন্য আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর সরকার বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চালাচ্ছেন। উনি একজন দক্ষ বিদেশমন্ত্রী। এছাড়া ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিষয়ে আরও বেশি মাত্রায় বেলারুশের সহযোগ তো দুই দেশের মধ্যে স্বপ্নবন্ধনের মতোই পরিপূরক। ফলে ভিসা নিয়ে ভারত সম্পর্কে বেলারুশ নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে সরলীকরণের স্বদিচ্ছায়।
বেলারুশের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এটা একটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। যত দিন যাচ্ছে তত বেশি করে দুই দেশের নাগরিকেরা পারস্পরিক রাষ্ট্রে যাতায়াত করছেন। ভারতের শুধুমাত্র খনি অঞ্চলেই ৮৬টি বেলারুশের কোম্পানি কাজে নিযুক্ত রয়েছে। অন্যদিকে ভারতের প্রচুর সংখ্যক ছাত্রছাত্রী বেলারুশ যাচ্ছে ডাক্তারি পড়তে। সুতরাং ভারতীয়দের জন্য বেলারুশের নিজস্ব ভিসা নীতিতে কিছুটা বদল আনতে চলেছে, এটাই এখনকার জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দদায়ক সত্যি। আমার ধারণা পুরো বিষয়টিতে কিছু সরলীকরণ আনলে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মিশেল আরও সুমধুর হতে বাধ্য।’