সুকান্ত পাল
উনবিংশ শতকে নবজাগরণের সময়কালে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়ারবন্দ গ্রামে এক অভিজাত ও রক্ষণশীল পরিবারের রোকেয়া খাতুন জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯৭ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে উর্দুভাষী এবং বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহ হবার ফলে তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে পরিচিত হন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর অনুপ্রেরণায় গৃহাভ্যন্তরেই তিনি বাংলা ও ইংরেজি বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেন। এর ফলে সমাজের শিক্ষা ও নারীদের অবস্থান তিনি সম্যক রূপে উপলব্ধি করেন। স্বামীর সঙ্গে ভাগলপুরে বসবাসকালেই তিনি সাহিত্য রচনায় মগ্ন হন। পরে ১৯০৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর পুরোপুরি সমাজসেবা ও সমাজে নারী শিক্ষা বিস্তারে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর দুটি কন্যাসন্তান অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার ফলে তিনি পুরোপুরি সমাজ ভাবনা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন।
Advertisement
নিজের অর্জিত শিক্ষার মাধ্যমে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মুসলিম সামাজিক পরিকাঠামো মুসলিম নারী জাতির অগ্রগতির বাধা স্বরূপ। প্রথম থেকেই তিনি তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের সামাজিক পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সমাজের লিঙ্গ বৈষম্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অবিচার ও অধীনতার মূল কারণ হলো স্ত্রী শিক্ষার অভাব। এই কারণেই তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন নারী শিক্ষার জন্য। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, তা হল, তিনি এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও সেই পরিবার যেহেতু ছিল রক্ষণশীল সেহেতু তাঁর পিতা জহির উদ্দিন নিজে পণ্ডিত ও বহুভাষায় পারদর্শী হয়েও সামাজিক চাপে, পারিপার্শ্বিকতার কারণে রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর মেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যাপারে। কিন্তু রোকেয়ার দিদি করিমুন্নেসা নিজের চেষ্টায় বাংলা ভাষা পড়তে শিখেছিলেন। দিদি ও ভাইদের কাছে শুনতে শুনতে বাংলা ভাষা পড়তে শিখেছিলেন রোকেয়াও। শিশু বয়সে কলকাতায় চলে আসার পর দিদি করিমুন্নেসা ও দাদা ইব্রাহিমের উৎসাহে লেখাপড়া শুরু করলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। পরবর্তীকালে বিবাহের পর স্বামীর অনুপ্রেরণায় তিনি পড়াশোনায় আত্মনিয়োগ করতে পেরেছিলেন এবং যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন।
Advertisement
তাঁর জীবনে ভবিষ্যতের পথরেখা নির্দেশ করে দিয়েছিলেন তাঁর স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। এই কারণেই স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করে প্রথমেই যে কাজটি করেছিলেন তা হলো স্বামীর জন্মস্থান ভাগলপুরে স্বামীর নামে একটি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন। এরপর কলকাতায় ১৯১০ সালে চলে আসেন। এখানে এসে স্থাপন করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল উর্দু প্রাইমারি স্কুল। প্রকৃতপক্ষে পর্দার নামে নারীর অবমাননা ছোটবেলা থেকেই তাঁর মনে একটি বেদনা বোধের সঞ্চার করে এবং নারীর প্রতি সমাজে নানান ধরনের অত্যাচার ও অবমাননা তাঁকে ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী করে তোলে। মুক্ত মনের অধিকারী স্বামীর সাহচর্যে তাঁর যেমন উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ ঘটে তেমনি চিত্ত বিকাশের জন্য রুদ্ধ দ্বারও খুলে যায়। তাঁর জীবনের ব্রত হয় মেয়েদের জন্য আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে পথ খুলে দেওয়া এবং তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস সংগ্রাম করা।
এর জন্য তিনি মুসলিম নারী শিক্ষার জন্য কলকাতার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে স্কুলের জন্য ছাত্রের সংগ্রহ করতেন। ছাত্রীরা যাতে কুলে আসে এর জন্য তিনি ছাত্রীদের অভিভাবকদের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ জানান এবং এই আশ্বাসও দেন যে তাদের স্কুলে আসার বাসভাড়া তিনি দিয়ে দেবেন। তাঁর এই আত্মত্যাগ শুধুমাত্র নারী শিক্ষার জন্য, নারীর অধিকারের জন্য। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কলকাতায় ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম মহিলা সমিতি (অঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম)। নারী শিক্ষা, তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অধিকার প্রভৃতি বিষয় নিয়ে এই সমিতির কার্য পরিচালনা করতেন। এই কাজটি করতে সহায়ক হয়েছিল একটি বিষয়। তা হল, কলকাতার বেথুন স্কুল ও কলেজকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার সংঘটিত হলেও মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষার তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৯০১ সালে সিমলার সম্মেলনে স্ত্রীশিক্ষার বিষয়ে আলোচনায় এই স্ত্রীশিক্ষার বিষয়টি ওঠে এবং ১৯০৭ সালে সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে মুসলিম শিক্ষা বিস্তারে বিষয়টি। এর ফলে পরবর্তীকালে মুসলিম নারী শিক্ষার পথটি অত্যন্ত সংকীর্ণ হলেও তা খুলতে শুরু করে। রোকেয়া বেগম এই সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন।
ছোটবেলা থেকেই রোকেয়াকে পর্দা প্রথার ঘেরাটোপে বন্দী হতে হয়েছিল। ফলে শৈশবেই তিনি অনুভব করেছিলেন অবরোধের বিভীষিকা। তাই পরবর্তীকালে তিনি লেখেন সময়ের এবং সমাজের এক বিশ্বস্ত দলিল ‘অবরোধবাসিনী’ নামে এক গদ্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে মুসলিম সমাজের নারীদের বেদনার কথাই প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও ‘মতিচূড়’ নামে দু’ খণ্ডে লেখেন আরও একটি গদ্যগ্রন্থ। ‘পদ্মরাগ’ নামে একটি উপন্যাসও তিনি লেখেন। এছাড়াও বহু পত্র-পত্রিকায় তিনি লিখেছেন অজস্র গল্প ,কবিতা ,প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রভৃতি।
আগেই বলেছি সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের আন্তরিক ইচ্ছা ও অনুপ্রেরণাই ছিল বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন সফল করার মূল শক্তি। এই শক্তির ফলেই বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন বাংলাদেশের মেয়েদের, বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে। বাঙালি মুসলমান সমাজে বেগম রোকেয়াই সর্বপ্রথম আন্তরিক ও অকৃত্রিম তাগিদে নিজের সম্প্রদায়ের মেয়েদের শিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশ করানোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন।।
এখানে একটি কথা বলা জরুরি, উনিশ শতকে যাঁরা ইংরেজি শিক্ষার জন্য মুসলমানদের আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁরা নারী শিক্ষার কথা ভাবেননি। আব্দুল লতিফ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে শিক্ষার জন্য যতটুকু করেছিলেন তা সবই পুরুষের জন্য। নারী শিক্ষার জন্য কোন পদক্ষেপই করেননি। হিন্দু সমাজের মতো মুসলিম সমাজে কোন রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। সেই কাজটি নিজের কাঁধেই নারী হয়ে তুলে নিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। এদিক থেকে দেখতে গেলে ঔপনিবেশিক ভারতে নারী মুক্তি চেতনার অন্যতম এবং দীপ্তিময়ী পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। সেরিনা জাহান সঠিকভাবেই রোকেয়া সাখাওয়াতকে মুসলমান সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাই তিনি লেখেন,’হিন্দু সমাজে রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরের যে ভূমিকা মুসলমান সমাজেও এই মহিলার অনেকটা একই ধরনের ভূমিকা’।
শেষের কথায় বলতে হয়, মুসলিম মেয়েদের প্রতি যে সামাজিক বৈষম্য চলছিল তার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল মুসলিম পুরুষদের ভূমিকা প্রায় কিছুই ছিল না, একথা বললে ভুল বলা হবে না। রোকেয়া মূলত তাঁর সম্প্রদায়ের মেয়েদের জন্য শিক্ষা বিস্তার ও সামাজিক কুসংস্কার দূর করার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের এবং ভাবীকালের জন্য এক অকম্পিত ও নিঃসঙ্গ দীপ শিখা।
Advertisement



