• facebook
  • twitter
Tuesday, 20 May, 2025

প্রত্যাঘাত

ভারত ঠিক কীভাবে প্রত্যাঘাত করবে, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে প্রস্তুতি পর্ব এবং ‘ড্রিল’ দেখে মনে হয়, ভারত যে কোনও মুহূর্তে স্ট্রাইক করতে পারে পাকিস্তানকে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

অবশেষে দুই সপ্তাহ পর পহেলগামের পর্যটক হত্যার প্রত্যাঘাত করল ভারত। পাকিস্তানে ঢুকে নয়টি জঙ্গি ঘাঁটি উড়িয়ে দিল ভারতীয় বায়ুসেনা। একটা যুদ্ধের জন্য যে প্রস্তুতি পর্ব প্রয়োজন তার সবটাই সম্পূর্ণ করেছে ভারত। পহেলগামের ২৬ জন হিন্দু পর্যটককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় এখনও একজনও জঙ্গির খোঁজ পায়নি সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা। যদিও দক্ষিণ কাশ্মীরে অনেকগুলি জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করেছে তারা। সমগ্র কাশ্মীর উপত্যকার ঘন জঙ্গলে ভারতীয় সেনারা জরুরি তল্লাশি চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পাকিস্তানি মদতপুষ্ট জঙ্গিদের এই বর্বরোচিত হামলার জন্য প্রত্যাঘাত নিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন।

তিনি জল, স্থল ও বায়ু সেনাবাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে মিলিত হয়ে, তাদের প্রস্তুতির কাজ পর্যালোচনা করেছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং তিন বাহিনীর শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে ভারতবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, তাঁরা যা চান, অর্থাৎ পাকিস্তানকে সমুচিত জবাব দেওয়া— তার মোক্ষম জবাব দেবে ভারত। সারাদেশ ব্যাপী মক ড্রিলের কাজও হয়েছে— শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলে সাধারণ নাগরিকরা যাতে অক্ষত থাকে, তার কৌশল তাঁদের শেখানোর মহড়া দিয়েছে। তাছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ, সিন্ধু নদের জল, চন্দ্রভাগা নদীর জল বন্ধ করা হয়েছে— পাকিস্তানে অবস্থানকারী ভারতীয়দের দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে— সেই মতো পাকিস্তানের নাগরিকরা যাঁরা ভারতে আছেন তাঁদেরও নিজভূমে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। ইসলামাবাদকে ভারতীয় হাই কমিশনের স্টাফ কমানো হয়েছে। পাকিস্তানও ভারতে অবস্থিত পাক হাই কমিশনের স্টাফ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।

অর্থাৎ যুদ্ধের আগে যে যে ব্যবস্থাদি নেওয়া প্রয়োজন, ভারত তার কোনওটা বাদ রাখেনি। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা পাকিস্তানকে শিক্ষা দেয়োর কাজকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হল ভারত কি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘ফুল-স্কেল ওয়ারে’ যাবে, নাকি সুযোগ বুঝে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ করে পাকিস্তানের মাটিতে অবস্থানরত জঙ্গিদের নিকেশ করবে আগের মতো?

এদিকে রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব জানিয়েছেন, কোনও মতেই যুদ্ধ নয়। ভারত ও পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদ দমনে বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। আমেরিকা প্রথমে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশই আমাদের বন্ধু বলেও পরে যখন চিন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করল— তখন আমেরিকাও তার পূর্বের বক্তব্য খণ্ডন করে বলল তারা ভারতের পাশে আছে। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সমগ্র পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। রাশিয়া ভারতের অকৃত্রিম বন্ধু। সুতরাং পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে, রাশিয়া যে ভারতের পাশে থাকবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন আলোচনা কালে একবারও পাকিস্তানের নাম উল্লেখ করেননি। এদিকে, চন্দ্রভাগা নদীর জল ছাড়া বন্ধ করে দেখা গেল, সেই নদীর হাঁটু জল। চন্দ্রভাগা নদীর জল বন্ধ করলে শিয়ালকোটে জলসমস্যা তীব্র হবে।

ভারত যেখানে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছে— পাকিস্তান কি বসে আছে? না তা কখনওই নয়। পাকিস্তানও জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করেছে এবং সীমান্তে অবিরাম গোলাবর্ষণ করে চলেছে— ভারতের সেনারাও তার জবাব দিচ্ছে। সামরিক শক্তিতে ভারত অনেকটাই এগিয়ে পাকিস্তানের চেয়ে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে উভয় দেশই পরমাণু শক্তিধর। পাকিস্তান ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে ভারত আক্রমণ করলে তারা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে। যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব কয়েকদিন হল চললেও, এখনও কোনও পক্ষই আগ বাড়িয়ে আক্রমণে উঠে আসেনি।

সত্যিই যদি যুদ্ধ লাগে, তাহলে উভয় দেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে তা বলাই বাহুল্য। তবে ভারতের সামরিক শক্তি পাকিস্তানের তুলনায় অনেক গুণে বেশি থাকায়, তুলনায় ভারতের ক্ষয়ক্ষতি কম হবে বলে সমর বিশেষজ্ঞরা বলেন। চিন পাকিস্তানের বড় বন্ধু হলেও, সেনা পাঠিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করবে না, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে তা বলাই যায়। আবার বেজিং সরকার বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে ভারতের বিরুদ্ধে লড়তে পাকিস্তানকে সাহায্য করতে পারে। দিল্লির সাউথ ব্লক বাংলাদেশে চিনের গতিবিধির উপর নজর রাখছে।

অতীতে তিনটি ফুল-স্কেল ওয়ারে ভারতের কাছে পাকিস্তান দারুণভাবে পর্য্যুদস্ত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। প্রায় ৯২ হাজার পাকিস্তানি সেনা শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারপরও পাকিস্তান শিক্ষা লাভ করেনি— ভারতের বিরুদ্ধে জঙ্গি হানার ছক কষেই চলেছে। পহেলগামের পর্যটক হত্যা তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রতিদিনই ভারতের যুদ্ধ বিমান আকাশে উড়ে চক্কর দিয়ে চলেছে মহড়া হিসেবে। ভারতের যুদ্ধজাহাজ বিক্রম থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়া হচ্ছে— রাজস্থানের মরু অঞ্চলে ভারতের ট্যাঙ্ক বাহিনী মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ যুদ্ধের প্রস্তুতির কোনও কাজ বাকি নেই।

কিন্তু ভারত ঠিক কীভাবে প্রত্যাঘাত করবে, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে প্রস্তুতি পর্ব এবং ‘ড্রিল’ দেখে মনে হয়, ভারত যে কোনও মুহূর্তে স্ট্রাইক করতে পারে পাকিস্তানকে। কিন্তু ১৪০ কোটি ভারতবাসীর তর সইছে না— তারা চায় ভারত এখনই প্রত্যাঘাত করুক। কিন্তু সেই ক্ষণ কখন আসবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে ভারতবাসীর ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষের মুখে মুখে সেই একই কথা ভারত কখন প্রত্যাঘাত করবে। কিন্তু ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষকে প্রত্যাঘাত করার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রধানমন্ত্রী দিলেও, ভারতীয় সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তারা এখন সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন কখন তারা প্রত্যাঘাত করবে। সেনাবাহিনী কৌশল ও স্ট্র্যাটেজি নির্ণয় করবে বলে অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তাদের অভিমত। তাঁরা বলেন, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের পর, ভারত তার সমরশক্তি অনেক বৃদ্ধি করেছে।

ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার ফলে পাকিস্তানের কোনও পণ্য ভারতে ঢুকবে না। পাকিস্তান এদিকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলেও, চরম আর্থিক সংকটে ভুগছে। বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য বেড়েই চলেছে, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার জন্য আমেরিকা ইতিমধ্যেই পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে। সুতরাং যুদ্ধের জন্য আস্ফালন করলেও, পাকিস্তানের এখন চরম দুর্দিন। চরম অর্থ সংকট। পাকিস্তান নামক দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই ভারত বিরোধিতায় নেমেছে। দুই দেশের সম্পর্ক কোনও দিনই ভালো হয়নি।