• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

ভারতে তালিবানি বিদেশমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নারীবিরোধী প্রতিবাদ অত্যন্ত জরুরি ছিল

মহিলা সাংবাদিকদের নিয়ে দ্বিতীয় বার সাংবাদিক সম্মেলন করায় স্বাভাবিকভাবেই তালিবানি বিদেশমন্ত্রীকে নারীবিরোধী অসংখ্য অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।

ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালিবানি সরকারের বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারতে এসে শুধু মাত্র বাছাই করা কয়েকজন পুরুষ সাংবাদিকদের নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করায় স্বাভাবিক ভাবেই তীব্র প্রতিবাদ আছড়ে পড়ে। ১০ অক্টোবর নয়াদিল্লির আফগানিস্তানে দূতাবাসে সেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ দেখা দেয়। বিশেষ করে নারীদের যে দেশে শুধু সম্মান বা শ্রদ্ধাই করা হয় না, তাঁদের স্বমহিমায় উচ্চাসনে সামিল করে গর্ববোধ করা হয়,সেখানে নারীবিদ্বেষী তালিবানি বিদেশমন্ত্রীর মহিলা সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার না দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করার ঔদ্ধত্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের উপরেও বর্তায়। এজন্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহল ও নারী সংগঠনের পক্ষে সোচ্চার প্রতিবাদ দেশের মধ্যে শোরগোল ফেলে দেয়। সেক্ষেত্রে তালিবানি সরকারের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার প্রয়াস জারি থাকে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে তার কোনও ভূমিকা না থাকার কথা বললেও বিষয়টি দেশের মানুষের কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়। বিশেষ করে ভারতের মতো বিশ্বনন্দিত নারীপ্রগতির দেশে বিদেশি বিদেশমন্ত্রীর মহিলা সাংবাদিকদের বাইরে রেখে সাংবাদিক সম্মেলন করার বিষয়টি কোনওভাবেই মেনে যায় না। সেক্ষেত্রে ঐতিহ্য পরম্পরায় নারীদের সমানাধিকার যে দেশে সগৌরবে বহমান, সর্বত্র নারীদের উত্তরণ ও সাফল্যে দেশবাসী গর্ববোধ করে থাকে, সেখানে তালিবানি উগ্র নারীবিরোধী ঘৃণ্য মানসিকতাকে মেনে নেওয়া তার স্বধর্মের পরিপন্থীই নয়, বিদেশি স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে নিজের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে মৌলবাদীদের কাছে রীতিমতো বশ্যতা স্বীকার করাও।

Advertisement

সেদিক থেকে এই প্রতিবাদ অত্যন্ত জরুরি ছিল এবং তা ফলপ্রসূও হয়েছে। ঘটনার আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই আবার আফগানিস্তানের দূতাবাসে মহিলা সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে তালিবানি বিদেশমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলন করাই তার প্রমাণ। সেক্ষেত্রে চাপে পড়ে তালিবানি বিদেশমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলন করাটাও কেন্দ্রীয় সরকারের সদর্থক ভূমিকার প্রশংসা দাবি করে। শুধু তাই নয়, চাপে পড়ে মহিলা সাংবাদিকদের নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করাটাও ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে থেকে গেল।

Advertisement

চার বছর আগে ২০২১-এর ১৫ আগস্টে ভারত তার ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে অমৃত মহোৎসবে মেতে উঠেছিল, সেদিনই আফগানিস্তানে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে তালিবানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই তালিবানি শাসনে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির উত্থানে যে দুটি বিষয় সারা পৃথিবী জুড়ে আতঙ্কিত হাতছানি বয়ে এনেছিল, তার প্রথমটিই নারীবিরোধী উগ্র মানসিকতা। ধর্মীয় অনুশাসন তখন রাষ্ট্রীয় শাসনে পরিণত হওয়ায় নারীদের পর্দানসীন পরাধীন জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে সে দেশে তালিবানি শাসনের আগে নারীশিক্ষা থেকে নারী স্বাধীনতার যে মুক্ত পরিসর ছিল, তা আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। মোট কথা নারীদের সেখানে ধর্মীয় শৃঙ্খলে বন্দিজীবন ক্রমশ অমানবিক বর্বরতায় আধুনিকতা বিমুখ মধ্যযুগীয় দাসত্বের পরিচয়ে প্রকট হয়ে ওঠে। নারীরা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তার কর্মক্ষেত্র, ক্ষমতায়ন থেকে সাংস্কৃতিক বিস্তার, সব ক্ষেত্রই রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ধর্মীয় বিধানে নারীদের অমানবিক ব্রাত্য জীবনের পরিচয়ে তালিবানি শাসনের ভয়ঙ্কর প্রতাপ আধুনিক বিশ্বে ত্রাস সৃষ্টি করে চলে। অন্য আরও একটি বিষয়, আধুনিক শিল্পসংস্কৃতির প্রতি তালিবানি রক্তচক্ষু দেখে বিশ্বের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। শিল্পীদের বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলে, তাঁদের জীবনসংশয় করে তোলে। সেখানে অহিংসার পূজারী বুদ্ধদেবের বিপুল আকৃতির মূর্তিগুলি নির্বিচারে ভেঙে ফেলার বীভৎসতা কাটিয়ে উঠতে সংবেদনশীল বিশ্বনাগরিক মানসে অনেকদিন সময় লেগেছিল। সেদিক থেকে ধর্মান্ধ তালিবানিদের ধর্মীয় বিদ্বেষে নারীদের প্রতি অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি শুধু আফগানিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েনি, অসভ্য ও বর্বরতার ত্রাস সৃষ্টিকারী তালিবানি শাসন নিজেই একটি ত্রাসের নাম। যখনই ধর্মীয় গোঁড়ামির থেকে ধর্মীয় বিদ্বেষের কথা সামনে চলে আসে, তখনই মৌলবাদীর পরাকাষ্ঠায় তালিবানি শাসনের কথা সামনে হাজির হয়। সেদিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদীর মহান দেশ আমাদের ভারতে তালিবানি বিদেশমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনে মহিলা সাংবাদিকদের বাইরে রাখার বার্তা স্বাভাবিকভাবেই জনমানসে তীব্র প্রতিবাদ ঘনিয়ে তোলে। এটিই কাম্য ছিল। আসলে মন থেকে মানতে না পারলে মনের কথা মুখে চলে আসে। এই না-পারাটাই ভারতীয় উদার মানবিকতার পরিচয়। অন্যদিকে মহিলা সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে দ্বিতীয় বার সাংবাদিক সম্মেলন করাটা শুধু এ দেশের গৌরবই শ্রীবৃদ্ধি করেনি, সেইসঙ্গে তালিবানি শাসনের ভোল বদলের বার্তা প্রকাশেও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।

মহিলা সাংবাদিকদের নিয়ে দ্বিতীয় বার সাংবাদিক সম্মেলন করায় স্বাভাবিকভাবেই তালিবানি বিদেশমন্ত্রীকে নারীবিরোধী অসংখ্য অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। সেক্ষেত্রে আফগানিস্তানে তালিবানি শাসনে নারীদের বৈষম্যপীড়িত পর্দানসীন পরাধীন জীবনের আকাঁড়া প্রশ্নবাণে জর্জরিত করার ক্ষেত্রটি স্বাভাবিকভাবে গড়ে তোলা ধারণার বশবর্তী হয়ে উর্বর হয়েই ছিল। প্রসঙ্গত, প্রথমদিকে যেভাবে তালিবানি শাসন নিয়ে চর্চার পরিসর সরগরম হয়ে উঠেছিল, তা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। স্বভাবধর্মে প্রতিবাদও একসময় নিস্তেজ হয়ে যায় । কিন্তু তাতে পরিবর্তিত ঘটনা পরম্পরা সামনে না আসায় বদ্ধমূল ধারণার হেরফের ঘটে না। তালিবানিদের ক্ষেত্রেও ঘটেনি। এজন্য সাংবাদিক সম্মেলনে সরাসরি তালিবানি বিদেশমন্ত্রীকে সরকারিভাবে নারীবিরোধী প্রশ্নের অবতারণা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সেখানে নারীশিক্ষা বন্ধ করা থেকে নারীদের গৃহবন্দি রাখা, অফিসে কাজ করায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা প্রভৃতি বিষয়ে প্রশ্ন উঠে আসে। এতে তালিবানি বিদেশমন্ত্রী সরকারের ‘নারীবিরোধী’ মানসিকতাকে অস্বীকার করেন। শুধু তাই নয়, সে দেশে নারীশিক্ষা প্রচলিত আছে এবং স্কুল ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১ কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৮ লক্ষ মহিলা ও বালিকা। মাদ্রাসাতে স্নাতকস্তর পর্যন্ত পড়ানো হয়। অনেক জায়গায় তার বেশিও পড়ানোর কথা জানান বিদেশমন্ত্রী। অন্যদিকে নারীশিক্ষায় নিষেধাজ্ঞা এখনও বর্তমান, সেকথাও তালিবানি বিদেশমন্ত্রীর মুখে উঠে আসে। তাঁর কথায়, ‘কিছু ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরা শিক্ষায় বাধা দিচ্ছি। আমরা কখনও মহিলা শিক্ষাকে হারাম বলে ঘোষণা করিনি। পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত তা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ সেক্ষেত্রে ধর্মীয় আইনের মধ্যে থেকে নারীশিক্ষা কতদূর বিস্তৃত হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অন্যদিকে তালিবান সরকার যে নারী-পুরুষে বৈষম্যবিরোধী নয়, সে কথাও আমির খান মুত্তাকি জানিয়ে বলেন : ‘আফগানিস্তানে ইসলামের আইন চলে। ইসলাম অনুযায়ী নারী বা পুরুষ, সবার অধিকার সুরক্ষিত করার কথা। প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে। কোথাও কোনও নিষেধ নেই।’

সেক্ষেত্রে প্রথমদিকের তালিবানি দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা বিদেশমন্ত্রীর কথাতেই স্পষ্ট। সেখানে যুদ্ধের রক্তাক্ত পথ রোধ করার লক্ষ্যেই তালিবানি শাসনের উত্তরণের কথাও তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনে উঠে আসে। ‘রক্ত দিয়ে রক্ত মোছা যায় না’র চেতাবনিতেই তালিবানি সরকারের অগ্রগতি ও তার উগ্র ধর্মীয় মূল্যবোধে নারীশিক্ষার সাফল্য নিয়ে সংশয় থাকলেও সময়ের দাবিতে তা নিয়ে যে সে দেশে প্রত্যাশা যে ফুরিয়ে যায়নি, তা এখনও বর্তমান, তাও সম্মেলনটি থেকে বেরিয়ে আসে। এও একদিক থেকে ঐতিহাসিক সাংবাদিক সম্মেলন যেখানে এতদিনের গড়ে তোলা বদ্ধমূল ধারণার রুদ্ধদ্বার খুলে আলোর পরশ দেখা দিল। বিদেশের মাটিতেই তথা ভারতের মতো নারীপ্রগতির দেশে তালিবানি সরকারের নারীবিরোধী মানসিক গোঁড়ামির আধারেই তার নারীমুক্তির পরিচয়ের নবতোরণ উন্মোচিত হল। এও কম বড় প্রাপ্তি নয়।

Advertisement