পুলক মিত্র
যেমনটি আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তাই ঘটল। আর হুমকি, হুঁশিয়ারি নয়, ইরান-ইজরায়েল সংঘর্ষে এবার সরাসরি জড়িয়েই পড়ল আমেরিকা। সংঘর্ষের দশম দিনে ইরানের অন্তত তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে হামলা চালানোর দাবি করেছে আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, আমেরিকার সেনাবাহিনী ইরানের ফোরডো, নাতান্জ ও ইসফাহানে অবস্থিত তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে এবং এই অভিযান সফল হয়েছে বলে ট্রাম্পের দাবি।
ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী, মার্কিন যুদ্ধ বিমান থেকে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা নিক্ষেপ করে ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এই হামলার পর সমাজমাধ্যমেই ট্রাম্প বার্তা দিয়ে বলেছেন, “এখন শান্তির সময়।” ইজরায়েল-ইরান সংঘাতে ইন্ধন জুগিয়ে এখন নিজেই শান্তির বাণী দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে!
প্রশ্ন হল, কেন আমেরিকা হামলার জন্য এই তিনটি পরমাণু কেন্দ্রকে বেছে নিল? এখানে সংক্ষেপে তিনটি কেন্দ্রের কথা তুলে ধরছি।
ফোরডো পরমাণুকেন্দ্র
এই কেন্দ্রে পরমাণু বোমার জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম বিশুদ্ধকরণের কাজ চলে। ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি পাহাড়ের নীচে এই পরমাণু গবেষণাকেন্দ্রটির অবস্থান। বলা হয়ে থাকে, এটি ইরানের সবচেয়ে গোপনীয় এবং সবচেয়ে সুরক্ষিত পরমাণুকেন্দ্র। মাটি থেকে প্রায় ৩০০ ফুট গভীরে গড়ে তোলা এই কেন্দ্রে কোনও শত্রু আক্রমণ করলে, তাতে এর কোনও ক্ষতি হবে না। এমনকি যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা বোমাও ছুড়েও এর ক্ষতি করা যাবে না, এমনই দাবি ইরানের। ইজরায়েল ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ফোরডো ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এই গোপন পরমাণু কেন্দ্রের অস্তিত্বের কথা প্রথম জানতে পারে। পরে ইরানও এর অস্তিত্ব স্বীকার করে। বোমা হামলা আটকাতে এই কেন্দ্রে রাশিয়ার এস-৩০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। আমেরিকা ফোরডোয় বি২ বোম্বার ব্যবহার করে বাঙ্কার বাস্টার বোমা ছুড়েছে বলে দাবি করেছে। এই ধরনের অস্ত্র মাটির নীচে ২০০ ফুট পর্যন্ত গভীরে ঢুকে ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে।
ফোরডো কেন্দ্রে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরি হয়। প্রতি মাসে এখানে ১৬৬ কেজি করে এই ধরনের ইউরেনিয়াম তৈরি হয়। সেই কারণেই এই কেন্দ্রটি ইজরায়েল এবং পশ্চিমি শক্তিগুলির
মাথাব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।
নাতান্জ পরমাণু কেন্দ্র
এই পরমাণু কেন্দ্রটি তেহরান থেকে ২২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ইরানের কেন্দ্রীয় মালভূমিতে অবস্থিত। একে ইরানের ‘ইউরেনিয়াম বিশুদ্ধকরণের মুকুট’ বলা হয়। এই পরমাণু কেন্দ্রের একটি বড় অংশ মাটির নীচে রয়েছে। বাকি অংশ রয়েছে মাটির উপরে।
এখানে ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পরিশুদ্ধ করা যায়। কিন্তু পরমাণু বোমা তৈরির জন্য তা যথেষ্ট নয়। নাতান্জের যে অংশ মাটির উপরে রয়েছে, ইজ়রায়েলের হামলায় সেখানকার বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি।
ইসফাহান পরমাণু কেন্দ্র
তেহরান থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ইসফাহান বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অবস্থিত ইরানের বৃহত্তম পরমাণু গবেষণাকেন্দ্র।
১৯৮৪ সালে চিনের সাহায্যে এই কেন্দ্রটি তৈরি করা হয়। তিন হাজারেরও বেশি পরমাণুবিজ্ঞানী এখানে গবেষণায় যুক্ত রয়েছেন। এ ছাড়া এখানে রয়েছে তিনটি চিনা গবেষণা চুল্লি এবং পরীক্ষাগার, যা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় ভারতের হামলা থামাতে তৎপর হয়ে উঠেছিল আমেরিকা। ট্রাম্প নিজেই একাধিকবার দাবি করেছিলেন, তাঁর হস্তক্ষেপের জন্যই নাকি ভারত হামলা থামাতে বাধ্য হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখে বারবার আমরা শান্তির কথা শুনছি। অথচ বিশ্বজুড়ে তিনিই অশান্তির আগুন জিইয়ে রেখেছেন।
হামাস জঙ্গিদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইজরায়েল ফিলিস্তিনের ওপর হামলা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, এই উপমহাদেশে দশকের পর দশক ধরে সন্ত্রাসবাদীদের ইন্ধন জুগিয়ে আসছে পাকিস্তান। আজ গোটা বিশ্বের সামনে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। অথচ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত ট্রাম্পের মুখে কড়া কথা শোনা যায়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে ট্রাম্পকে। আমেরিকার এই দু’মুখো নীতির বিশ্বে অস্থিরতা ডেকে আনছে।
বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ ও মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি আজ থেকে ২৩ বছর আগে বলেছিলেন, “আমার কাছে লুকোনোর কিছু নেই, স্পষ্টভাবেই বলছি, ক্ষমতামত্ত আমেরিকাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী।”
তিনি আরও বলেছিলেন, “আমি এটাও বলছি যে, আমেরিকায় ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসবাদী হানা ভয়ঙ্কর নৃশংসতা, তবে তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সারা বিশ্বই বহুবার মার্কিন নৃশংসতার শিকার হয়েছে। আমেরিকায় পাঁচ হাজার মানুষের মৃত্যু অবশ্যই নিষ্ঠুরতার ঘটনা। কিন্তু, আমেরিকার পিছনের কদর্য ইতিহাসের কাছে এটা খুব স্বাভাবিক।”
আফগানিস্তানে আমেরিকার হামলার পর তিনি লিখেছিলেন, “আফগানিস্তানে আমরা ক্ষমতামত্ত সন্ত্রাস লক্ষ্য করেছি। আগেই সে সন্ত্রাসবাদী বলে বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল। এবার তার ভয়ঙ্কর চেহারা দেখলাম। প্রমাণ করল, বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্য, পরাক্রান্ত এবং সংগঠিত সন্ত্রাসবাদীর নাম আমেরিকা। আমি তাই স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, সভ্যতার সামনে, ইতিহাসের সামনে, মানবাধিকারের সামনে ভয়ঙ্কর সঙ্কট ডেকে এনেছে আমেরিকার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।”
চমস্কির বক্তব্য আজও সমান প্রাসঙ্গিক। ২৬/১১ থেকে শুরু করে পহেলগামের সাম্প্রতিক হামলা, ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার বারবার প্রমাণ মিলেছে। বিশ্বের দরবারে ভারত প্রমাণও পেশ করেছে। আমেরিকার চরিত্র বদলায়নি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই ট্রাম্পকেই পরম বন্ধু মনে করেন। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্পের মুখোশ বেরিয়ে আসছে। ট্রাম্প যে পথে হাঁটছেন, তাতে আগামী দিনে বিশ্বকে আরও বড় মাশুল গুনতে হবে।