• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

একটি প্রশ্ন ও কয়েকটি উত্তর

চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ আর পরের বছর এপ্রিলে জেলাশাসক পেডিকে গুলি করে মারে বিপ্লবীরা। আবার এসে গেলো এপ্রিল।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

‘মেদিনীপুরের তিন জেলাশাসকের নাম করো যারা সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত হন?’ না দিল্লি বা উত্তরপ্রদেশে নয়, স্নাতক স্তরের ইতিহাস পরীক্ষায় এ প্রশ্ন করা হয়েছে খোদ এই রাজ্যের মেদিনীপুর জেলার বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পরে দাউদ ইব্রাহিম, হাফিজ সৈয়দ বা মাসুদ আজাহারদের সঙ্গে এক আসনে বসানো হলো সেদিনের প্রদ্যোত, প্রভাংশু, বিমল, রামকৃষ্ণ, নির্মল, মৃগেন্দ্র বা অনাথবন্ধুকে। তাও আবার অগ্নিযুগের আঁতুড়ঘরে! বাঙালি হিসাবে এ আমাদের লজ্জা!‌মৃত্যৃঞ্জয়ী এই শহিদদের একবার না হয় স্মরণ করুন আজ, যারা আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য বলি দিয়েছেন নিজেদের বর্তমান। এঁরা যদি সন্ত্রাসবাদী হন, তাহলে স্বাধীনতা সংগ্রামী কারা? এই প্রশ্নের উত্তরের অবতারণার জন্য এই প্রবন্ধ।

Advertisement

তখন চলছে বৃটিশ সিংহের মান নিয়ে টানাটানির সময়। কেউ মেদিনীপুরে জেলাশাসক হয়ে যেতে রাজি নয়! অনেক সাধ্যসাধনার পর পাওয়া গেল বার্জকে। পূর্বসুরীদের পরিণতি দেখে নিজেকে নিরাপত্তার বলয়ে মুড়ে রাখেন‌। এলো এপ্রিল মাস, ঘটল না কিছুই। বিপ্লবীরা ধারে কাছে পৌঁছাতে পারলো না বীরপুঙ্গবের। এখন শুধু সুযোগের অপেক্ষা। ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৩। মহামেডান ক্লাব বনাম টাউন ক্লাবের খেলা মেদিনীপুর পুলিশ মাঠে। পুরস্কার দিতে আসবেন জেলাশাসক বার্জ। বলতে গেলে প্রতি ইঞ্চিতে দাঁড়িয়ে পুলিশ। খেলা দেখতে হাজির আরো অনেক শ্বেতাঙ্গ রাজপুরুষ। অবশেষে মাঠে পৌঁছালো বার্জ সাহেবের গাড়ি। দেহরক্ষী বেষ্টিত হয়ে সবে মাঠে পা রেখেছেন, এমন সময়ে পশ্চিম দিক থেকে গর্জে উঠলো পিস্তল।

Advertisement

রাজপুরুষদের হতচকিত করে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিক থেকেও গর্জে উঠলো আরও পিস্তলের আওয়াজ। শুরু হলো তাদের দৌড় প্রতিযোগিতা, আপনি বাঁচলে বাপের নাম! গুলিবিদ্ধ হয়ে মাঠেই বসে পড়লেন বার্জ। পলায়মান দর্শকদের ভিড়ে মিশে যেতে পারতো ওই দুই তরুণ কিন্তু না, বার্জকে পড়ে যেতে দেখে তার বুকের ওপর চেপে বসলো এক তরুণ আর তারপর পুরো ম্যাগাজিনটাই খালি করে দিল। শত্রুর যে শেষ রাখতে নেই। ততক্ষণে সম্বিত ফিরে পেয়েছে দেহরক্ষীর দল, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো দুই তরুণ। রক্তস্নাত হয়ে মাঠেই শুয়ে থাকলো পাশাপাশি তিনটি প্রাণহীন দেহ। শিকারের মুখে বেদনার ছাপ থাকলেও দুই বিপ্লবীর মুখে তখন বিজয়ীর হাসি। ১৯৩৩ সালে শহিদ হলেন দুই কিশোর অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন দত্ত। জেলাশাসক বার্জ হত্যা-মামলায় অভিযুক্ত ব্রজকিশোর, নির্মলজীবন ঘোষ এবং রামকৃষ্ণ রায়ের ফাঁসি হয় ১৯৩৪-এর অক্টোবরের ২৫ ও ২৬ তারিখে। ফাঁসির চার দিন আগে মরণ-নিস্পৃহ চিঠি লিখছেন একুশ বছরের অকুতোভয় ব্রজকিশোর, বাড়িতে যাকে আদর করে বেজা বলে ডাকা হতো। ‘বাবা, আপনি চার বছর আগে বলেছিলেন যে, যখন আমার চন্দ্রের দশা পড়বে তখন আমাকে বারো বছর প্রবাসে বাস করতে হবে। এমনকি আমার মৃত্যু হওয়াও অসম্ভব নয়! এই কথা আজ বর্ণে বর্ণে সত্য হচ্ছে।’ আর মা-কে লেখা চিঠিতে আদরের ‘বেজা’ ঠাকুরমা, দিদিমা, পিসিমা, কাকিমা এবং অন্য গুরুজনদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে ‘শেষ বিদায়’ চেয়েছেন। মায়ের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে বলেছেন,
‘ভোরের বেলা শূন্য কোলে/ ডাকবি যখন ‘বেজা’ বলে/ বলবো আমি— নাই গো ‘বেজা’ নাই, মাগো এবার যাই।’‌‌

স্বাধীনতা সংগ্রামের সে এক গৌরবময় অধ্যায়, ১৯৩২ থেকে ১৯৩৪ মাত্র দুবছরে তিন তিনজন শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করেছিল বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। মেদিনীপুরে জেলাশাসক হয়ে এসেছে জেমস পেডি। গোটা জেলায় ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন এই ইংরেজপুঙ্গব। কি না করেছিলেন মেদিনীপুরকে ঠান্ডা করতে।

আইন অমান্যকারী আন্দোলনে ধৃত পুরুষদের বেত মেরে জর্জরিত করা, মেয়েদের কাপড় খুলে থুতু দেওয়া, যখন তখন জেলে গিয়ে বন্দিদের পেটানো কিছুই বাদ রাখেননি। সঙ্গে সদম্ভ চ্যালেঞ্জ, এমন শিক্ষা দেব যে মেদিনীপুরের লোক কোনদিনই ভুলতে পারবে না! গর্জে উঠেছিল দীনেশ গুপ্তর হাতে তৈরি তরুণবৃন্দ। দেখ কে কাকে শিক্ষা দেয়!

১৯৩১ সালের ৭ এপ্রিল। পেডি সাহেব এসেছেন মেদিনীপুর জেলা স্কুলে এক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। সন্ধে উতরে গেছে, হ্যাজাগের আলোয় সাহেব একটার পর একটা ছবি দেখে চলেছেন। সঙ্গে আরও দুই পদস্থ আমলা।
হঠাৎ গুলির শব্দ, পরপর ছ’বার। চারদিকে চিৎকার চেঁচামেচি, ধর ধর। কোথায় কে? ততক্ষণে তারা অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। পরদিন বিকেলে ভবপারে গেলেন পেডি। আর বাঁচে? পিস্তলের ছটা গুলিই যে লক্ষ্যভেদ করেছে, তিনটে পিঠে দুটো হাতে আর শেষটা তলপেটে! কিন্তু মারলটা কে? ধরা পড়েছিলেন বিমল দাশগুপ্ত, কিন্তু আদালতে প্রমাণ করতে পারেনি পুলিশ।

চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ আর পরের বছর এপ্রিলে জেলাশাসক পেডিকে গুলি করে মারে বিপ্লবীরা। আবার এসে গেলো এপ্রিল। তারিখটা ছিল তিরিশ, জেলা বোর্ডের অফিসে মিটিংয়ে এসেছেন কালেক্টর ডগলাস। চারিদিকে সশস্ত্র প্রহরী, মাছি গলার উপায় নেই। খোদ ডগলাস গুলি ভরা রিভলভার টেবিলে রেখে মিটিং করছেন। হঠাৎই যেন আকাশ ভেঙে পড়ল, কোথা থেকে উদয় হলো দুই তরুণ আর তারপর টানা গুলির আওয়াজ। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ডগলাস। মূহুর্তের বিমূঢ়তা তারপর সবাই হৈ হৈ করে উঠলো ধর ধর, ওই যে পালাচ্ছে ওরা। পিস্তল কাজ না করায় ধরা পড়েছিলেন প্রদ্যোত ভট্টাচার্য কিন্তু অধরা থেকে যান বিপ্লবী প্রভাংশু পাল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রসমাজ বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে। বিপ্লবীদের স্মৃতিকথা, সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণী বা সরকারি প্রতিবেদন থেকে বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের কথা জানা যায়। যেসব ছাত্র সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান করেন, তাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন, কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়।

বিপ্লববাদ প্রসারে বাংলার কয়েকটি গুপ্তসমিতির অবদান ছিল। এই সমিতিগুলি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আগে এবং পরে গড়ে ওঠে। এই সমিতিগুলিতে যোগদানের মাধ্যমে বাংলার ছাত্রসমাজ সশস্ত্র বৈপ্লবিক কাজে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ১) অনুশীলন সমিতি— বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর ‘অনুশীলন তত্ত্ব’ এই বিপ্লবী দলের আদর্শ ছিল। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সতীশচন্দ্র বসু অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। বহু ছাত্র এই দলের সদস্য ছিলেন। এখানে শারীরশিক্ষা ও অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হত। ২) যুগান্তর দল— ভগিনী নিবেদিতা ও অরবিন্দ ঘোষের উৎসাহে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ‘যুগান্তর দল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। বারীন্দ্র ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো এই দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এই দল তার সদস্যদের শারীরশিক্ষা ও অস্ত্রশিক্ষা দিত। এখানে বোমা তৈরি করার প্রশিক্ষণও সদস্যদের দেওয়া হত। ৩) অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি— স্বদেশি আন্দোলনের সময় স্কুলছুট ছাত্রদের সাহায্যের জন্য এই সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু। ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন নামে এই সমিতির একটি শাখা ছিল। সেখানে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হত। ৪) বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স— ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুক্তিসংঘ ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (বিভি) নামে পরিচিত হয়। এই দলের কার্যাবলি মুক্তিসংঘের সদস্যদের পরিচালনায় পরবর্তীকালে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ৫) ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি— চট্টগ্রামের এক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সূর্য সেন। তিনি ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে বিপ্লবী দলটি গঠন করেন। এখানে সদস্যদের অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির শিক্ষা দেওয়া হত।বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা এইসব বিপ্লবী দলে বহুসংখ্যক ছাত্র যোগদান করেছিল। এদের বিভিন্ন দুঃসাহসিক বৈপ্লবিক অভিযানেও ছাত্ররা অংশগ্রহণ করত। স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন কিংসফোর্ড। তিনি খুব অত্যাচারী ছিলেন। বিপ্লবীরা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তাকে মুজফ্ফরপুরে বদলি করা হয়। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে মুজফ্ফরপুর যান। কিন্তু ভুলবশত তাঁরা অন্য এক ইংরেজ ব্যক্তিকে হত্যা করেন। প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করেন। ক্ষুদিরাম বসু ধরা পড়েন এবং বিচারে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ফাঁসি হয়। ঢাকা পুলিশের ইনস্পেকটর জেনারেল লোম্যান খুব অত্যাচারী ছিলেন। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সদস্য এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বিনয়কৃষ্ণ বসু তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর বাংলার শাসনকেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং-এ অভিযান চালান তিন বিপ্লবী ছাত্র— বিনয়কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত। তাঁরা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সদস্য ছিলেন। তাঁরা কারা বিভাগের কর্তা সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন। আরেক কর্তা ক্রেগকেও গুলি করেন। বিনয় ও বাদল আত্মহত্যা করেন। পরে দীনেশের ফাঁসি হয়। ছাত্রদের নিয়ে মাস্টারদা সূর্য সেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি গড়ে তোলেন। তিনি এই দলের সাহায্যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল। সরকারি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি জালালাবাদ পাহাড়ে তিন দিন ধরে অসম যুদ্ধ চালিয়ে যান। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের তিন সদস্য বিমল দাশগুপ্ত, প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য এবং অনাথবন্ধু পাঁজা তিন ম্যাজিস্ট্রেট যথাক্রমে পেডি (১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ), ডগলাস (১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ) এবং বার্জকে (১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ) গুলি করে হত্যা করেন। এইভাবে বাংলার ছাত্রসমাজ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে প্রতিবাদ জানায়। বিপ্লবী আদর্শ তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। ফলে সশস্ত্র প্রতিবাদ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে পরিণত হয়। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ইংরেজ সাহেবকে হত্যা ও বিপ্লবীদের কার্যকলাপে ইংরেজ সরকার সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। এই ইতিহাস ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণভোমরা, একে কোনোমতেই কলুষিত হতে দেওয়া চলে না।

Advertisement