শুরুটা হয়েছিল ফিলিপিন্সকে দিয়ে। কয়েক বছর আগে ফিলিপিন্স ৩৭৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ভারতের কাছ থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ গতিসম্পন্ন ক্রূজ মিসাইল ‘ব্রহ্মস’ কিনেছিল। এই ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে একটা চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ ৷ তখন আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী একটু চাপে পড়ে গিয়েছিল। সেই সময় ব্রহ্মস কেনার অপেক্ষারতদের মধ্যে সর্বপ্রথমে ছিল ইন্দোনেশিয়া। যার সঙ্গে ভারতের কথাবার্তা অনেক দূর গড়িয়েছিল। জানা যাচ্ছে সেই ড্রিল প্রায় চুড়ান্ত। ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের (৩৮০০০ কোটি টাকা) ব্রহ্মস কেনার চুক্তি হচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে কিছু দিনের মধ্যে এটা দিনের আলো দেখতে পারে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও অনেক দেশ, যারা ভারতের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের আগ্রাসনে অতিষ্ঠ, তারাও ব্রহ্মস কেনার লাইনে রয়েছে। ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশও সমান আগ্রহী। এছাড়া ইজিপ্ট, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, চিলি, ব্রুনেই সহ বেশ কিছু দেশও ব্রহ্মসের সান্নিধ্য পেতে চায়। কিন্তু কী আছে এই ব্ৰহ্মসে? যা এতগুলো দেশকে মোহিত করেছে। তবে তার আগে দেখা যাক ভারতের মিসাইল তৈরির ইতিহাসটা।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান ছিল আমেরিকার পরম মিত্র। পাকিস্তানকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ‘কোবরা’ মিসাইল ভারতের বেশ কিছু ট্যাঙ্ককে ধ্বংস করেছিল। এই ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল। যা পরবর্তীকালে আমাদের আধুনিক মিসাইল তৈরি করার প্রেরণা জুগিয়েছিল বলা যায়। ১৯৬৯ সালে ভারতের প্রতিরক্ষা ও উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (ডিআরডিও)-এর গবেষণাগারে একটা মিসাইল সম্বন্ধীয় প্রোজেক্ট হাতে নেওয়া হল। এটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘প্রোজেক্ট ডেভিল’। মিসাইলের সমস্ত রকম খুঁটিনাটি প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করাই ছিল এর লক্ষ্য। শুধু তাই নয়, এই প্রজেক্টকে যাতে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় তার জন্য দেশের সবচেয়ে নামি প্রযুক্তি কলেজগুলোর থেকে মেধাবীদের এখানে নিয়োগ করা হল। এইভাবে মিসাইল গবেষণা চলতে লাগল।
১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে তৈরি হল ‘ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ সংক্ষেপে IGMDP, যার শীর্ষে ছিলেন এমন একজন বিজ্ঞানী যাকে ভারতের আধুনিক মিসাইলের জনক বলা হয়। তিনি আর কেউ নন, ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও ভারতরত্ন ড. এপিজে আবদুল কালাম। ড. কালামের তত্ত্বাবধানে ও পরামর্শে পাঁচটা মিসাইলের কাজকারবার ও উন্নয়ন চলতে লাগল। এরা হল ত্রিশূল, আকাশ, নাগ, পৃথ্বী ও অগ্নি । বিজ্ঞানীদের অধ্যাবসায় ও পরিশ্রম যে ব্যর্থ হয়নি তার প্রমাণ হল ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যখন ভারতে তৈরি প্রথম মিসাইল পৃথ্বীকে সফলভাবে পরীক্ষা করা হল। এরপর ভারতের বিজয়রথ এগিয়ে চলল।
কিন্তু এই পথ মসৃণ ছিল না, তাতে অনেক কাঁটা বিছানোও ছিল। ভারতের এই মিসাইল মিশনকে খুব একটা ভাল চোখে দেখেনি পশ্চিমের অনেক উন্নত দেশ। মিসাইলের উন্নয়নে তারা কোনও সাহায্য করবে না সাফ সাফ জানিয়েছিল। আমেরিকা মিসাইলের রেডার ও প্রসেসর সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। মিসাইলের ডানাতে ব্যবহৃত হওয়া ম্যাগনেসিয়াম অ্যালয় পাঠাতে অস্বীকার করেছিল জার্মানি। মিসাইলের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ‘গাইরোস্কোপ’ ও ‘অ্যাক্সিলেরোমিটার’ বিক্রি নিষিদ্ধ করেছিল ফরাসিরা। কিন্তু শত বয়কটেও ভারতের বিজয়রথকে থামানো যায়নি। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ভারত এখন সেই গুটিকয় দেশের মধ্যে একজন যারা সর্বোচ্চ স্তরে মিসাইল নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে।
ব্রহ্মস মিসাইল তৈরি হয়েছে ভারত ও রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে। ভারতের ‘প্রতিরক্ষা ও উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা’ (ডিআরডিও) ও রাশিয়ার ‘এনপিও ম্যাশিনোস্টোয়েনিয়া’-র মধ্যে ১৯৯৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এক চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল। তখন ২৫০ মিলিয়ন ডলার পুঁজি নিয়ে এক কোম্পানি গঠিত হয় যার নাম ‘ব্রহ্মস এরোস্পেস’। ব্রহ্মস নামটা এসেছে মিলিতভাবে ভারতের ‘ব্রহ্মপুত্র’ ও রাশিয়ার ‘মস্কভা’ নদী দুটোর নাম থেকে। এই কোম্পানিতে ভারতের হাতে রয়েছে ৫০.৫ শতাংশ অংশীদারি, আর বাকিটা রাশিয়ার। এর সদর দফতর বানানো হয়েছে নতুন দিল্লিতে। এছাড়া হায়দরাবাদ, তিরুবনন্তপুরম ও পিলানিতেও এদের ইউনিট আছে। আগামী দশ বছরে দু’হাজারের বেশি ব্রহ্মস তৈরি করাই এদের লক্ষ্য। এর মধ্যে অর্ধেকই বন্ধু রাষ্ট্রগুলিতে রফতানি করা হবে। প্রথম দিকে রাশিয়া থেকে ৬৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ আমদানি করে ব্রহ্মস তৈরি করা হত। আর এখন ভারতই ৭৫ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে যা কিছুদিন পরে বেড়ে ৮৫ শতাংশ হয়ে যাবে বলে জানা গেছে।
বৈশিষ্ট্য অনুসারে কোনও মিসাইলকে নানা শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। সেই বিচারে ব্রহ্মস হচ্ছে সুপারসনিক ক্রূজ মিসাইল। ক্রূজের বৈশিষ্ট্য হল, এর গতিপথ সবসময় বায়ুমণ্ডলের মধ্যে থাকে, কখনও বাইরে যায় না আর এর দূরত্বের পাল্লা কম-বেশি ৫০০ কিমির ভেতরে রাখা হয়। আর সুপারসনিক ব্যাপারটা শব্দের গতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেসব মিসাইলের গতিবেগ শব্দের (৩৪৩ মিটার প্রতি সেকেন্ড) থেকে বেশি তারাই সুপারসনিক। ব্রহ্মস অনায়াসেই এই বৈশিষ্ট্যগুলোর অধিকারী। ব্রহ্মসের গতি শব্দের গতিবেগের ২.৮ গুণ বেশি অর্থাৎ ৯৬০ মিটার প্রতি সেকেন্ড।
ব্রহ্মসের আরও একটা বৈশিষ্ট্য, যার জন্য এটা সর্বজনের বাহবা কুড়িয়েছে তা হল- জল, স্থল ও বায়ু সর্বত্রই এর কাজ করার দক্ষতা। মাটি, জাহাজ, বিমান ও সাবমেরিন- সব জায়গা থেকেই একে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। ১২ ই জুন ২০০১ এ ব্রহ্মসকে প্রথম ওড়িশার চাঁদিপুরে পরীক্ষা করা হয়। ২০১৩ সালে বিশাখাপত্তনমের কাছে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে থাকা সাবমেরিন থেকে ব্রহ্মসকে সফলভাবে ওড়ানো হয়েছে। ২০২১ সালে বায়ুসেনা সফলভাবে একে সুখোই যুদ্ধবিমান থেকে উৎক্ষেপণ করেছে।
ব্রহ্মস আকাশেই পথ পাল্টে চলমান লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে পারে। মাটি থেকে মাত্র ৫ মিটার উচ্চতায় উড়তে পারে, আবার ১৫০০০ মিটার উপরেও উঠে যেতে পারে। একেবারে নীচ দিয়ে যাওয়ার সময় শত্রুর রাডারে ধরা পড়া প্রায় অসম্ভব। যদি দেখাও যায় তবে একে রোখা মুশকিল এর দুরন্ত গতির কারণে। সুপারসনিক গতিতে এটা সৰ্বাধিক ২৯০ কিমি যেতে
পারে।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্রহ্মসকেও আরও বেশি আধুনিক করে তোলা হচ্ছে। এর পরের প্রজন্মের নাম ‘ব্রহ্মস এনজি’। এর গতি ও পাল্লা আগের ব্রহ্মসের মতোই এক রাখা হয়েছে কিন্তু ওজন ও দৈর্ঘ্য কমানো হয়েছে। ওজন আগেরটার (৩০০০ কিলোগ্রাম) প্রায় অর্ধেক করা হচ্ছে আর দৈর্ঘ্যও কমে গিয়ে হবে ৬ মিটার, যা আগে ছিল ৮.৪ মিটার। সবমিলিয়ে ‘ব্রহ্মাস এনজি’ হবে খুব স্লিম অথচ কাজ আগের মতোই করবে। শোনা যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যে এটা প্রস্তুত হয়ে যাবে।
আরও একটা উচ্চাকাঙক্ষী প্রজেক্ট হচ্ছে ‘ব্রহ্মস-২’। ২০১৬ সালে ঠিক হয় যে ব্রহ্মসের গতি ও পাল্লা আরও বাড়াতে হবে। সেই মতো ঠিক হয় এর গতি হবে শব্দের ৮ গুণ বেশি অর্থাৎ ২.৭ কিমি প্রতি সেকেন্ড। এর পাল্লা হবে ১০০০ কিমি, যা পরে বাড়িয়ে ১৫০০ কিমি করাই লক্ষ্য। গতিতে এর ধারেকাছে কোনও দেশের মিসাইল ঘেঁষতে পারবে না। তবে এটা সম্পূর্ণ হতে আরও কয়েক বছর লাগবে।
জানা যাচ্ছে, এক একটা ব্রহ্মসের দাম পড়ে কমবেশি ৩০ কোটি থেকে ৪২ কোটি টাকা । অনেক দেশের মিসাইল এর থেকে সস্তায় পাওয়া যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা পাওয়ার জন্য বেশ কিছু দেশের আগ্রহ দেখার মতো, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যারা ‘আসিয়ান’ নামে পরিচিত। ব্রহ্মসের গুণাবলী ও কার্যক্ষমতা এদের আকর্ষিত করেছে। এই দেশগুলো দক্ষিণ চিন সাগরের কাছে অবস্থিত। আর ভারতের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ এই এলাকাটা নিজেদের দাবি করে নানারকম অবাঞ্ছিত কার্যকলাপ করে চলেছে। এই কারণে আসিয়ান দেশগুলো ব্রহ্মস মোতায়েন করে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করতে চায়। ধারণা করা হচ্ছে ব্রহ্মস খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে।
আসিয়ান বন্ধু দেশগুলোর কাছে ব্রহ্মস বিক্রি করা ভারতের কাছে এক ঢিলে অনেক পাখি মারার সুযোগ এনে দিতে পারে। কিন্তু কী সেই সুযোগ ?
এটা বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে ভারত। ভবিষ্যতে ওই বন্ধুদেশগুলোকে নিয়ে একটা জোট তৈরি হলে ভারতের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের ওপর চাপ বাড়বে। ভারতের বৃহৎ প্রতিবেশীর বেশিরভাগ জ্বালানি তেল ও অন্যান্য সামগ্রী আসে দক্ষিণ চিন সাগরের উপর দিয়ে। হিমালয়ের দিকে তাদের উৎপাত ক্রমাগত বাড়তে থাকলে ভারতও বন্ধুদের সাহায্যে ওই দক্ষিণ-চিন সাগরের রাস্তা অবরুদ্ধ করে দিতে পারবে। এইসব নানা কারণে ব্রহ্মস মিসাইলকে ভারতের জন্য ‘গেম চেঞ্জার’ বলা হচ্ছে।