১৯৭২ সালের ৩ মে শান্তিপুর শহরের অনতিদূরে কন্দখোলা গ্রামের কাছে গ্রীষ্মের ভরদুপুরে ঘনজঙ্গলে ঘেরা আমবাগানের ভিতর পুলিশ, সিআরপিএফ ও অ্যান্টিনকশাল বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে শহিদ হন ৪জন নকশালপন্থী নেতা ও কর্মী। অজয় ভট্টাচার্য, কালাচাঁদ দালাল, এবং তাদের দুই সহযোগী মধুসূদন চ্যাটার্জি ও শম্ভু সরকার। প্রবীণদের স্মৃতিভাষ্যে ধরা পড়ে সেদিনের ঘটনা। গোটা শান্তিপুরে জারি হয়েছিল কার্ফু, বিবিসি লন্ডন রাত্রিবেলায় প্রথম তাঁদের মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আনে। চার জনের মৃত ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহ পশু বধের মতো করে সেদিন শান্তিপুর থানার মাঠে ফেলে রাখা হয়েছিল! হাতে গোনা দু’একজন বামপন্থী ছাড়া কেউ তাঁদের মৃতদেহে মালা দেওয়ার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারেনি! কিন্তু প্রকৃতি যেন আপন খেয়ালে তার সন্তানদের বরণ করে নিয়েছিল। থানার মাঠের বকুল গাছ থেকে ফুল টপ টপ করে ঝরে পড়েছিল বুলেটে ও বেয়নেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ক্ষত স্থানে।
প্রতিবছর এই দিনটি শহিদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে শহিদ স্মৃতি রক্ষা সমিতি, শান্তিপুর। এই রক্তাক্ত ৩ মে ভুলতে পারে না শান্তিপুরের মানুষ। লাইব্রেরি থেকে চায়ের দোকান, রোয়াকের আড্ডা সর্বত্রই আজও অজয় ভট্টাচার্যদের নিয়ে আলোচনা শোনা যায়।
এ বছরও ৩ মে শান্তিপুর কাশ্যপ মোড়ে শহিদ অজয় ভট্টাচার্যের মূর্তি ও শান্তিপুরে নকশালপন্থী শহিদদের উদ্দেশে স্থাপিত শহিদ বেদীতে মাল্যদান, কবিতা পাঠ, গান ও বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিভিন্ন শহিদদের পরিবার, বাম ও নকশালপন্থী নেতৃত্ব এবং এলাকার বিশিষ্ট নাগরিক।
এদিন বাম ঐক্য সুদৃঢ় করার ডাক দেওয়ার পাশাপাশি পহেলগামকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ উন্মাদনার তীব্র বিরোধিতা করা হয়। বক্তব্যে উঠে আসে, পহেলগামের ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যেভাবে প্রতিশোধের হুমকি উঠছে বা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব দেখা যাচ্ছে, তাতে দেশের আরো বড় ক্ষতি হবে। কারণ মানুষ যখন চায় খাদ্য, বস্ত্র তখনই সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য! যে কোনও পক্ষের যুদ্ধ জিগিরের বিরোধিতা করতে হবে। দুই প্রতিবেশী দেশের যুদ্ধ হলে ফল হবে মারাত্মক। এমনিতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দেশে দিনে দিনে বাড়ছে। ক্ষুধার সূচকে ভারতের স্থান একেবারে নিচের দিকে। শহিদ স্মৃতিরক্ষা সমিতি প্রয়োজনে মিছিল করবে যুদ্ধ উন্মাদনার বিরুদ্ধে। আর একজন মানুষকেও হারাতে চাই না আমরা”।
সিপিআই নেতা তপন কর্মকার বলেন, “নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রাম কোনও হটকারী আন্দোলন ছিল না। তখন রাজ্যে ক্ষমতায় যুক্ত ফ্রন্ট সরকার। কৃষকরা জোতদারদের সিলিং বহির্ভূত খাস জমি দখল করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মহিলা, শিশু সহ ১১ জন মারা যান। এরপরই গোটা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আজকে পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরি।” শহিদ কালাচাঁদ দালালের মেয়ের হৃদয় বিদারক বক্তব্যে সকলের চোখে জল চলে আসে। তখন তার বয়স ছিল দুই বছর। সে কখনোই বাবা বলে ডাকার সুযোগ পায়নি! স্কুলে কোনোদিনও বাবার হাত ধরে যেতে পারেনি! শহিদ মহীউদ্দিনের পরিবারের ছোট্ট সদস্য মাহির রহমানের কন্ঠে শোনা গেল, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেলে কররে লোপাট…’।
পাঁচের দশক থেকে কমিউনিস্ট পার্টির মাটি তৈরি করতে শান্তিপুরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন গণনাট্য আন্দোলনের পুরোধা অজয় ভট্টাচার্য এবং গণসংগীত শিল্পী কালাচাঁদ দালাল। ১৯৬৬ সালে খাদ্য আন্দোলনে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৬৫ সালে অজয় ভট্টাচার্যের পাশাপাশি কালাচাঁদ দালাল সর্বোচ্চ ভোটে জিতে শান্তিপুর পুরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। কিন্তু নকশালবাড়ির বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের ডাকে সাড়া দিয়ে শান্তিপুরে নকশালপন্হী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন ও ১৯৭২ সালের ৩ মে শহিদ হন। এদিন বামপন্থী আরসিপিআই নেতা অভিজিৎ চক্রবর্তী মাল্যদানে অংশ নিলেও সিপিএমের কাউকে দেখা যায়নি।