।। পর্ব – ৪ ।।
ঋষি কশ্যপের দুই স্ত্রী; কদ্রু ও বিনতা। কদ্রু হলেন নাগদের জননী। আর বিনতার দুই পুত্র অরুণ ও গরুড়। বিনতা দুটি ডিম প্রসব করেছিলেন। ডিম ফুটে বাচ্চা হচ্ছে না বলে বিনতা একটি ডিম বিদীর্ণ করে ফেলেন। সেই ডিম থেকে নিম্নাঙ্গবিহীন শিশুর জন্ম। উরুহীন বলে তার নাম হয় অন্বরু বা অরুণ। অরুণ সূর্যের রথের সারাথি হিসাবে নিযুক্ত হন। শতবৎসর পর অন্য ডিম থেকে গরুড়ের জন্ম হয়। যিনি পরবর্তীকালে বিষ্ণুর বাহন এবং পক্ষীকূলের অধিপতি হন।
সমুদ্র মন্থনে উত্থিত ইন্দ্রের অশ্ব উচ্চৈঃশ্রবার রং কি, এই নিয়ে একদিন কদ্রু ও বিনতার মধ্যে তর্ক হয়। বিনতা বলেন উচ্চেঃশ্রবার বর্ণ সাদা, আর কদ্রু বলেন লেজের রং কালো। তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে বাজি হয়, যার কথা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে, সে সতীনের দাসীগিরি করবে। কদ্রু জানতেন উচ্চৈঃশ্রবার রং সাদা। তাই তিনি তাঁর পুত্রদের ডেকে বললেন, তোমরা উচ্চৈঃশ্রবার লেজে গিয়ে লেগে থাকবে, যাতে উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়ার লেজের রং কালো দেখায়। পর দিন গিয়ে দেখা যায় লেজের রং কালো। বাজির কথা মতো বিনতাকে কদ্রুর দাসী হতে হয়েছিল।
গরুড় বড় হয়ে তার সৎ ভাইদের কাছে জানতে চাইল, কী করলে আমার মাকে তোমরা দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবে। সাপেরা বলল, তুমি যদি স্বর্গ থেকে অমৃত এনে দিতে পার, তাহলে তোমার মাকে মুক্তি দেব।
গরুড় স্বর্গে অমৃত আনতে গেলেন। অমৃতের রক্ষক ছিলেন বিশ্বকর্মা। গরুড় তাঁকে যুদ্ধে আহত করলেন। ইন্দ্রসহ দেবতারাও গরুড়ের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হলেন। গরুড় অমৃত নিয়ে আকাশে এসে বিষ্ণুর দেখা পেলেন। গরুড় অমৃত পানের লোভ সংবরণ করেছেন দেখে, বিষ্ণু খুশি হয়ে গরুড়কে বর দিতে চাইলেন। গরুড় বললেন, আমি যেন তোমার উপরে থাকতে পারি এবং অমৃত পান না করেই অমর হতে পারি। বিষ্ণু বললেন, তাই হবে।
গরুড় বললেন, ভগবান তুমিও আমার কাছে বর চাও। বিষ্ণু বললেন, তুমি আমার বাহন হও, আমার রথ ধ্বজের উপরেও থেকো। গরুড়ও তাই হবে বলে এগিয়ে চললেন।
যাত্রাপথে ইন্দ্র বজ্রাঘাতে গরুড়কে কব্জা করতে না পেরে, গরুড়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেন। ইন্দ্র বললেন, এই অমৃত যাদের দেবে তারাই আমাদের উপর উপদ্রব করবে। যদি তোমার এই অমৃতে প্রয়োজন না থাকে তাহলে ফিরিয়ে দাও।
গরুড় বললেন, আমি বিশেষ উদ্দেশ্যে অমৃত নিয়ে যাচ্ছি। যেখানে আমি অমৃত রাখব, সেখান থেকে তুমি অমৃত হরণ কোরো।
গরুড় গিয়ে অমৃত কুশের ওপর রেখে নাগদের বললেন, ‘তোমরা স্নান করে এসে অমৃত খেয়ো।’
সাপেরা বিনতাকে মুক্ত করে দিয়ে স্নান করতে গেল। সেই অবসরে ইন্দ্র এসে অমৃত হরণ করলেন। সাপের দল ফিরে এসে কাড়াকাড়ি করে অমৃত খেতে গেল। অমৃত না পেয়ে কুশ চাটতে লাগল। এর ফলে সাপেদের জিহ্বা চিড়ে গেল। সেই থেকে সাপেদের জিভ দ্বিধা বিভক্ত।
মৎস্য পুরাণেও সমুদ্রমন্থন ও অমৃত উত্থান নিয়ে বিশদে বলা আছে। ভৃগুর পুত্র শুক্রাচার্য ছিলেন দৈত্যদের গুরুদেব। তিনি মহাদেবের কাছ থেকে সঞ্জীবনী মন্ত্র লাভ করেছিলেন। শুক্রাচার্য সেই মন্ত্র দিয়ে মৃত দৈত্যদের পুনর্জীবিত করে দিতেন। ফলে দেবাসুরের যুদ্ধে অসুরা জয়লাভ করছিল। তখন দেবতারা দল বেঁধে ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন, তোমরা দানবদের সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন করে, ক্ষীরসমুদ্র মন্থন করে, অমৃত আহরণ কর। এ ব্যাপারে মন্দর পর্বতকে মন্থন দণ্ড এবং শেষনাগকে তার বেষ্টন করতে হবে।
সমুদ্র মন্থনের ফলে প্রথমে চন্দ্র উদ্ভুত হলেন। তারপর লক্ষী, সুরাদেবী, কৌস্তুভ মনি, পারিজাত বৃক্ষ উত্থিত হল। তারপর উৎপন্ন হল কালানল। সেখান থেকে উৎপন্ন হল–সর্প, মশক, ভ্রমর, মক্ষিকা, পতঙ্গ, কৃকলাস সহ নানাবিদ ভয়ঙ্কর প্রাণী। তারপর উৎপন্ন হল–শার্ঙ্গ (বিষ্ণুর ধনু), হলাহল, মুস্ত, বৎস, কুঙ্গুরু, ভস্মগ নামক শত শত বিষ। তার মধ্যে দেখা গেল এক উগ্রনেত্র ভীষণ মূর্তি, যার নাম কালকূট। কালকূট বলল, হয় আমাকে খেয়ে ফেল, না হলে আমি তোমাদের গ্রাস করব, অথবা তোমরা শংকরের কাছে যাও।
তখন দেবাসুর মহাদেবের কাছে গেলেন। সব শুনে শিব সমুদ্রের ধারে এসে বাম হাত দিয়ে সব বিষ পান করলেন। শিব নীলকন্ঠ হলেন। আবার মন্থন শুরু হলে উঠে এলেন আয়ুর্বেদ প্রণেতা ভগবান ধন্বন্তরি। একহাতে শ্বেত কমণ্ডলু, অপর হাতে অমৃত ভাণ্ড। তারপর অমৃত ভাণ্ড নিয়ে কাড়াকাড়ি। বিষ্ণুর মোহিনী রূপ ধারণ, ছল করে দেবতাদের অমৃত পান, রাহুর ছদ্মবেশে অমৃত ভক্ষণ, বিষ্ণু কর্তৃক মস্তক ছেদন, রাহুর সূর্য-চন্দ্রের প্রতি বৈরিতা। দেবতাদের কাছে দানবদের শোচনীয় পরাজয়।
একটা প্রশ্ন জাগে, তখন কি শুক্রাচার্যের সঞ্জীবনী মন্ত্র কাজ করেনি? এর উত্তর মৎস পুরাণে নেই!
পদ্মপুরাণে সৃষ্টি খণ্ডে অমৃত উৎপত্তির কাহিনী আছে। এখানে বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতপুরাণে মতো দুর্বাসার শাপে ইন্দ্রের ত্রিলোক লক্ষ্মীভ্রষ্ট হয়। সেই সুযোগে দৈত্যরা দেবতাদের আক্রমণ করে পরাজিত করে। দেবতারা পিতামহ ব্রহ্মার কাছে যান। ব্রহ্মা সবাইকে নিয়ে ক্ষীরোদ সাগরের উত্তর কূলে গেলেন। সেখানে বিষ্ণুকে বললেন, “হে বিষ্ণো। শীঘ্র গাত্রোত্থান করুন। দেবগনের হৃতকার্য সাধন করুন। আপনার অনুপস্থিতিতে দানবেরা দেবতাদের বারবার পরাজিত করছে।”
তখন বিষ্ণু ক্ষীরাব্ধি মধ্যে সমস্ত ওষধি ফেলে মন্দরকে মন্থন দণ্ড এবং বাসুকিকে রজ্জু করে দৈত্যদের নিয়ে অমৃত মন্থনের কথা বললেন। ক্ষীর সাগর মন্থনে প্রথমে হবির্দানী সুরভি উৎপন্ন হয়। তারপর বারুণী দেবী আবির্ভূত হন।
দেবতারা বারুণীকে অশুচি মনে করে গ্রহণ করেননি। তখন দৈত্যগণ বারুণীকে গ্রহণ করেন। গ্রহণের পর তিনি সুরা নামে পরিচিত হলেন। তারপর ৬০ কোটি অপ্সরা উৎপন্ন হল। এই অপ্সরারা পুণ্যকর্মফলে দেব ও দানব সকলের সমান উপভোগ্যা হলেন। তারপর চাঁদ উৎপন্ন হল। শংকর দেব তাঁকে চেয়ে নিলেন। তারপর ভয়ংকর বিষ কালকূট; মহাদেব সেই বিষ গ্রহণ করলেন, ফলে তার কন্ঠ নীল বর্ণ হল। তিনি তখন থেকে নীলকণ্ঠ-মহেশ্বর নামে পরিচিত হলেন। মহেশের কালকূট পানের পর অবশিষ্ট বিষ নাগগণ পান করল। তারপর শ্বেতাম্বর পরিহিত বৈদ্যরাজ ধন্বন্তরি অমৃতপুর্ণ কমণ্ডলু নিয়ে উস্থিত হলেন। তারপর উচ্চৈঃশ্রবা নামে অশ্ব এবং ঐরাবত নামক গজ উৎপন্ন হল। তারপর প্রস্ফুটি পদ্মের ওপর হাতে পদ্মফুল নিয়ে শ্রীদেবী উত্থিতা হলেন। সকলেই সেই কন্যারূপিনী কমলাকে প্রার্থনা করলেন। ব্রহ্মা বললেন, “হে বাসুদেব। আমি এই কন্যা তোমাকেই দান করলাম, তুমি একে গ্রহণ কর। আমি তোমার লোভহীন কর্ম দেখে তুষ্ট হয়েছি।”
ব্রহ্মা শ্রীদেবীকে বললেন, “দেবী! তুমি কেশবের অনুগামিনী হও। আমি তোমাকে এই পতি দান করিলাম।”
তখন লক্ষী হরির বক্ষস্থলে আশ্রয় করলেন। বিষ্ণুর বক্ষস্থলস্থিতা হয়ে লক্ষী দেবগনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। তার দৃষ্টিপাত মাত্র দেবগন আনন্দিত হলেন। তখন দৈত্যগণ ধন্বন্তরীর হাত থেকে অমৃত ভাণ্ড কেড়ে নিলেন। তারপর বিষ্ণুর মোহময়ী নারীর রূপ ধারণ অমৃত কমন্ডলু গ্রহণ, দানবদের বঞ্চিত করে দেবতাদের অমৃত পান করানো, দেবতাগণ বলশালী হয়ে দানবদের ওপর বিজয় লাভ। ত্রিলোক বিষ্ণু পালিত হয়ে শ্রীসম্পন্ন হয়ে উঠল।
ব্রম্মবৈবর্তপুরাণে প্রকৃতি খণ্ডে সমুদ্রমন্থনের কথা আছে। সেখানে ক্ষীরসমুদ্র মন্থনে ধন্বন্তরি, সুধা, উচ্চৈঃশ্রবা, ঐরাবত, সুদর্শন চক্র ও কমলার উদ্ভব হয়। এখানে দুর্বাসা ইন্দ্রকে পারিজাত ফুল দিলে, ইন্দ্র তা হাতির মাথায় দিয়ে দেয়, তা দেখে দুর্বাসার রাগ হয়। তারপর দুর্বাসার শাপে লক্ষ্মীর স্বর্গত্যাগ করে বৈকুন্ঠ গমন। তারপর বিষ্ণুর পরামর্শে সমুদ্রমন্থন। কিন্তু এখানে শুধু দেবতারা সমুদ্রমন্থন করেছিলেন।
পুরাণে আরেক ভাবে অমৃত উৎপত্তির কথা আছে। তা হল পৃৃথু কর্তৃক পৃথিবী দোহনের ব্যবস্থাপনার পর অমৃত উৎপাদন। সে কাহিনী পরের পর্বে…
[ক্রমশ]