• facebook
  • twitter
Thursday, 13 February, 2025

মেলার পার্বণ

পার্বণ মানে ‘পর্ব সম্মন্ধীয়’ বা ‘উৎসব’। পার্বণ কথাটা এসেছে ‘পর্ব’ শব্দ থেকে। পর্ব মানেও উৎসব। ‘পালপার্বণ’ মানে উৎসব দিবস। আমাদের বাংলায় গোটা শীতকালটা উৎসব মুখর। এই উৎসবের প্রধান অঙ্গ মেলা। এই সময় বঙ্গদেশে এত মেলা হয় যে, শীতকালটাকে মনে হয় মেলার পার্বণ। শীতকালের বিভিন্ন মেলার হদিস দিয়েছেন সুখেন্দু হীরা।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় সবং থানায় অধীন দশগ্রামে মকর সংক্রান্তি শুরু হয় তৃলসী চারা মেলা। এখানে কেলেঘাই নদী থেকে মুঠো ভরে মাটি তুলে গোকুলানন্দ বাবাজির সমাধিতে দেয়। এই মাটি জমে পাহাড়ের মতো হয়ে যায়। এই মেলা চলে সাতদিন। এদিন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন থানার শরশঙ্কা দিঘির ধারে মকর সংক্রান্তি মেলা হয়। এই মেলা এখন তিন দিন চলে।

পয়লা মাঘের মেলা মকর সংক্রান্তির মেলার সংখ্যাকে হারিয়ে দেবে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ১লা মাঘের কয়েকটা বিখ্যাত মেলা হল–বারুইপুর থানার অন্তর্গত ধবধবিতে ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায়ের জাঁতাল পুজো উপলক্ষে মেলা। নরেন্দ্রপুর থানার অধীনে বারুইপুর বাইপাসের ধারে রামচন্দ্রপুর গ্রামে রক্তান গাজীর মেলা, মন্দির বাজার থানা এলাকায় দক্ষিণ বিষ্ণুপুরের ভাঙ্গা মেলা। যদিও অফিসিয়ালি ঘোষণা করা হয় ‘পৌষ সংক্রান্তি উৎসব’। তবে মেলা শুরু হয় পয়লা মাঘ। কুলতলী থানা এলাকার সানকিজাহান কলোনিতে গঙ্গামেলা। এই মেলাটা শুরু হয়েছে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে।

বীরভূমের পয়লা ভাগের বিখ্যাত মেলাগুলো হল রামপুরহাট শহরের গা ঘেঁষে বুংকাতলা কালীমেলা, মল্লারপুর থানার শিবগ্রামে ঢেলাইচণ্ডী মেলা, ময়ূরেশ্বর থানার ঢেকা গ্রামে ব্রহ্মদৈত্য মেলা।

হাওড়া জেলার পয়লা মাঘের মেলা গুলো হল আমতা থানার চন্দ্রপুর গ্রামের ‘মাদার শাহের মেলা’, আমতা কোটালপাড়া গ্রামে পঞ্চানন্দ-পীরের মেলা। নিম গাছের নীচে বাবা পঞ্চানন্দ ও পীর বাবার পাশাপাশি অবস্থান। উদয়নারায়নপুরের সিংটি গ্রামে ভাই খাঁয়ের মেলা। যে মেলার আলুর দম ও কাঁকড়া বিখ্যাত। ফাঁকা মাঠের মধ্যে ভাই খাঁয়ের মাজার, তাকে ঘিরে মেলা। উলুবেরিয়া বর্তমান রাজাপুর থানার অধীন বানিবনের ‘জঙ্গলবিলাস পীরের মেলা’।

বাঁকুড়া জেলার পয়লা মাঘের বিখ্যাত মেলাগুলো হল রানিবাঁধ থানা এলাকার ভুরকুড়া গ্রামে বামনি সিনির মেলা। এটা পাহাড় পূজা উপলক্ষে মেলা। এই থানায় এলাকার ধডাঙ্গা গ্রামে পার্বতীপূজা উপলক্ষে ‘কাঁড়াকাটা মেলা’। আগে এই মেলায় মহিষ বলি দেয়া হত, তাই এর নাম কাঁড়াকাটা মেলা। ইন্দপুরের থানার হরিরামপুর গ্রামে নাগরদোলামেলা, বারবেন্দ্যা গ্রামে চণ্ডীমেলা। বড়জোড়ার গদারডিহিতে পীরপুকুরের মেলা হয় দু’দিন। পৌষ সংক্রান্তিতে হিন্দুরা, পয়লা মাঘে মুসলিমরা জড়ো হয়। এই মেলার প্রধান আকর্ষণ শাকালু, প্রচুর শাকালু বিক্রি হয়।
এইসব ছাপিয়ে শীতকালে যে মেলার নাম সবার ওপরে উঠে আসে তা হল শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা। সেটা হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন পৌষ মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ ও নাগরিক মিলন। মেলা শুরু হয় সাতই পৌষ। আগে সরকারিভাবে তিন দিন মেলা চলত। শেষ দিন আতশবাজি প্রদর্শন। ভাঙ্গা মেলা চলত আরও কয়েকদিন।

এই সময় সমস্ত স্কুলে শীতের ছুটি পড়ে যায়। প্রতি পরিবারে পর্যটনের হিড়িক পড়ে যায়। তাই পৌষমেলার সময় বোলপুর শান্তিনিকেতনে ঠাঁই মেলা ভার হয়। আমি ভাবতাম এই সময় বাংলায় আরও কয়েকটি জায়গায় এরকম মেলা হলে, তাহলে ভিড় কিছুটা ভাগাভাগি হয়ে যেত। সেই কাজটা কিছুটা করেছে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর। বিষ্ণুপুর মেলা শুরু হয়েছিল পৌষ মেলার অনুকরণে। শুরু দিন একই সাতই পৌষ। শুরু ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে। বাঁকুড়ার লোকশিল্পের পসরা ও বাঁকুড়ার বাইরের পর্যটকদের মেলবন্ধন এই মেলার সবচেয়ে ভালো দিক।

এই সময়ে অর্থাৎ ইংরাজি বছরের শেষ দিকে আরো কয়েকটি মেলা হয় বিভিন্ন জেলায়, যা খুব জনপ্রিয়। পুরুলিয়া জেলায় রঘুনাথপুর থানা এলাকার জয়চণ্ডী পাহাড়ের তলায় ‘জয়চণ্ডী পর্যটন উৎসব’, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থানার অধীন পিয়ারডোবাতে ‘ভগবতী মেলা’, পূর্ব বর্ধমান জেলায় পূর্বস্থলীতে ‘চুনোপুঁটি উৎসব’।

এছাড়া খ্রিষ্টধর্ম অধ্যুষিত অঞ্চলে কতকগুলি খ্রিষ্টমেলা হয়। নদীয়া জেলাতে এর আধিক্য বেশি। সবচেয়ে আগে নাম করতে হয় ‘চাপড়া’ গ্রামের কথা। চাপড়ায় প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের মাঠে জমে ওঠে খ্রিষ্টীয় মেলা ২৬ শে ডিসেম্বর থেকে পয়লা জানুয়ারি। জেলা সদর কৃষ্ণনগরে ক্যাথিলিক চার্চের কাছে বসে মেলা। রানাঘাটে ক্যাথলিক চার্চের উল্টোদিকে বেগোপাড়া রোডে এই সময় মেলা হয়।

হুগলীর ব্যান্ডেল চার্চের সামনে ২৪ শে ডিসেম্বর থেকে ১লা জানুয়ারি মেলা বসে। ব্যান্ডেল ২৫ শেষ ডিসেম্বর ও পয়লা জানুয়ারি বন্ধ থাকে।
চন্দননগরে পবিত্র হৃদয় গির্জার সামনে ছোটোখাটো মেলা বসে, শ্রীরামপুর সেন্ট ওলফ চার্চের প্রাঙ্গণে ২৪- ২৬ ডিসেম্বর কিছু দোকানপাট নিয়ে বসেন খ্রিষ্টধর্মীয় ব্যক্তিরা।

ব্যান্ডেলে পর্তুগিজ চার্চ, চন্দননগর ছিল ফরাসী উপনিবেশ, শ্রীরামপুরে ডাচদের। সব জায়গা আলোকমালায় সজ্জিত হয়ে ওঠে।
পশ্চিম মেদিনীপুরে মেদিনীপুর শহরে আছে নির্মল হৃদয় আশ্রম। এখানের প্রাঙ্গণে ২৫ শে ডিসেম্বর থেকে পয়লা জানুয়ারি পর্যন্ত হয় ‘চার্চ মেলা’। ভীষণ জনপ্রিয় এই মেলা। প্রচুর ভিড় হয় এই মেলাতে।

এবছর প্রতিটি জেলায় সরকারি উদ্যোগে ‘ক্রিশমাস কার্নিভাল’ আয়োজিত হয়েছে। তাই শুধু কলকাতার পার্ক স্ট্রিট নয়, জেলায় প্রধান প্রধান রাজপথ আলোক মালায় আলোকিত হয়ে উঠেছে। মানুষ মেতে উঠেছে উৎসবে।

দক্ষিণেশ্বরের কল্পতরু মেলার নামে একটি কল্পতরু মেলা হয় দুর্গাপুরে, কোকওভেন থানার অধীনে। মেলার মাঠের মানেই হয়ে গেছে কল্পতরু মেলার মাঠ। পয়লা জানুয়ারি থেকে শুরু, দশদিনের মেলা।

আর একটি জনপ্রিয় ‘লোক উৎসব’ মেলা হয় উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার হাবড়া থানার অধীন ‘বাণীপুর লোক উৎসব’। আগে ডিসেম্বরে হত, তারপরে ফেব্রুয়ারিতে। এখন জানুয়ারির প্রথম দিকে হয়। প্রচুর দোকান, নাগরদোলা, লোকশিল্প, এমন কী বাংলাদেশ থেকে পিঠে-পুলির পসরা নিয়ে আসে।

মেলা ঘুরতে যাওয়ার আগে তিনটি কথা মাথায় রাখবেন, এক মেলার সময় ট্যুরিস্ট স্পট গুলোতে থাকার জায়গা পাওয়া যায় না। আর দুই মেলাগুলোতে অত্যাধিক ভিড়। তিন – মেলাতে কেনাকাটার বড় সুযোগ থাকে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতের কাছে মিলে যায়। আবার কোনও কোনও মেলায় জিনিসপত্রের দাম থাকে আকাশ ছোঁয়া। তাই সবদিক খোঁজ খবর নিয়ে ‘শপিং’ করবেন।
এরকমই সব বৈচিত্রপূর্ণ মেলা নিয়ে শীতের সম্ভার। শীতকাল যেন ‘মেলার পার্বণ’। (সমাপ্ত)