অতনু রায়: “কন্টেন্টের দিক থেকে দেখলে সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দেওয়ার পরে কোনো ছবি কেউ আটকাতে পারার কথা নয়। তবে যদি কলাকুশলীরা ফেডারেশনের কাছে প্রযোজনা সংস্থার বিরুদ্ধে টাকা না দেওয়ার অভিযোগ আনে তাহলে ফেডারেশন চাইলে সেই ছবি আটকাতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রযোজক যদি সব দিক থেকে স্বচ্ছ থাকেন তবে তিনি ফেডারেশনের সঙ্গে বসে প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে তাঁর বিরুদ্ধে টাকা না দেওয়ার কোনও অভিযোগ আছে কিনা”, বললেন ভারতীয় সেন্সর বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন পহলাজ নিহালানি। ‘দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ ছবির মুক্তি আটকে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাওয়ায় এই কথা বলেন তিনি।
বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে তোলপাড় সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের ছাত্র জয়ব্রত দাসের ছবি ‘দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ মুক্তি আটকে যাওয়া নিয়ে। এই বিষয় নিয়ে জয়ব্রত এবং ছবির অভিনেতা সৌরভ দাস শুক্রবার সন্ধেয় দেখা করেন ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে।
Advertisement
জয়ব্রতর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “ফেডারেশন সভাপতি প্রযোজক প্রতীক চক্রবর্তীর সঙ্গেই এ বিষয়ে কথা বলতে চান। তবে এটাকে আমরা ডিপ্লোমা ফিল্ম বলছি না একেবারেই। আমরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি হিসেবেই দেখছি। ফলে এই ছবি মুক্তিতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে ইন্ডাস্ট্রির অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আমরা জানতাম না, সত্যি। আমরা নিজেরাই খরচা করে শুট করেছি। পোস্ট প্রোডাকশনে এসে টাকা জোগাড় করতে প্রচুর মানুষের কাছে গেছি, তাতে প্রতীক চক্রবর্তী রাজি হন। তিনি বলেন মূল প্রযোজক হিসেবে তাঁর নাম দিতে হবে, দিয়েছি। ইন্সটিটিউটের ফ্যাকাল্টি এবং ছবির শিল্পীদের থেকেও পরামর্শ নিয়েছিলাম। এত কিছু ঘটবে, বুঝিনি।”
Advertisement
ছবি ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য টাকা দেওয়ার পরেও ছবি মুক্তি আটকে যাওয়া নিয়ে জয়ব্রত বলেন, “আমরা পিভিআর-আইনক্সের পঙ্কজ লাডিয়াকে ছবির ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য ২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা দিয়েছি। আমার বাবার ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে টাকা দিয়েছি। কিন্তু ছবি রিলিজের আগে তাঁর কাছ থেকে মেইল আসে যেখানে ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন (ইম্পা) এবং ফেডারেশনের মেইল অ্যাটাচড্ ছিল। সেখানে বলা হয়েছে ছবিটিকে আটকে দিতে কারণ ‘ডিসপ্যুট’ আছে।”
এই প্রসঙ্গে পঙ্কজ লাডিয়াকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “ডিস্ট্রিবিউটরের কাজ হলমালিকদের ছবিটা চালাতে বলা। এবারে ইউএফও, কিউব সহ যারা সার্ভিস প্রোভাইডার তাদের প্রত্যেকের কাছেই চিঠি গেছে। আমার কাছে যা যা তথ্য এসেছিল সেটা আমি প্রতীক চক্রবর্তী সহ ছবির প্রযোজনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদের সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছি। এবারে সেটার যেমন প্রগ্রেস হবে, সেভাবে কাজ এগোবে। আমাদের কাছে এরপরের কোনও আপডেট এসে পৌঁছায়নি।”
ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “জয়ব্রত দাসের সঙ্গে কথা বললে বুঝবেন যে ওঁর সঙ্গে ফেডারেশনের কোনও বিরোধ নেই। ফেডারেশনের বক্তব্য সংশ্লিষ্ট প্রযোজক প্রতীক চক্রবর্তী যেভাবে একটি ছেলেকে সামনে রেখে দ্বিচারিতা করছেন তা নিয়ে। বাংলার বহু শিল্পী ও কলাকুশলীর পারিশ্রমিক বাকি রেখে বহাল তবিয়তে মুম্বইতে বসে থাকেন এই প্রযোজক। একটা সময়ের পরে ফোন ধরাও বন্ধ করে দেন। সম্প্রতি একটি ছবির টেকনিশিয়ানদের দীর্ঘদিনের বকেয়া পারিশ্রমিক অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে আমাদের উদ্ধার করতে হয়েছে। এখন ছবিগুলোর নাম বলতে চাই না তবে ইন্ডাস্ট্রির দেওয়ালে কান পাতলে আরও অনেক ছবির ‘বাকি ইতিহাস’ আপনারা পেয়ে যাবেন। এবারে তিনি একজন ছাত্রের কাঁধে বন্দুক রেখে প্রায় জলের দরে নিজের প্রযোজনার একটা ছবি বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। একদল ছাত্রকে ‘ইমোশনালি এক্সপ্লয়েট’ করেছেন, বলাই বাহুল্য। আজ যদি প্রতীক চক্রবর্তীর মতো একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, কাল থেকে এটাই দস্তুর হয়ে যাবে। তাহলে তো আর ফেডারেশন, গিল্ড কিছুরই দরকার নেই! আমাদের একটাই বক্তব্য, প্রযোজনা সংস্থা প্রমোদ ফিল্মসের প্রতীক চক্রবর্তী সরাসরি এসে কথা বললেই সমাধান সূত্র বেরোবে। এই ছবি নিয়ে পরিচালক বা শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলার কিছু নেই। আর একটা কথা উঠছে, বলা হচ্ছে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়া ছবি কেউ আটকাতে পারে না। আমি একটা জবাব দিতে চাই। সেন্সর বোর্ড একটা ছবির কনটেন্টকে ছাড়পত্র দিয়েছে আর ফেডারেশন কনটেন্ট নিয়ে কোনও কথাই বলেনি।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবির অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ লিখেছেন, “সিনেমা প্রদর্শনকারী সংস্থা কোন আইনে চুক্তি হওয়া সিনেমার রিলিজ বন্ধ করতে পারেন? উত্তর হল সবটাই বেআইনি গা জোয়ারি পদ্ধতি। ছাত্ররা নিজেদের ধার করা ও জোগাড় করা পয়সায় এই সিনেমাটি কষ্ট করে বানিয়েছেন।শিল্পীরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। আর আপনি শুধু এক পক্ষের কষ্ট দেখছেন? প্রযোজক পরিচালক শিল্পীরা মানুষ নয়। মানুষ সবাই। কষ্ট সবারই সমান।”
রুদ্রনীলের নাম না করেই ফেডারেশন সভাপতির খোঁচা, “যে শিল্পী সোশ্যাল মিডিয়াতে এত কথা লিখছেন তিনি কি ফেডারেশনের হাজার হাজার কলাকুশলী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? যাঁরা বড় গাড়িতে করে প্রিমিয়ারে সিনেমা দেখতে যান তাঁরা কি সিনেমার জন্য রক্ত-ঘাম ঝরায় যে টেকনিশিয়ানরা, তাঁদের জীবনটা কীভাবে চলে জানেন? যাঁরা পরিচালক আর প্রযোজকদের জন্য এত গলা ফাটাচ্ছেন তাঁরা কখনো সুযোগ পেলে টেকনিশিয়ানদের নিয়েও একটা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট করুন। আপনাদের বাড়িরও কেউ একজন পরবর্তীকালে কখনও কলাকুশলী হতে পারেন। তাঁদের সঙ্গে যে প্রতারণা-বঞ্চনা হয় সেটাও একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আজ কোনও টেকনিশিয়ান কাজ করতে করতে অসুস্থ হলে বা দুর্ঘটনা ঘটে কর্মক্ষমতা হারালে কোনও শিল্পীই এগিয়ে আসেন না। তখন ফেডারেশনকেই দায়ভার বহন করতে হয়। তাঁরা যদি কাজ থেকে বসে পড়ে, তাঁদের সংসার চালানোর দায়িত্ব কি কোনও সোশ্যাল মিডিয়া বিপ্লবী নেবেন?”
ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি জয় চন্দ্র চন্দ্র নাম না করেই একহাত নেন রুদ্রনীলকে। তিনি বলেন, “ছবির একজন অভিনেতা খুব সুন্দর করে ফেসবুকে একটা পোস্ট করেছেন দেখলাম। তাঁকে আমি অনুরোধ করব যে, ক্যামেলিয়া প্রযোজনা সংস্থা অনেকদিন আগে আপনাকে ‘মাতঙ্গী’ সিরিজের জন্য যে অ্যাডভান্স টাকাটা দিয়ে দিয়েছে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সেই সিরিজের টেকনিশিয়ানদের টাকাটা বাকি আছে। সেটা যদি আপনি একটুখানি ক্লিয়ার করেন তাহলে তাঁদের সংসারের অনেকটা সুবিধা হয়। তাঁরা তাঁদের বাচ্চার দুধ জোগাড় করতে পারেন, বাচ্চার স্কুলের টিউশন ফি দিতে পারেন।”
তবে ইন্ডাস্ট্রির অন্দরমহলে কান পাতলে কিন্তু প্রযোজক প্রতীক চক্রবর্তীর নামে একাধিক অভিযোগ উঠে আসছে। শোনা যাচ্ছে, ইন্দ্রাশিস আচার্যের আগামী ছবি ‘গাজনের ধুলোবালি’ শেষ না হওয়ার পিছনে তাঁরই নাম। ছবির সঙ্গে যুক্ত এক শিল্পী জানালেন, ইন্দ্রাশিস নিজে নাকি এই ছবির কাজের জন্য সাড়ে সাত লক্ষ টাকা খরচ করেছেন এবং সেই টাকা এখনও ফেরত পাননি। ঋত্বিক চক্রবর্তী এবং পাওলি দামকে নিয়ে পৃথা চক্রবর্তীর ‘পাহাড়গঞ্জ হল্ট’ ছবিটাও এখনও শেষ করেননি প্রতীক। ইন্দ্রাশিস এবং পৃথা দুজনকেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে শোনা যাচ্ছে যে পৃথার ছবির এইচওডি এবং শিল্পীদের অনেকেই এখনো টাকা পাননি। আশ্চর্যের ব্যাপার, দুটো ছবি মাঝপথে বন্ধ রেখে রামকমল মুখোপাধ্যায়ের মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘লক্ষীকান্তপুর লোকাল’ ছবির সহ-প্রযোজনা করেছেন প্রতীক। এমনকি, পরিচালক-অভিনেতা অঞ্জন দত্ত’র পরিচালনার ছবির নিয়েও প্রমোদ ফিল্মসের প্রতীকের আর্থিক অসঙ্গতির কথা সামনে আসছে।
Advertisement



