ভারতীয় ছবিতে গল্প বলার ‘রেনেসাঁ’

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

অতনু রায়

ভারতীয় সিনেমা দিক বদলাচ্ছে। বছরখানেক আগে কেবল আভাস হলেও এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এটাই স্টেটমেন্ট। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া দুটো বড় ছবি, অর্থাৎ হৃতিক রোশন ও এনটিআর জুনিয়রের ‘ওয়ার ২’ এবং রজনীকান্ত, নাগার্জুন ও আমির খানের ‘কুলি’ মুখ থুবড়ে পড়েছে। ঘোষণার সময় থেকে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় করে রাখা তারকাখচিত দুটো ছবিই দর্শকদের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। দুটো ছবির বাজেটই ৪০০ কোটির ধারেকাছে। একদিকে ‘ওয়ার ২’-এর ভরাডুবি হয়েছে ক্লিশে, দুর্বল গল্প এবং অতি নিম্নমানের ভিএফএক্স-এর কারণে। অন্যদিকে, ‘কুলি’ টিপিক্যাল ‘মসালা এন্টারটেইনার’ হতে চেয়েও শুধুমাত্র একটা অতিদীর্ঘ ‘ননসেন্স ভিডিও’ হয়ে থেকে গেছে। দুটো ছবিরই অন্যতম শত্রু দৈর্ঘ্য এবং গল্পের গন্তব্যহীনতা। এই ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, ‘কনটেন্ট ইজ দ্য কিং’।

এখন বারবার যে প্রশ্ন উঠছে ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে, এত বড় বড় তারকা নিয়েও ছবি দর্শক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দর্শকদের রুচির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। অনস্বীকার্য। তবে আরেকটা কথা আমি জুড়তে চাইব, সেটা হল দর্শকদের ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ এবং ‘আন্ডার-এস্টিমেট’ করা। দর্শকের প্রায়োরিটি আর তারকা নয়, ভাল গল্প। ভারতীয় ছবির দর্শক এখন অনেক বেশি পরিণত, শুধু নামী মুখ দেখে নিজেদের বুদ্ধি বিসর্জন দিতে আর রাজি নন। তাই এক সময় যা ছিল প্রায় নিশ্চিত সাফল্যের চাবিকাঠি, এখন সেটাই অচল আধুলি!


‘প্যান-ইন্ডিয়া’ ছবির বাড়বাড়ন্ত অনেক অভিনেতাকে তাঁদের আঞ্চলিক সিনেমার ইন্ডাস্ট্রির বাইরে বেরোতে উৎসাহ দিয়েছে বলাই বাহুল্য। তাই ‘ক্রস-ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন’ ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। হয়ত এই জায়গা থেকেই দেশের সবথেকে বড় দুটো ইন্ডাস্ট্রি, বলিউড আর দক্ষিণী ছবির ইন্ডাস্ট্রি একে অপরের হাত ধরে চলতে শুরু করেছে। দুই ইন্ডাস্ট্রির তারকারাই অন্য ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করলেন। বলিউডের তারকারা দক্ষিণ ভারতীয় ছবিতে আর দক্ষিণী তারকারা বলিউডের ছবিতে মুখ দেখাতে থাকলেন। তবে দক্ষিণ ভারতীয় ছবির পরিচালকদের বলিউডে বাজার তৈরি হওয়াটা বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। সেখানে যেমন মনিরত্নম, রামগোপাল ভার্মা, প্রিয়দর্শন আছেন, তেমনই আছেন হালের প্রভুদেবা, সন্দীপ রেড্ডি ভঙ্গা, অ্যাটলি।
‘ক্রস-ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন’ আসলে কেন? উত্তর, বাজার ‘বড়’ করা। আর এইখানেই ‘বড়’ ব্যর্থতা। প্রথমবার দক্ষিণ ভারতীয় ছবিতে আমির খান! তা সত্ত্বেও ‘কুলি’ বলিউডি বাজার ধরতে ব্যর্থ। একই ঘটনা ঘটেছিল সলমন খানের ক্ষেত্রেও। চিরঞ্জীবীর সঙ্গে সলমনের ‘গডফাদার’ বলিউড দর্শকের কাছে হালে পানি পায়নি। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, ‘ওয়ার ২’ ছবিতে এনটিআর জুনিয়র থেকেও পায়নি কাঙ্খিত দক্ষিণী বাজার। উদাহরণ আরও অনেক রয়েছে।

এক সময়ের স্টার ক্যারিশমা’র ঝলমলে জগৎ আজ অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঢাকা। কোভিড-পরবর্তী সময়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের আগ্রাসন এই সমস্যার পালে হাওয়া দিয়েছে এ নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। নেটফ্লিক্স, মুবি সহ অন্যান্য ভিডিও প্ল্যাটফর্মগুলো এখন সাফল্যের চাবিকাঠি হিসাবে আবার কনটেন্টকেই সামনে নিয়ে এসেছে। ফলে শুধুমাত্র নামী তারকারাই সাফল্য এনে দিতে পারেন, এই ধারণা ধুলিসাৎ হয়েছে। এখন ভাল স্ক্রিপ্ট, ছকভাঙা কনসেপ্ট, নির্মেদ গল্প সফল হচ্ছে। ‘লাপতা লেডিজ’, ‘টুয়েলফথ্ ফেল’-এর মতো ছবি প্রমাণ করেছে যে কনটেন্ট তারকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ভাল ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ কনটেন্ট প্রায়ই বড় বাজেটের প্রতিযোগীদের ছাপিয়ে যাচ্ছে।

ভারতীয় ছবির পরিপ্রেক্ষিত ধরলে আমরা এমন এক আশাব্যঞ্জক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেটা আসলে ‘গল্প বলার রেনেসাঁ’ মুহূর্ত। ‘অন্ধাধুন’, ‘স্ত্রী ২’ থেকে ‘সইয়ারা’র মতো ছবি কনটেন্টের কারণেই প্রশংসা এবং বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করেছে। তাই ভবিষ্যতের সিনেমা নিয়ে আলোচনায় ভাল কনটেন্টের জোর অস্বীকার করার উপায় নেই।

তারকাদের জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভরতা কমে যাওয়া যতটা সেই সব তারকাদের জন্য খারাপ ততটাই নতুন প্রতিভাদের জন্য একটা বড় সুযোগ। আশা, নতুন ভাষ্যের ছবি আবার প্রমাণ করে দেবে, দিনের শেষে সিনেমা একটা ‘আর্ট’; অ্যালগরিদম্ নয়।