অতনু রায়
আমরা বারবার বলি বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার কথা। কিন্তু বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয় কীভাবে সেটা খুব কম ক্ষেত্রেই আমরা বুঝতে পারি। তবে কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা জীবনে একই বৃত্ত বারবার নতুন করে সম্পূর্ণ করতে থাকেন। তাঁদের আমরা কিংবদন্তি বলি। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় তেমনই একজন কিংবদন্তি।
কিংবদন্তিদের জীবনে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মিল থাকে। তাঁরা তাঁদের সিংহাসনটা নিজেরা তৈরি করেন। অন্যের তৈরি করা সিংহাসনে বসে কিছুদিন রাজ্য হয়ত চালানো যায়, কিন্তু রাজা হওয়া যায় না। আর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এমন একজন রাজা, যাঁর রাজপাট হারানোর ভয় নেই…সিংহাসন আঁকড়ে থাকার মোহ নেই…অশ্বমেধ যজ্ঞের তাগিদ নেই। তিনি শান্ত, তিনি সবার কথা বলেন, তিনি আর দশজনের মতো সাফল্যে হাসেন। আর সবকিছুর থেকে বেশি, তিনি সিনেমাকে ভালবাসেন।
আজও তাঁর জন্মদিনে অগণিত মানুষ একবার তাঁকে দেখতে আসেন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। এইদিন তাঁর বাড়ির অবারিত দ্বার। কেউ হাতে আঁকা ছবি, কেউ যত্নে সাজানো ফুল আবার কেউ আদর মাখানো কেক নিয়ে সটান উপস্থিত হন বালিগঞ্জ ফাঁড়ির উৎসবে। উৎসবই বটে!
অন্যান্য অনেকবারের জন্মদিনের মতো এবারেও তাঁর ছবি চলছে প্রেক্ষাগৃহে। ‘দেবী চৌধুরানী’। জন্মদিন পালন করলেন সেই মঞ্চে, যা একদিন তাঁকে লালন করেছিল। ওঁকে লালন করা ‘স্টার’ আজ ‘বিনোদিনী’ হয়ে গেছে আর তিনি ‘স্টার’। ফেলে আসা স্টারের নস্ট্যালজিয়ার এক চিলতে তিলক নিজের জন্মদিনে বিনোদিনীর কপালে পরিয়ে দিলেন প্রসেনজিৎ।
স্টারের মঞ্চে ‘সমাধান’ নাটকের ২০০০ রজনী অভিনয় করেছেন প্রবাদপ্রতীম মহেন্দ্র গুপ্ত’র ছাত্র, প্রসেনজিৎ। মহেন্দ্র গুপ্ত আর স্টার থিয়েটার যে অবিচ্ছেদ্য, সে তো সবাই জানেন। ভেবে দেখুন, মঞ্চের আশীর্বাদ তাঁকে যেমন ‘স্টার’ করল তেমনই ‘সমাধান’ শব্দটাকে জুড়ে দিল তাঁর সঙ্গে। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে চলেন বড় দাদার মতো! ওই যে শুরুতেই বলছিলাম না, বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার কথা।
আমরা যারা সিনেমা নিয়ে অল্প হলেও চর্চা করি, হয়ত দিনের শেষে গিয়ে কোনও গল্পই বলতে চাই…বিশ্বাস করি, সিনেমার একজন ঈশ্বর আছেন। তিনি যেমন ঠিক করে দেন কোন চরিত্র আসলে কার কাছে যাবে, তিনিই ঠিক করে নেন তাঁর পুজোর পুরোহিত। আজ যখন শো শুরু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বিনোদিনী থিয়েটারের হল ভর্তি দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বলছিলেন “এই মঞ্চে আমি কত শো করেছি নাটকের”; তখন হয়ত সিনেমার ঈশ্বর অলক্ষ্যে মুচকি হাসেন। হয়ত অস্ফুটে কেউ বলে, যে অতীতকে মনে রাখে – ভবিষ্যৎ তাকেই মনে রাখে।
আজ ২০২৫ সালের পুজোর সময় এসেও বিভিন্ন প্যান্ডেলে মাইকে ‘অমরসঙ্গী’ চলে। আজ তাই যখন দর্শকদের উদ্দেশ্যে তাদের নায়ক বলেন, “আপনারা যাঁরা আমার অমরসঙ্গী তাঁদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পেয়ে কী করে না এসে থাকতে পারি”, তখন সেই মানুষটাকে স্বার্থপর মনে হয় না। মনে হয় না, সবটাই লোক দেখানো। আজ অষ্টমী। মুম্বইতে তাঁর বাবার বাড়িতে পুজো হচ্ছে। স্ত্রী-পুত্রকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কলকাতায় থেকে গেলেন। মনে হতেই পারে, এতে তো ওঁর স্বার্থ জড়িত। নিজের ছবির হল ভিজিটে যেতে হবে বলে থেকে গেছেন। কিন্তু নিজের জন্মদিনে পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারলেন না। যাঁদের কাছে সুযোগ আছে, তাঁরা সব সময় জন্মদিনটা পরিবারের সঙ্গেই কাটাতে চান। তাহলে হিসেবটা কী দাঁড়াল? ‘স্টার’ প্রসেনজিৎ ১০ এ ১০ আর ‘ফ্যামিলি ম্যান’ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ১০ এ ০!
সেই হিসেবটা পুরো উল্টে দিয়ে প্রসেনজিৎ একটু পরেই বলেন, “আমার দর্শকরা, সাংবাদিক ভাই-বোনেরা যারা সারা বছর আমার পাশে থাকে তারাই আমার এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি”। জন্মদিনের সকালে অষ্টমীর অঞ্জলি দিয়ে এসে যখন ঘন্টাখানেক তাদের সঙ্গে কাটিয়ে যান, তখন মনে হয় সত্যিই তিনি এই পরিবারের অভিভাবক। তখন নিজের কথা নিজেকে গিলে ফেলতে হয়, আর বলতে হয়…প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আদ্যন্ত একজন ‘ফ্যামিলি ম্যান’।
শুরুতেই বলছিলাম কিংবদন্তির কথা। কিংবদন্তিরা এখানেই সবার থেকে আলাদা। যে পৃথিবীতে আমরা পরিসর ছোট করতে করতে ‘নিউক্লিয়াস’-এ পৌঁছেছি, সেইখানে এই মানুষটা বছরের পর বছর পরিবার বড় করে চলেছেন!
কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু; তর্কে বহুদূর। এই মানুষটা বিশ্বাস করেছিলেন, তাই মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন। ওঁর হাতে আজও ভীষণ মাটির গন্ধ, ঘামের গন্ধ। বিশ্বাস করুন, আজও এই মানুষটার হাতটা যখন ছুঁয়ে থাকি…ছুঁতে না পারা বাংলা ছবির ইতিহাস ছুয়ে থাকি।
ওঁর কি রাগ নেই? রাগ আছে, ক্ষোভ আছে, অভিমান আছে, অনুযোগ আছে। কিন্তু সেগুলো প্রকাশ হয় না। যেটা প্রকাশ হয়, সেটা হল পাহাড় সমান ‘কনফিডেন্স’। যে কনফিডেন্স জন্মদিনে একজন অভিনেতাকে দিয়ে বলিয়ে নেয়, “আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শুধুমাত্র অভিনয়ের মাধ্যমে আপনাদের আনন্দ দিতে চাই। কারণ, আমি ওই একটাই জিনিস পারি। আর কিছু আমি পারিও না, শিখতেও চাই না।”
একেক সময় নিজের উপর খুব রাগ হয়। পেশাগত এবং সোশ্যাল সফিস্টিকেশনের যুগে এসে সবার সামনে চেচিয়ে অনেক কথাই বলতে পারি না বলে। আজও মুহূর্তে আবেগের বাঁধ ভেঙে তোমাকে সামনে বলা হল না যে কথা, এখানে বলি:
বুম্বাদা! তোমাকে ভীষণ ভীষণ ভালবাসি। তুমি ছিলে, তুমি আছো, তুমিই থাকবে। শুভ জন্মদিন।