ঋত্বিক এক নক্ষত্রের নাম

নিজস্ব চিত্র

সঞ্চিতা সান্যাল

ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে প্রতি মুহূর্তে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব, it is not an imaginary story… আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। আমার প্রোটেস্টকে আপনাদের মধ্যে চারিয়ে দিতে চাই।’ ঋত্বিক কতগুলো কল্পিত ঘটনা ও চরিত্র সাজিয়ে শুধুমাত্র একটা গল্প বলতেন না, আসলে একটা বক্তব্য রাখতেন।

গত ১৮ নভেম্বর ‘স্পন্দন পিপলস থিয়েটার’ তাদের ‘ঋত্বিক এক নক্ষত্রের নাম’ নাটকটি মঞ্চস্থ করল ঠিক এই কথাগুলিকেই যেন আঁকড়ে ধরে। অ্যাকাডেমিতে তাঁদের প্রথম প্রদর্শনেই দর্শককে মোহিত করেছেন। ঋত্বিকের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিটি দেহভঙ্গিমা থেকে কথা বলার ধরনে তিনি সাবলীলভাবেই যেন ঋত্বিক হয়েই উঠেছিলেন।


নাটকটি দেখতে দেখতে একবারের জন্যেও মনে হয়নি ঋত্বিক ঘটক বোতল হাতে এক মাতাল, যিনি তাঁর প্রতিভার ওপর কোনো ন্যায়বিচার করেননি। বরং নাকটটি সামগ্রিকভাবেই ঋত্বিককে একজন উঁচুমানের শিল্পী ও দার্শনিক হিসেবেই তুলে ধরেছে। এইটিই এই নাটকের বিশেষত্ব শুধু না, এখনো অবধি ঋত্বিক বিষয়ে যত নাটক, এমনকি সিনেমাও হয়েছে, সেসবের সঙ্গে তুলনায় ঋত্বিক ঘটককে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, নাটকটির বিষয়ভাবনা সত্যিই অভিনব। একদল নাটককর্মী যখন স্থির করলেন তাঁরা ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে নাটক করবেন, তখন তাঁরা বেছে নিলেন এমন একজন ব্যক্তিকে ঋত্বিকের অভিনয়ের জন্য যিনি পেশাদার শিল্পী নন। একজন কাজহারা তাড়া খাওয়া শ্রমিক। এরপর দর্শক দেখলেন সমগ্র নাটকটির ভিতরেই আরেকটি নাটকের জন্ম হল। বিষয়, ঋত্বিক দেশভাগের ওপর একটি ফিল্ম শ্যুট করছেন। প্রেক্ষাপট পাঞ্জাব, লাহোর। কীভাবে ব্রিটিশ, হিন্দু মহাসভা, মুসলিম লীগ ও শিখদের ভিতর অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়া হচ্ছে! ব্রিটিশ রেসিডেন্ট জেনকিন্সের যড়যন্ত্রে দাঙ্গা বাধছে। তাঁর মেয়ে এস্থার পিতার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। বাইরেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ছে। খুব ছোটো একটি প্লটকে ঘিরেই এই নাটক; যেখানে অসাধারণ দক্ষতায় উপস্থাপন করা হলো, ঋত্বিকের ক্যামেরা, অ্যাঙ্গল, আলো, শব্দের ব্যবহারের শৈল্পিক বিশেষত্বগুলিকে! দর্শক জানতে পারেন, ঘৃণা বোঝাতে সবুজ আলোর ব্যবহার কীভাবে করতেন, মানুষ তার মানসিকতায় যখন ছোটো বা বড় তখন কীভাবে বদলে যেতো তাঁর ক্যামেরার অ্যাঙ্গল! কীভাবে উত্তাল লাহোরকে ঋত্বিক ধরতেন ডিপ শট, ডিপ ফোকাসে! নাটকটি শিল্পী ঋত্বিকের শৈল্পিক সত্তার ওপর চূড়ান্ত ন্যায়বিচার করতে চেষ্টা করেছে, এটুকু বলতেই হয়।

আরও একটি কথা বলার, যা হলো এই নাটকের সংলাপ। ঋত্বিকের একটি সংলাপে আমরা জানতে পারি কীভাবে ক্যামেরার ব্যবহারে তিনি একধরনের স্তম্ভন তৈরি করতেন। মানুষের বেদনা বোঝাতে তিনি ক্যামেরার যান্ত্রিক কারিগরির ওপর নির্ভর করতেন না। একটা শট দিয়ে কীভাবে জমাট বাঁধা বেদনাকে বোঝানো যেতে পারে, ঋত্বিকের ছবির ভিতরে ইউরোপীয় চিত্রকলা, দর্শন থেকে ভারতীয় দর্শন, পুরাণ, কীভাবে মিলেমিশে থাকে, তার সুচারু পরিবেশন নাটকটি করতে পেরেছে বিভিন্ন সংলাপের ভিতর দিয়ে।

দার্শনিক ঋত্বিক, শিল্পী ঋত্বিক, সত্যদ্রষ্টা ঋত্বিক, শিক্ষক ঋত্বিক, প্রতিবাদী ঋত্বিক, বিদ্রোহী ঋত্বিক, দেশপ্রেমী ঋত্বিক, মানবপ্রমী ঋত্বিক—এতোগুলি মাত্রা একটি নাটকের ভিতরে যেভাবে ধরা হয়েছে, তা এক কথায় অনবদ্য। আবার বলছি, ঋত্বিকের শতবর্ষ উপলক্ষে ঋত্বিক নিয়ে কম কাজ হয়নি। কিন্তু কেউই ঋত্বিকের মদ্যপ অবস্থা বা পারিবারিক দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে গিয়ে শুধুমাত্র শিল্পী ঋত্বিকের ওপর ফোকাস করতে পারেননি। ‘ঋত্বিক এক নক্ষত্রের নাম’ নাটকটির সাফল্য এই যে, সে ঋত্বিকের হাতে পাঁইটের বোতল ধরিয়ে দেয়নি। শেষ অঙ্কেও প্রমাণ করেছে আজও ঋত্বিক বেঁচে আছেন আর তাই এই অন্ধকার সময়ে আমরা বোধহয় সকলেই ঋত্বিক নামক নক্ষত্রটির সামনে হাঁটু মুড়ে বসেছি একটু আলোর আশায়। নাটকটির সূচনায় এই বার্তাই ছিলো।