অতনু রায়
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৮৮৪ সালে লেখা ধ্রুপদী উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরানী’। পর্দায় তার রূপান্তর সবসময়ই দুঃসাধ্য। কারণ, বাঙালির কাছে একদিকে দেবী মিথ আবার অন্যদিকে সচেতন এক চালিকাশক্তি। পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্র খুব সুচারুভাবে বঙ্কিম পথে ঋজুতার সঙ্গে বাংলার ইতিহাসের অন্দরমহলে নিয়ে যেতে পেরেছেন দর্শকদের, ওঁর ছবি ‘দেবী চৌধুরানী’র মাধ্যমে।
শুভ্রজিৎ উপন্যাসে লেখা শব্দগুলোকে হুবহু বড় পর্দায় তুলে ধরার মতো ‘সেফ গেম’ খেলেননি। সময়কে উপাদান করে এবং সমাজের তৎকালীন ভাবাবেগের উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় বদল ঘটিয়েছেন সিনেমার দাবীকে মান্যতা দিয়ে। ফলে, ‘দেবী চৌধুরানী’ পর্দায় সঠিকভাবে ‘ল্যান্ড’ করেছে, বলাই বাহুল্য। পরিচালকের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল বঙ্কিমী সাহিত্যের এক অমোঘ জগত আর সিনেমার তাগিদের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখা। আর ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে বলতে হয়, বেশ কিছু মুহূর্তে মূল উপন্যাস থেকে সরে এলেও এই ছবি কখনোই ন্যারেটিভের মূল উপজীব্যকে বিঘ্নিত করে না।
শুভ্রজিৎ কখনোই ন্যারেটিভের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাননি, ফলে একটা টানটান চিত্রনাট্য পাওয়া গেছে। এই ধরনের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ একাধিক চরিত্র হাতে থাকলে অসংখ্য ‘প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারি’ মুহূর্ত লেখা থেকে বিরত থাকা কঠিন। এখানেও চিত্রনাট্যকারের লোভ সংবরণ দর্শকদের শান্তির কারণ হবে।
‘নিশি’ চরিত্রে বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় অবশ্যই বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। নিজের শরীরের ফ্লেক্সেবিলিটিকে অপূর্ব কাজে লাগিয়েছেন পর্দার নিশি। ‘রঙ্গরাজ’ চরিত্রে অর্জুন চক্রবর্তীও বেশ ভাল। ওঁদের দুজনের ‘ইনভল্ভমেন্ট’ অ্যাকশন দৃশ্যগুলোকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ‘সাগর’ চরিত্রে দর্শনা বণিক এবং ‘ব্রজেশ্বর’ চরিত্রে কিঞ্জল নন্দ চরিত্রের প্রতি সৎ থেকে ছবিকে উত্তরণের দিকেই নিয়ে গেছেন।
‘প্রফুল্ল’ ওরফে ‘দেবী চৌধুরানী’ রূপে শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় তাঁর কেরিয়ারের অন্যতম সেরা অভিনয় করেছেন বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রফুল্ল’র দেবী হয়ে ওঠার যাত্রা কাগজে-কলমে অসাধারণ। কেউ বলতেই পারেন যে তিনি চরিত্রের সম্পূর্ণ সহায়তা পেয়েছেন, কিন্তু এই ছবিতে নিজেকে ভেঙে শ্রাবন্তী সত্যিই অনবদ্য দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রের সমস্ত সূক্ষ্মতা এবং সংবেদনশীলতাকে ধরেছেন।
আর, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়! ভবানী চরণ পাঠক চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্য চিত্রণে ‘বুম্বাদা’ অদ্বিতীয়। ভবানী চরিত্রের একটা নিজস্ব ওজন রয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই ‘অথর-ব্যাকড্’ চরিত্র। চরিত্রের ওজনকে লঘু না করে নিজস্ব সিগনেচার আনাই এই ধরনের চরিত্রের অভিনেতার চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন তিনি অবিসংবাদী। এই ছবির ভবানী শান্ত অথচ ক্ষিপ্র, চাহনিতে বোদ্ধা আর শরীরে যোদ্ধা। অভিনয়ের নিরিখে ভবানী বহুস্তরীয় এবং আক্ষরিক অর্থেই ছবির ন্যারেটিভের নৈতিকতার ‘কম্পাস’। একথা অনস্বীকার্য, ভবানী পাঠকের চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কোনও বিকল্প নেই। এবং ছবিতে ওঁর মাপা অভিনয় বুঝিয়ে দেয়, প্রসেনজিৎ নিজেও সেটা জানেন।
ছবি জুড়ে চরিত্রগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলোকে অনির্বান চট্টোপাধ্যায় তাঁর ক্যামেরার মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে ধরেছেন। প্রোডাকশন ডিজাইন বিশ্বাসযোগ্য, এবং কৃতিত্ব পরিচালকেরই। অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি বেশ ‘রিদমিক’ এবং যথাযথ ভাবে সাজানো। বিক্রম ঘোষের সঙ্গীতায়োজন ন্যারেটিভের পরিপূরক এবং নিজেই একটি চরিত্র হিসেবে পুরো ছবি জুড়ে থেকে যায়। ভিএফএক্স বেশ কিছুক্ষেত্রে হতাশাজনক। তবে পরিচালক ও সিনেমাটোগ্রাফারের লেন্সিং ও ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ব্যবহারের মুন্সিয়ানায় সেই খামতি কখনোই সব ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে না। ছবির গতি এবং চলন একেবারে প্রয়োজন মাফিক। চিত্রনাট্যকারের ন্যারেটিভের উপর দখলের ফলে কোনও ‘স্লোডাউন’ হয়নি। ছবি জ্ঞানগর্ভও হয়নি আবার ‘ওভার দ্য টপ’ও হয়নি। বঙ্কিম সাহিত্যের শিকড়ের প্রতি সম্মানজনক অবস্থান বজায় রেখেও এই ছবি হয়ে উঠেছে সমসাময়িক। পুজোর ছবির ভিড়ে শুভ্রজিৎ মিত্রর পরিচালনায় ‘দেবী চৌধুরানী’ অবশ্যই ‘মাস্ট-ওয়াচ’।