নির্মল ধর
দক্ষিণ কলকাতার মধ্যবিত্ত উচ্চ মধ্যবিত্তদের কাছে ‘লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল’ শব্দবন্ধের গূঢ়ার্থ অর্থ হল সক্কালবেলার ওই ট্রেন শহরতলি এবং গ্রামান্তর থেকে শয়ে শয়ে বাড়ি বাড়িতে, ‘কাজের লোক’ উগরে দিয়ে যায় বালিগঞ্জ, যাদবপুর, গড়িয়া, পার্ক সার্কাস অঞ্চলে, আবার বিকেলে উল্টোমুখো একই নামের লোকাল ট্রেনগুলো স্বভূমিতে ফেরত নিয়ে যায় তাঁদের। এটা তাঁদের বেঁচে থাকার রোজনামচা। কলকাতা দক্ষিণের জীবনযাত্রার ব্লাড লাইন বা লাইফ লাইনই বলা চলে এই হাজার হাজার ‘কাজের লোক’-এর রোজকার প্যাসেঞ্জারি। পরিচালক রামকমল মুখুজ্জে মহাশয় যখন মুম্বই থেকে এসে সেই লোকাল ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের নিয়ে ছবির কথা ভাবলেন, আশা ছিল তাঁদের জীবনের এক ধারাভাষ্য মিলবে পর্দায়। হয়তো বা সাধারণ দর্শকেরও প্রত্যাশা তেমনই ছিল।
কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হল কি?
হলো না, একেবারেই না। দেখা গেল ছবির জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনজন— অভ্র, পবন এবং রামকমল। অধিক সন্নেসিতে গাজন নষ্টের সম্ভবত এখানেই সূত্রপাত। চিত্রনাট্যে তিন তরুণী ‘বাড়ির কাজের লোক’ আছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের কাউকেই ‘গরিবগুর্বো’ তো মনেই হল না, বরং চেকনাই মেকআপে সরস্বতী (সায়নী ঘোষ), মালতী (চান্দ্রেয়ী ঘোষ) এবং কল্যাণী (পাওলি দাম) বেশ ধোপদুরস্ত। হাবভাবে কষ্ট বা দারিদ্র্যের কোনও মালিন্যই নেই। হলিউডি সিনেমার ঝকঝকে নায়িকা যেন। এঁরা আবার একসঙ্গে হঠাৎই কোনও প্রসঙ্গ ছাড়াই— ‘ঢেউ দেখানো বুকের তালে বিষ ছড়িয়ে…’ (গানের কথা সুন্দর ইঙ্গিতবহ বটে!) গানের সঙ্গে আইটেম নাচেও যোগ দিলেন।
এই তিন তরুণী দু-নম্বরি আয়া সেন্টারের মাধ্যমে ‘কাজ’ পেল যে তিন বাড়িতে, সেখানেও নানা চরিত্রের ভিড়ে ভিড়াক্কার অবস্থা! প্রবীণ বৃদ্ধ অসুস্থ কৌশিক গাঙ্গুলির তরুণী স্ত্রী ঋতুপর্ণার বাড়িতে এল কল্যাণী। চান্দ্রেয়ীর ঠাঁই হল সস্তা নবীন দম্পতি লেখক ইন্দ্রনীল ও টিভি সিরিয়ালের অভিনেত্রী সঙ্গীতা সাহার ফ্ল্যাটে। আর সায়নী ‘কাজ’ পেল জন ভট্টাচার্য-রাজনন্দিনীর লিভ টুগেদার করা ফ্ল্যাটে। তিনটি পরিবারই অ্যাফ্লুয়েন্ট! প্রায় সমস্যাহীন। তবুও ‘সমস্যা’ না হলে তো সিনেমা বানানো যায় না! ঋতুপর্ণা-কৌশিকের অনুপস্থিত একমাত্র সন্তান মস্কোয় ডাক্তারি পড়ে। তাঁর উল্লেখ শুধু আছে— এটাই বাঁচোয়া। ইন্দ্রনীলের বৃদ্ধ পিতা পঙ্কজ মুন্সি মানসিক ভারসাম্যহীন। কিন্তু পূর্ববাংলার বাসিন্দা কৌশিক অতীতচারি শ্রুতিবিলাসী। কাজের মেয়ে পাওলি দামের সঙ্গে একাত্মবোধ করেন স্মৃতিচারণায়। আর জন-রাজনন্দিনী তো জেট প্রজন্ম। তাঁদের লাইফ স্টাইলও ঘরোয়া বাঙালির নয়। অফিসের কাজে হুট করে ব্যাঙ্গালোর-প্যারিস পাড়ি দিতে হয় রাজনন্দিনীকে। নিঃসন্তান দম্পতি ইন্দ্রনীল-সঙ্গীতা ‘দত্তক’ নিয়ে মা-বাবা হয়ে উঠতে চান। আর রাজনন্দিনী বারো ঘণ্টার নোটিসে ব্যাঙ্গালোর চলে গেলে জন নিজের লেখা গান শোনায় কাজের মেয়ে সায়নীকে।
অবাস্তব পরিস্থিতি। পরিবেশ আর অতগুলো চরিত্র— তিন তিন চিত্রনাট্যকার মিলেও সামাল দিতে পারেননি। কোনও চরিত্রেরই কোনও পরিষ্কার শেকড় নেই, ডেভলপমেন্টও নেই, নেই কোনও কার্য-কারণের যুক্তি। বোঝাই যায়, পরিচালক নিজেও ‘সামাল’ দিতে অপারগ। দর্শককে তিন ‘কাজের লোকে’র সমস্যা দেখাবেন, নাটক দু-তিনটে গান শুনিয়ে তিনজনের আস্বাদ গুলে খাওয়াবেন! কিংবা ওপার বাংলা থেকে পালিয়ে আসা মানুষের ‘ডিপোর্ট’ হওয়ার কথা জুড়ে আবেগে বা ‘স্যার’-এ সমস্যায় ঘি ঢালবেন! শেষ পর্যন্ত তো কিসসু হল না। দর্শকের প্রাপ্তি হল একরাশ ক্লান্তি, অধৈর্য আর অভিনয়ের নামে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের দিয়ে অসহ্য অভিনয় করানো এবং দেখানো।
‘নটী বিনোদিনী’তে তবুও গল্প ও চরিত্রের কিঞ্চিৎ বাঁধুনি ছিল। ছিল রুক্মিনীর অভিনয়ে আন্তরিকতার ছোঁয়া। এই ছবির প্রযোজক সঙ্গীতা সাহার এটি যেমন প্রথম কাজ, তেমনই তাঁর অতি কাঁচা অভিনয়। কৌশিক-ঋতুপর্ণা, পাওলি-চান্দ্রেয়ী-সায়নী সব্বাই-ই অগোছালো চিত্রনাট্য এবং কাঁচা হাতের পরিচালনার শিকার। এবার দেখার অপেক্ষায় প্রচারের ঢাকিদের ঢাক বাজলে দর্শকরা কতটা উল্লসিত হন! বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান— নাটক পেছনে দাঁড়াবেন— সেটা দর্শকরাই বলবেন। যদি না এক সপ্তাহের পরেই সাকসেস পার্টির আমন্ত্রণ আসে!