‘সম্পূর্ণা’ অনুপর্ণা, রায় ভেনিসের

পুরুলিয়া থেকে ইতালি। গলি থেকে রাজপথ। কথামুখ থেকে রূপকথা। কখনও নদীর কাছে ছুটে যাওয়া, আবার কখনও কান পেতে শোনা বিস্মৃত গাছেদের গান! প্রথম শর্ট ফিল্ম ‘রান টু দ্য রিভার’। প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘সংস্ অব ফরগটেন ট্রিজ্’। নদী থেকে গাছ, কখনও আলগোছে আর কখনও রূপকে, অনুপর্ণা ছুঁয়ে ফেলেন প্রকৃতি। নারী প্রকৃতি। প্রকৃতির ছোঁয়ায় সম্পূর্ণা অনুপর্ণা ছুঁয়ে ফেললেন স্বপ্ন।

ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ‘অরিজন্তি’ বিভাগে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের শিরোপা জিতলেন অনুপর্ণা রায়। প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করলেন তিনি। আত্মবিশ্বাসের অভাবে যখন ধুঁকছে একটা প্রজন্ম, ঠিক তখনই চলচ্চিত্র বিশ্বের দরবারে বাংলা তথা ভারতকে আবার সম্মানের আসনে বসিয়ে দিলেন কুলটি কলেজের ব্রিটিশ ইংলিশ সাহিত্যের স্নাতক, অনুপর্ণা।

সময় আসলে সময়ের কাছে ঋণী। মনে পড়ে, ২০২৪ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘আনসার্টেন রিগার্ড’ বিভাগে সেরা অভিনয় শিল্পীর পুরস্কার জিতেছিলেন বাঙালি কন্যা অনসূয়া সেনগুপ্ত। অনুসূয়ার পরে অনুপর্ণা, ফ্রান্সের পরে ইতালি, কানের পরে ভেনিস— মুহূর্ত এসে মিলে যায় মুহূর্তে। শুধু থেকে যায় দেশ, সিনেমার রেশ। কান চলচ্চিত্র উৎসবে যেমন ‘আনসার্টেন রিগার্ড’, ভেনিসে তেমনই ‘অরিজন্তি’। ‘অপরাজিত’ সত্যজিৎ রায়ের প্রায় দীর্ঘ ৬৮ বছর পরে বিশ্বখ্যাত এই ফেস্টিভ্যাল পোডিয়ামে উচ্চারিত হল এক বাঙালির নাম।


অনুপর্ণা যেভাবে গল্পটা বলতে চেয়েছিলেন, সেই জায়গা থেকে একেবারেই সরেননি। যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই বানিয়েছেন। এমন একটা জয় যেমন অনেক আনন্দ বয়ে আনে, অনেক অপ্রিয় প্রশ্নের হয়ত উত্তরও দিয়ে যায়। অনুপর্ণার জয় হয়ত নিরুচ্চারে বলে দিল, সিনেমা আসলে পরিচালকের মাধ্যম। পরিচালক নিজের মতো করে ছবিটা বানাতে পারলে, কে বলতে পারে…! যেখানে বেঁচে থাকাই বিলাসিতা, সেখানে ইচ্ছেরা হয়ত নীরবতা খুঁজে ফেরে। এই জয় হয়ত অস্ফুটে বলে, সিনেমা আসলে বিশ্বাস— সিনেমা আসলে যাপন।

নিজের প্রথম ছবিতেই ‘বিগ ফাইভ’ ফেস্টিভ্যালের অন্যতম একটার শিরোপা জয় মুকুটে নতুন পালক নয়, আস্ত একটা মুকুট। এই বিভাগেই একসময় সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতেছেন লাভ দিয়াজের মতো পরিচালক। যাঁরা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের খবর রাখেন তাঁরা জানবেন, ভেনিস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন চলচ্চিত্র উৎসব। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল সার্কিটে ‘বিগ ফাইভ’ বলে এক ব্র্যাকেটে উচ্চারিত হয় ‘ভেনিস’, ‘কান’, ‘বার্লিন’, ‘টরন্টো’ এবং ‘সানডান্স’ উৎসবের নাম। নিজ ক্ষেত্রে গুরুত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে এঅনেকটা ‘অস্ট্রেলিয়ান ওপেন’, ‘ফ্রেঞ্চ ওপেন’, ‘উইম্বলডন’ আর ‘ইউএস ওপেন’ নিয়ে টেনিস গ্র্যান্ডস্লামের সঙ্গেই একমাত্র তুলনীয়।

অনুপর্ণার এই জয় বাঙালি হিসেবে, ভারতীয় হিসেবে আমাদের কাছে ভীষণ গর্বের। তাই আজ তাঁর চলার পথে যা যা ছিল না তার থেকেও বেশি করে উদযাপন করা দরকার তিনি যা পেরেছেন তাকেই। কারণ, সত্যিকারের শিল্প কোনোদিন না পাওয়ার বিশ্লেষণে আটকে থাকেনি। ১৯৮৩ সালে ক্রিকেটে ভারতের প্রথম বিশ্বজয়ের রাস্তায় কত রকমের কাঁটা বিছানো ছিল সেটা কবীর খানের ‘৮৩’ ছবিটা দেখার আগে কজন জানতেন, বলুন তো? তবুও ৪০ বছর ধরে ২৫ জুনের রাতে গর্বে চোখ চিকচিক করেছে ভারতের। অনুপর্ণার জয় সেরকমই এক চোখ চিকচিক করা গর্বের।

সত্যজিৎ রায় এই প্রজন্মের কাছে দূর গ্রহের ঈশ্বর। অনুপর্ণা সত্যিই সত্যজিৎ হতে চেয়েছিলেন কিনা, সেটা আজ ভীষণ অপ্রাসঙ্গিক। তবে আগামী প্রজন্মের একঝাঁক নতুন ছবিকরিয়ে ‘অনুপর্ণা’ হতে চাইলে সেটাই হবে আসলে ভারতীয় সিনেমার জয়। হয়ত আবার কোনও উৎসবের বিশ্বমঞ্চে আবার ঘোষণা হবে কোনো ভারতীয়র নাম। হয়ত আবার ভারতীয় সিনেমার সাফল্যের সঙ্গে জুড়ে যাবে কোনো বাঙালির নাম!

একদম শেষে এসে একটা কথা না লিখে এই লেখাটা শেষ করতে ইচ্ছে করল না। আমরা বাঙালি। সংস্কৃতি, শিল্প, আমাদের নিঃশ্বাসের জড়িয়ে। বেশ কিছুদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙালিরা ‘হ্যাজ’ নামিয়ে ছিলেন অনুরাগ কাশ্যপ বাংলা ছবিকে ‘ঘটিয়া’ বলে বাঙালিকে অসম্মান করেছেন। আজ একটা কথক জানবেন, আমাদের গর্বের বাঙালি কন্যার ভেনিস জয়ের ছবির প্রেজেন্টারের নাম কিন্তু অনুরাগ কাশ্যপ। থ্রি চিয়ার্স ফর অনুপর্ণা রায়। ভাল সিনেমার জয় হোক। ভারতীয় সিনেমার জয় হোক।