‘নিমাইল ক্লিন ইকুয়াল মিশন’ নামক একটি ক্যাম্পেনের অংশীদার হতে তাঁর শহরে আসা। বাড়ির পরিচ্ছন্নতার দায় একা মেয়েদের নয়। পরিচ্ছন্নতায় লিঙ্গ বৈষম্য বলে কিছু হয় না। স্কুল স্তরে এই শিক্ষা দেওয়াই এই মিশনটির অঙ্গ। এই সোশ্যাল মেসেজ প্রচারের ফাঁকে, একান্তে পাওয়া গেল অভিনেত্রীকে।
একজন বিশ্ববন্দিত ব্যক্তিত্ব হলেও, অপর্ণা সেন আপনার চোখে আপনার মা-ই। তাঁকে কীভাবে দেখেছেন।
বড় হওয়ার পর্যায়টাতে আমি মাকে নানা ভূমিকায় দেখেছি। আমি ওঁকে ফিল্ম সেট-এ নির্দশক হিসেবে দেখেছি, এডিটিং স্টুডিয়োতে দেখেছি, এমনকী একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দেখেছি। আবার বাড়িতে একজন পরিপূর্ণ মায়ের ভূমিকা নিতেও দেখেছি। মাকে দেখে বড় হওয়াটাই যথেষ্ট এমপাওয়ারিং।
তবে আমি আমার বাবার (মুকুল শর্মা) কথাও বলব, যিনি নিজে একজন সাংবাদিক ছিলেন। আফটার মাই পেরেন্টস গট সেপারেটেড, বাবা ওঁর স্ত্রীকে নিয়ে বিদেশে থাকতেন। সেই সময় আমি ওঁদের পরিবারে বেশ কিছুটা সময় ধরে থেকেছি এবং দেখেছি, বাবাও অসম্ভব সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট একজন মানুষ।
নানা ধরনের সোশ্যাল অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রামে আপনি অংশগ্রহণ করেন। লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার বিষয়টাও তাই। বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে, এই সচেতনতার কতটা আমরা অ্যাচিভ করতে পেরেছি বলে মনে করেন।
এটা আসলে এমন নয় যে, একদিনে পরিবর্তন এনে ফেলা যাবে। সেই অর্থে হয়তো লক্ষ্য পূরণ থেকে এখনও আমরা অনেকটা পিছিয়ে। কিন্তু বারবার প্রচার করতে হবে, একাধিকবার হ্যামারিং করে সচেতনতাটা মানুষের মধ্যে প্রবেশ করাতে হবে। সো ইট ইজ অ্যান অন গোয়িং থিং। করে যেতে হবে।
ব্যক্তিগত স্তরে মানে একদম যদি আপনার নিজের বাড়ির কথা বলি, সেখানে আপনি লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়গুলি কীভাবে হ্যান্ডেল করেন?
আমার ছেলের এখন চোদ্দ বছর বয়স। আমাদের বাড়ির পরিবেশে কখনও জেন্ডার ইনইক্যুয়ালিটির প্রশ্নই ওঠে না। ফলে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি তাকে ঘর-সংসারের ছোট ছোট কাজেও ইনভল্ভ করা শুরু করেছি। কেন বাড়ির মহিলারাই অন্যের খাবারের থালা পরিষ্কার করবেন! তাই নিজের প্লেটের ভুক্তাবশেষ ওয়েস্ট বিন-এ ফেলা এবং নিজের থালাটা মেজে দেওয়া, এসব অভ্যাস লকডাউনের সময় থেকেই ছেলের মধ্যে তৈরি করে ফেলা গেছে।
আমার মনে হয় কিছু কিছু শিক্ষা পরবর্তী জীবনেও ওকে সাহায্য করবে। যেমন ও এটা শিখেই বড়ো হয়েছে যে, সংসারের কাজ করাটা কেবল মহিলাদের উপরেই বর্তায় না। বাড়ির পুরুষ সদস্যরাও সমানভাবেই সংসারের অংশীদার। ফলে গৃহস্থালির কাজ করতে তাঁদেরও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। আসলে হাজব্যান্ডদের শেখানোর তো আর সময় নেই, তাই পরবর্তী প্রজন্মকে এভাবে তৈরি করতে হবে (হাসি)।
বারবার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিতে আপনি জোর দিচ্ছেন। শুধু বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা নয়, মনের পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিকেও কি আপনি এতটাই গুরুত্ব দেন?
আসলে ভেতরের পরিচ্ছন্নতার উপরেই তো নির্ভর করে আপনি মানুষটা কেমন। আপনি মনের দিক থেকে পরিচ্ছন্ন হলে তার প্রভাব বাইরে এবং আপনার চারপাশের পরিবেশের উপরেও পড়বে। আপনাকে যারা ঘিরে থাকে তাদের উপরেও এর প্রভাব পড়বে।
আমি নিজে কিছু মেন্টাল হাইজিন প্র্যাকটিসের মধ্যে দিয়ে যাওয়াতে বিশ্বাস করি। মনকে শান্ত করা, মনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে আসা— যাকে বলে টেমিং দ্য মাইন্ড- ভীষণ জরুরি। আওয়ার ফার্স্ট হোম ইজ দ্য মাইন্ড অ্যান্ড দ্য বডি, সেকেন্ড কামস আওয়ার লিভিং স্পেস অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট। ফলে কোনওটাকেই অবহেলা করা যাবে না।
আপনার ‘গিলি পুচি’ ছবিটাতে দেখানো হয়েছিল কর্মস্থলে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট পর্যন্ত নেই। তেমনই লিঙ্গ ভেদাভেদের বিষয়গুলিও কি আরও বেশি করে ছবিতে আনা দরকার, যাতে তা সমাজে একটা বৃহত্তর প্রভাব ফেলতে পারে?
দেখুন আমরা যদি এক্সপেক্ট করি যে, সিনেমা অলওয়েজ হ্যাভ টু বি ইন্সট্রাকশনাল, আই ডোন্ট থিংক দেন দেয়ার উইল বি এনি গ্রেট আর্ট। তখন সেটা মেসেজ ফিন্ম না হয়ে জাস্ট প্রপাগ্যান্ডা ফিল্ম হয়ে যাবে। দ্যাট ইজ নট দ্য আর্ট অফ ফিল্ম মেকিং। ফলে সব ধরনের ছবিই তৈরি হোক। আমি একজন ফিল্ম মেকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলব, সেরকম ফিল্ম মেকারও তো আছেন যাঁরা আর্ট অফ ফিল্ম মেকিংকে বজায় রেখে, নির্দিষ্ট একটা বার্তা দিতে পারেন। তখনই সেই ভাবনা ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে।
আমরা জানি মূল্যবোধের মতো বিষয়গুলো পরম্পরাগতভাবে পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছোয়। অপর্ণা সেনের মেয়ে হিসেবে আপনি ঠিক কী ভ্যালুজ বহন করছেন, যা পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে চান?
আমার মা সবসময়ই তেমন কিছু করেছেন যা নিয়ে গর্ব করা যায়। সেটা ঘরে-বাইরে সর্বত্র।ওয়ার্কিং মাদার হওয়া সত্ত্বেও ওঁর রান্নার কোনও তুলনা হয় না। আমাদের বাড়িতে যারা যারা রান্না করে, ইনক্লুডিং আমার দিদি- সকলকে মা-ই রান্না করতে শিখিয়েছে। মায়ের সেই সব রেসিপি এখনও চলছে। আসলে মা খুব হাউস-প্রাউড একজন মানুষ। পারফেকশন অ্যান্ড ক্লেনলিনেস এগুলো মায়ের থেকেই শেখা। ইভন কোথাও বেড়াতে গেলে আগে মা ওয়াশরুমে ঢুকে সমস্তটা ক্লিন করে তবে আমাদের ঢুকতে দিত, যাতে সেটা আমাদের জন্য সেফ হয়। এগুলোই ছোট থেকে শিখেছি এবং ছেলেকেও শেখাচ্ছি।
নিজে হাতে বাড়ির কাজ করার মধ্যে যে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই বরং সেটা গৌরবের- সেই শিক্ষাও মায়ের থেকেই পাওয়া। ছোটবেলায় আমি কোনও কাজ করলে মা তার জন্য হাতে টাকা দিত। প্রাইজ মানি পেলে কাজে উৎসাহ বাড়ে। আর ওটা জাস্ট পকেট মানি পাওয়ার মতো নয়, বরং একটা সেল্ফ ওয়ার্থ-ও তৈরি করে। কোনও কাজকে ছোট না ভাবা, কাজের ক্ষেত্রে পুরুষ-নারী ভেদাভেদ না করা— এগুলোই আমি শিখে বড় হয়েছি।