পাপিয়া চোধুরী
নাট্যসম্রাজ্ঞী তারাসুন্দরী। ডুবুরির মতোই মুক্তো নিয়ে এলেন তারাসুন্দরী মঞ্চে গার্গী রায়চৌধুরী। একক অভিনয়ে গার্গী। নাট্যকার ও পরিচালক উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, নাট্যকার তারাসুন্দরীর জীবনবৃত্তান্ত, বিভিন্ন চরিত্রের অভিনয়, প্রেম, বিচ্ছেদ, যশ সবকিছুই খুবই নিপুণভাবে গ্রথিত করেছেন। নাটকের গঠন, চলন, কথন, অভিনয়ে গার্গী রূপ দিলেন, বাঙ্ময় করলেন, গতি দিলেন ও চৌম্বকীয় আকর্ষণে দর্শকবৃন্দকে ধরে রাখলেন এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট (বিরতিহীন)। বিনুদিদির (নটী বিনোদিনী) হাত ধরেই তারাসুন্দরীর মঞ্চে প্রবেশ। তখন প্রায় সাত বছরের বালিকা, ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকে বালকের অভিনয় দিয়ে শুরু। ধীরে হয়ে উঠলেন নাট্যসম্রাজ্ঞী। মঞ্চে ছিলেন অনায়াস, অপ্রতিরোধ্য, ট্র্যাজেডি ও কমেডি চরিত্রে পারদর্শী। গার্গী সংবেদনশীল সচেতন শিল্পী, তাই তো এমন করে ‘তারা সুন্দরী’কে আড়াল থেকে হাজির করলেন তাঁর শৈল্পিক সুধায়। গভীর অনুভবের সেতুর কাজটি করে দিয়েছিলেন ব্রাত্য বসু। গড়ে উঠল থিয়েটার প্লাস। গার্গীর সাধের থিয়েটার প্লাস-এর প্রথম নিবেদন ‘তারাসুন্দরী’। গার্গী মেতে উঠলেন ও মাতিয়ে তুললেন দর্শকদেরও। তারারূপী গার্গীকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখলেন দর্শক। অভূতপূর্ব। প্রেক্ষাঘরে ঢুকেই দেখা গেল পর্দা সরানো মঞ্চ। অপূর্ব সজ্জা। মঞ্চ আভরণ এমনই যা খুবই সৃজনশীলতার প্রমাণ রাখে। সৌমিক পিয়ালীকে কুর্নিশ এমন পরিমিত ও দরকারি মঞ্চ সজ্জার জন্য।
গার্গী কখনও চন্দ্রশেখর নাটকের শৈবলিনী, কখনও ‘খাসদখল’-এর মোক্ষদা, আবার ‘কপালকুণ্ডলা’র মতিবিবি, কখনও ডেসডিমোনা, রিজিয়া ও পিশাচিনী জহরা হয়ে উঠছেন এক লহমায়। কমেডি চরিত্রের হেমাঙ্গিনীর কণ্ঠস্বরের মড্যুলেশন ভোলার নয়। ত্বরিতেই হয়ে উঠলেন ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে আয়শা। গার্গীর গানের গলাও খুব সুন্দর। ‘কে আবার বাজায় বাঁশী’ বা ‘আমি যেন ছবিটি’ প্রত্যেক গানের সঙ্গে নৃত্য হিল্লোলেও গার্গী মুগ্ধ করেন।
নৃত্য পরিচালক সুকল্যাণ খুবই যথার্থ নৃত্য পরিকল্পনা করেছেন। গার্গীও খুবই সাবলীল, অনায়াস। তারাসুন্দরীর জীবনে প্রেমিকও এসেছেন, পেয়েছেন মাতৃত্বের সাধ, হয়েছেন পুত্রহারাও। গার্গী মঞ্চে কখনও তারাসুন্দরী, কখনও তাঁর প্রেমিক কাপ্তেন অমরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁদের সংলাপে খসে পড়ে প্রেমিকের মুখোশ। মূর্ত করেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের চরিত্র, তারাসুন্দরীর পুত্র নির্মল কুমারের বাবা। নির্মল মারা যায়। ত্বরিতে চরিত্রের বদল, স্বরক্ষেপণ, মুড, পোশাকের বদল, প্রপসের ব্যবহার সবই মঞ্চের উপরেই হচ্ছে অবলীলায়, সাবলীলতায় ও নিপুণভাবে, তা না দেখলে বোঝানো যাবে না। বহুদিন পর এমন জ্যোতি দেখলাম। গার্গীর দীঘল চোখের অভিব্যক্তি ভোলার নয়। অভিষেক রায়ের পোশাক অনবদ্য। সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত। সঙ্গীত পরিচালনায় প্রবুব্ধ ব্যানার্জি খুবই পরিশীলিত। আলোকশিল্পী সৌমেন চক্রবর্তী যথেষ্ট মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন।
অভিনেত্রীকে আঁধারে রাখেননি, উজ্জ্বলতায় অভিব্যক্তি রেখাগুলো স্পষ্ট করে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সর্বোপরি বলতেই হয়, এমন মঞ্চায়ন বহুকাল দেখিনি। গার্গীকে সাবাশী, কুর্নিশ, সেলাম এমনই একটি চরিত্র বেছে নেওয়ার জন্য এবং প্রত্যেক সহযোগী শিল্পী ও নাট্যকার, পরিচালককেও। শেষের দৃশ্যটি বড়ই মধুর, বিনোদিনী তিনকড়ি দাসী ও তারাসুন্দরী না থাকলে কে জ্বালতো এই বহ্নিশিখা রঙ্গমঞ্চে! সঙ্গীতে ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা…’ এ তো তাঁদেরই সরণি রেখা।