• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

দাবা খেলায় হবো না বোড়ে

অহনা’ ছবির আধুনিকমনস্ক দম্পতি অহনা (সুদীপ্তা) নীল (জয় সেনগুপ্ত)-এর জীবনে ঘটনা ঠিক তেমনটাই। কাহিনী, চিত্রনাট্য প্রমিতার নিজেরই কলম থেকে।...লিখেছেন নির্মল ধর।

‘‘… পুরুষ গাছ, আমি তো আর চাই না হতে লতা
ভালবাসার শর্ত হবে সাম্য স্বাধীনতা
তুমি আমার বন্ধু, আমার জান-এ-জিগর সঙ্গী
কিন্তু আমি মানব না আর প্রভু সাজার ভঙ্গি
আমি তোমার দাবা খেলায় আর হবো না বোড়ে
খেলব নিজে স্বয়ংসিদ্ধা, খেলব লড়ব জিতব রে।’’

প্রমিতা ভৌমিকের প্রথম কাহিনিচিত্রের প্রধান নারীচরিত্র ‘অহনা’র মনের কথাটাও অনেকটা একইরকম। আমাদের এই পুরুষকেন্দ্রিক সমাজে এবং সংসারেও নারী-স্বাধীনতা বলতে ‘আর্থিক’ স্বাধীনতাকেই প্রাধান্য দেওয়া। আড়ালে থেকে যায় নারীর উপযুক্ত মর্যাদার ব্যাপারটা। শিক্ষিত-অশিক্ষিত প্রায় সব পুরুষরাই ‘নারীর মর্যাদা’ ব্যাপারটিকে ‘টেকন ফর গ্র্যান্টেড ধরে নেয়, অথচ পুরুষ নিজের মর্যাদা রক্ষায় সদা তৎপর। নিজের কোনও দোষ বা ত্রুটিকে আমলই দেয় না। এমনকি বায়োলজিক্যাল কোনও ত্রুটিকেও। আর যদি সেটা হয় সন্তান ধারণের অক্ষমতা (না, ইম্পোটেন্সি নয়, স্পার্ম কাউন্টের ঘাটতি)! তাহলে তো বলাই বাহুল্য, পুরো পরিস্থিতিটাই যায় ঘেঁটে।

Advertisement

অহনা’ ছবির আধুনিকমনস্ক দম্পতি অহনা (সুদীপ্তা) নীল (জয় সেনগুপ্ত)-এর জীবনে ঘটনা ঠিক তেমনটাই। কাহিনী, চিত্রনাট্য প্রমিতার নিজেরই কলম থেকে। নীল নামি অধ্যাপক। তাঁর বেলুন সাইজের গর্ব ‘আমি সেমিনার কনফারেন্স করে বেড়াই, কলেজে অধ্যাপনা করি। আমি কি বাজারে গিয়ে মাছের পেট টিপে দেখবো!’ এবং তিনিই ক্লাসে গিয়ে স্লোগানের সুরে বলেন, ‘আমাদের দেশে মেয়েরা পিছিয়ে আছে। ভালো মা, ভালো স্ত্রী হতে গেলে মেয়েদের ‘আর্থিক স্বাধীনতা বড্ড দরকার।’

Advertisement

আর এই মানুষটাই বাড়িতে শোবার ঘরের আলোটা নেভানোর আগে লেখার টেবিলে কর্মরত স্ত্রীকে একটিবারও জিজ্ঞাসা করার সৌজন্যটুকু দেখান না! এই শিক্ষিত অধ্যাপক পুরুষটি বুঝতেই চান না ইম্পোটেন্সির মধ্যে তফাতটা কোথায়! চিকিৎসকের যথাযথ পরামর্শ নিতেও তাঁর গভীর অনীহা। অহনা-নীলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ‘ইগো’ নিয়ে। অহনা নিজের ইগো সরিয়ে মানসিক ব্যবধান সত্ত্বেও নীলকে কাছে পেতে চায়। কিন্তু নীল নিজের আত্ম-অহমিকার খোলস ছেড়ে বেরোতে পারে না। এঁদের মাঝখানে অবস্থান নীলের বয়স্ক বাবার। তিনি প্রত্যহই অহনার প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল। সংসারে এক অসহায় অবস্থান তাঁর।

আর রয়েছে প্রবাস থেকে আসা অহনার একদা বয়ফ্রেন্ড সাইকোলজিস্ট আদিত্য। মাত্র এই চারটি চরিত্র নিয়ে সম্পর্কের এক সুন্দর চতুষ্কোণ সাজিয়েছেন পরিচালক প্রমিতা। সরল ন্যারেটিভে ঝরঝরে ভঙ্গিতে এগিয়েছে ঘটনা এবং তাঁদের জীবন। অহনা ‘একটু আধটু’ লিখেটিখে নাম কুড়োচ্ছে সবে, পুরস্কারও পেতে শুরু করেছে। স্ত্রীর এই বাইরের জগতে যাওয়াটাও নীলের কাছে অসহনীয়। ঈর্ষার কারণও বটে। পরিচালক প্রমিতা সেটা নিয়ে কোনও রকম অতি-নাটকের আশ্রয় নেননি। খুবই স্বাভাবিক ও সহজ ভঙ্গিতেই দু’জনার বিচ্ছেদের চূড়ান্ত মুহূর্তটি প্রতিমা গড়ে তুলেছেন রাত্রিবেলা ছাদের আলো আঁধারিতে। পরিবেশটি সুন্দর গড়েছেন প্রমিতা। পৌরুষের দম্ভ নিয়ে নীল তখন বিস্ফোরক অবস্থায়। অপমানের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে অহনাকে ভাবতেই হয় আত্মমর্যাদা রক্ষার ব্যাপারটা। তাই অসম্মানের সংসার থেকে বেরিয়ে অভাবিত এক নতুন শুরু ও নতুনতর লড়াইয়ের ময়দানে স্থিরপ্রতিজ্ঞ অহনা। আর এখানেই চরিত্রটির এক অন্যতর উত্তরণ ঘটে যায়। প্রমিতার ছবির এমন সমাপ্তি মনে করিয়ে দিচ্ছিল কয়েক সপ্তাহ আগে দেখা ‘আপিস’ ছবির গরিব গৃহিণী হাসিকে। প্রায় একইভাবে ‘চাকরি আমি করি, সংসারের দায়িত্বই আমার’ এমন উদ্ধত সংলাপ স্বামীর মুখে শোনার পর হাসিকে শহরের দিদি জয়িতার কাছে চাকরিটা ফিরে পেতে। হাসির ছিল আর্থিক স্বাধীনতার লড়াই। অহনার ক্ষেত্রে ঘটেছে আত্মসম্মান ও মর্যাদার প্রশ্ন! এমনকি কয়েকমাস আগে দেখা ‘ছাদ’ ছবির পরিচালক ইন্দ্রনীল চক্রবর্তীও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অহংবোধ নিয়ে সংঘাতের পরিস্থিতি ও প্রশ্নটি যথার্থ ভাবেই তুলে ধরেছিলেন। কলকাতার নারী পরিচালকরা যে এভাবে লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে শুধু ভাবছেন না, তাঁদের ছবিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে সেই বোধ ও ভাবনা—সেটা বাংলা ছবির দর্শকের কাছে একটা বড় প্রাপ্তি।

‘অহনা’ আবার জানিয়ে দিল ফিল্ম তৈরির নিয়মিত ও ব্যবসায়িক প্রযোজকের ভরসায় না থেকে একক প্রচেষ্টায়ও ‘স্বাধীন’ ছবি বানানো যায়। এই ছবিগুলি সত্যি বলতে, এই প্রতিবেদকের মনে হয়েছে বাংলা সিনেমায় এক নতুন ধারার পুনঃসূচনা করল, যা শুরু হয়েছিল অপর্ণা সেনের ‘পরমা’ থেকে।

প্রমিতা ভৌমিকের সাবলীল সিনেমা প্রকরণ শৈলীর সঙ্গে নাম-চরিত্রে সুদীপ্তার স্বচ্ছন্দ সাবলীল অভিনয় এবং স্বামীর চরিত্রে জয় সেনগুপ্তের যোগ্য সঙ্গত যেমন বড় প্রাপ্তি, তেমন শ্বশুর-বাবার চরিত্রে সৌম্য সেনগুপ্ত ও আদিত্যর ভূমিকায় প্রিয়ব্রত সরকারও চিত্রনাট্যে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছেন। এবং একবারে অন্তিম পর্বে ‘সহজ মানুষ ভজে দেখ না রে মন’ লালনগীতিটির ব্যবহারও পুরো ছবিকে উত্তীর্ণ করে দেয় অন্যতর উচ্চতায়। এককথায়—‘সাবাশ প্রমিতা!’

Advertisement