• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

ডিপ ফ্রিজ’ যেন অহল্যার শাপমোচনের গল্প

অর্জুন দত্ত সম্পর্কের গল্প খুব ভাল বুনতে পারেন। ওঁর প্রথম ছবি থেকেই আমরা দেখেছি গল্প বলায় ওঁর মুন্সিয়ানা

অতনু রায়

বছর দশেক আগের কথা। কফি হাউসের কোণের টেবিল। রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশেই। শনিবার বিকেলের দিকে বার কয়েক দেখেছি ওঁদের বসে থাকতে। সঙ্গে ৭-৮ বছরের ছেলে। বাচ্চাটার ধরাবাঁধা কবিরাজি আর ওঁদের ইনফিউশন। ভদ্রমহিলা ছেলেকে মাঝেমধ্যে তার বাবার সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে আসতেন। ওঁদের টেবিলের দিকে তাকিয়ে সেটা কখনও বুঝে ফেলা যায়নি। সেটা একদিন বোঝা গেল ভদ্রমহিলা বাচ্চাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পরে টেবিলে আসা ভদ্রলোকের বাকি বন্ধুদের কথোপকথনে। শুনে বোঝা যায়, ওঁদের সম্পর্কটা ঠিকঠাক জমাট বাঁধেনি। ওঁদের কেন, আমাদের পারিপার্শ্বিকের অনেক সম্পর্কই ঠিকভাবে জমাট বাঁধে না।

Advertisement

অর্জুন দত্ত সম্পর্কের গল্প খুব ভাল বুনতে পারেন। ওঁর প্রথম ছবি থেকেই আমরা দেখেছি গল্প বলায় ওঁর মুন্সিয়ানা রয়েছে। ‘ডিপ ফ্রিজ’ সম্পর্কের গল্প হওয়ায় শুরু থেকে আশা ছিল ভাল ছবির। অর্জুন আশাহত করেননি, বরং কন্ট্রোল দেখিয়েছেন। ন্যারেটিভের উপর পরিচালকের সেই কন্ট্রোলই ‘ডিপ ফ্রিজ’কে ব্যালান্সড্ আর রিলেটেবল করে তুলল।

Advertisement

ডিপ ফ্রিজ খাবার নষ্ট হতে দেয় না কিন্তু সম্পর্ক নষ্ট হলেই ডিপ ফ্রিজে যায়। সম্পর্কের শৈত্য আর সম্পর্কের সত্য প্যারালাল দুটো ট্র্যাকে চলতে থাকে। সেই প্যারালাল ট্র্যাকে একটা তিন কামরার গাড়ি গড়িয়ে চলে ছবির শুরু থেকে শেষ, ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট। যেকোনো একটা ‘কাপলিং’ ছেড়ে গেলেই একটা কামরা একেবারে একা হয়ে ছিটকে যাবে ট্র্যাক থেকে! পরিচালকের দায়িত্ব ছিল তিনকামরার গাড়িটাকে অক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া।

শুরুতেই কফি হাউসের কোণের টেবিলের যে গল্পটা বলছিলাম, ২০২৫-এর পৃথিবীতে এই ঘটনা লুকিয়ে রাখার নয়। একটা সময় ছিল, বিবাহবিচ্ছেদ প্রকাশ্যে এলে সম্মান আর সম্ভ্রমে আঘাত করত যেন! সেই কারণে অনেক বিয়ে ভেঙে গিয়েও ভাঙেনি, অনেক বিয়ে ‘বাচ্চাটা না থাকলে…’ বলে টিকে গেছে, অনেক সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জীবনসঙ্গী হলেও তাঁদের সফরসঙ্গী বা শয্যাসঙ্গী আলাদা হয়েছে, এসবই আমাদের পারিপার্শ্বিকে দেখা গল্প।

বিবাহিত জীবনে পাগলপারা জলের ধারা হয়ে বয়ে চলা মিলি সব ভেঙ্গে ফেলল। তার কষ্ট দীর্ঘশ্বাসের বেড়া ডিঙিয়ে চিবুক ছুঁয়ে বুকে জমে বরফ হয়ে। ছবি জুড়ে সে কাঁদল, কিন্তু কাঁদল না। বলল, কিন্তু বলল না। বুঝল, কিন্তু…বুঝল না। আর উল্টোদিকে স্বর্ণাভ, আমাদের সেই বন্ধুটা, যে সাংসারিক সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকে গেলেও, না-যাপনের পারিপাট্যেই তার সমর্পণের অঙ্গীকার।

রাতে ডিপ ফ্রিজ খুলে বরফ শ্বাস নেওয়া আবির যেন এই ছবিতে জল হয়ে গেলেন। তাঁর চরিত্রে যে ফ্লুইডিটি অর্জুন আনতে চেয়েছেন, তার থেকেও তরল করে উপস্থাপন করলেন নিজেকে। এই ছবির ‘স্বর্ণাভ’ আবির বয়ফ্রেন্ডের থেকে বেশি করে ‘হাজব্যান্ড মেটেরিয়াল’। ভারতীয় সিনেমা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বরের থেকে প্রেমিককে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তবু অর্জুনের ছোঁয়ায় স্বর্ণাভ পর্দায় আবিরের থেকেও ‘সেক্সি’ হয়ে উঠলেন। বাংলা ছবির ‘শার্টলেস’ প্রেমিকদের নিয়ে আলোচনা ছিটকে আসুক এই ছবির ‘শার্টলেস’ বরের দিকেও।

আবিরকে সেইসব ছবিতে বেশি ভাল লাগে, যেখানে হিরো আবির ‘হিরোইজম’ দেখান না। ওঁর ‘বয় নেক্সট ডোর’ ইমেজটা যে যে পরিচালক ব্যবহার করতে পেরেছেন, তাঁরা লাভবান হয়েছেন। অর্জুন যেন সেই ইমেজটাকে বেশি করে কাজে লাগালেন। ফলে দর্শক স্বর্ণাভকে ছুঁতে, নিজের সঙ্গে জুড়তে পারল বেশি। স্বর্ণাভর চোখের তারায় নিজের কোনো বন্ধু-সুজনের বিচ্ছেদের যন্ত্রণাটা পড়তে পারল বেশি।

এই ছবি দেখতে দেখতে দাম্পত্যের ‘রিকনসিলেশন’কে সরিয়ে রেখে ইনফিউশনের বাষ্পে অভিমান ঢাকা দিতে হয় না। অভিমান থেকে যায় নীরবতা এবং সংলাপের দ্যোতক হয়ে। বারবার লিখি, সম্পর্কের ছবি সবসময় হেলান দিয়ে থাকে সংলাপের পিঠে। তারা মুখোমুখি না বসেও একে অপরের ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকাতে পারে। ‘ডিপ ফ্রিজ’ পেরেছে।
এখানে সম্পর্কের চিত্রনাট্য যখন সংলাপের ঠোঁট ছুঁয়েছে, অভিমানী চোখ তৈরি করেছে নীরবতার ভাষা।

আর সেই জায়গায় তৈরি হল এমন একটা যুগলবন্দী যা ‘ডিপ ফ্রিজ’কে মিলনাত্মক বা বিয়োগাত্মক ছবির অনেক উপরে তুলে নিয়ে গেল। অর্জুনের এই ছবি যেন বলল সেই কথাই:
“কেউ আমাকে শিরোপা দেয়, কেউ দু’চোখে হাজার ছি ছি
তবুও আমার জন্ম-কবচ, ভালোবাসাকে ভালোবেসেছি।
আমার কোনো ভয় হয় না, আমার ভালোবাসার কোন জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না”।

অর্জুন দত্ত আর আশীর্বাদ মৈত্র চিত্রনাট্যে আর সংলাপে ওঁদের হাত ধরে আত্মদীপ ভট্টাচার্য তিনাঙ্কে লিখেছেন অনুভবের স্বরলিপি। ওঁদের স্বরলিপিকে গানের রূপ দিয়েছে সুপ্রতিম ভোলের সিনেম্যাটোগ্রাফি আর সেই গান নিপুণ আঙুলে বাজিয়েছেন সম্পাদক সুজয় দত্ত রায়। সৌম্যঋতের সঙ্গীত হয়ে উঠেছে ন্যারেটিভের অংশ।

কখনও ভেবে দেখেছেন, প্রেম-কামনা-ভালবাসা আর বিপদ… সবকিছুর রং লাল কেন? ‘ডিপ ফ্রিজ’ কোথাও গিয়ে ‘প্রেম’ আর ‘ভালবাসা’র মাঝের সরু সরলরেখাকে রাঙিয়ে দিল আবির দিয়ে। আর কোনোরকম যৌনদৃশ্য ছাড়াই টুকরো টুকরো দৃশ্যে অনাবিল যৌনতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন অর্জুন। বলা যায়, লক্ষ্যভেদ করেছেন অর্জুন।

স্বর্ণাভর চরিত্রে আবির চট্টোপাধ্যায় অনবদ্য। তনুশ্রী চক্রবর্তী মিলি হয়ে উঠেছেন। এই ছবির ব্যালান্স নষ্ট হতে না দেওয়া রঞ্জা চরিত্রে অনুরাধা মুখোপাধ্যায় দারুণ। এই ছবির সাফল্য এই জায়গাতে যে স্বর্ণাভ, মিলি, রঞ্জা…কখনও কোনো চরিত্রকে দোষারোপ করার ইচ্ছে হবে না। মধ্যবর্তীনি ‘রঞ্জা’কেও নয়। এই ছবি যতটা না সহাবস্থান-সহানুভূতির কথা বলে, তার চেয়ে অনেক বেশি করে বলে সমাবস্থান-সমানুভূতির কথা। তাই বাবা স্বর্ণাভ আর স্বামী স্বর্ণাভ আলাদা হয়েছে, মা মিলি উল্টোদিকে বসে চোখ রেখেছে প্রেমিকা মিলির চোখে। তাই কোনও এক মুহূর্তেই মিলি যেন হয়ে উঠেছে অহল্যা। আর ছবির ক্লাইম্যাক্স বলে, ‘ডিপ ফ্রিজ’ যেন দিনের শেষে অহল্যার শাপমোচনের গল্প।

Advertisement