নির্মল ধর
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ প্রায় তিন বছর হতে চলল। এখনও ড্রোন ফাইটার বিমান শুধু রাজধানী কিয়েভ নয়, দোনেতস্ক, খারকিভ, লুহানস্ক ছোট-বড় সব শহর এবং অত্যন্ত গ্রামেও চলছে রুশ লাল সৈনিকদের দাপট। পিঠে দেওয়াল ঠেকলেও জেলেনস্কর নেতৃত্বে ইউক্রেনিয় সৈন্য তো বটেই, সাধারণ মানুষও দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছে।
আর ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী তো প্যালেস্টাইনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুই করেছেন গাজা শহরকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাতে প্রমোদ ট্যুরিস্টিক স্পট হিসেবে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত থামবে না। কারণ হামাস ৭ অক্টোবরের অতর্কিত আক্রমণে ১১৩৯ জন ইজরায়েলির মৃত্যু হয় এবং ২০০ জনকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে কব্জা করে।
সুতরাং নেতানিয়াহু সাহেব ভয়ঙ্কর গোঁসা করে রীতিমতো হুংকার দিয়ে বলেন, প্যালেস্টাইন নামের দেশটাকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে ‘মুছে’ না ফেলা পর্যন্ত ‘যুদ্ধ’ থামাবেন না। থামাচ্ছেন না। এখনও পর্যন্ত ৬২,০০০ প্যালেস্টাইনি এবং হামাসের প্রাণ নিয়েছেন তিনি। পেছনে সরাসরি মদত দিচ্ছেন ‘নব্য’ জেলেনস্কির বাক-যুদ্ধও চলছে! ট্রাম্প সাহেব নিজের দেশেও এখন বিরোধের মুখে। যে ‘আমেরিকা’ দেশটার জন্যই প্রায় সারা বিশ্বের অভিবাসীদের নিয়ে। যেখানে আমেরিকার প্রকৃত আদিবাসীরাই সংখ্যালঘু হয়ে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। হয়তো বা ডিএনএ খুঁজলে দেখা যাবে খোদ ট্রাম্পও একজন অভিবাসীর বংশধর। সেই ট্রাম্প এখন চাইছেন আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে জীবিকার খোঁজে যাওয়া কয়েক পুরুষ ধরে বসবাসকারী ‘আমেরিকান’দের বাস্তুচ্যুত করতে। এটাও তো মানবিকতার বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ। সত্যিই পৃথিবীর কোণে কোণে এখন যুদ্ধবাজরা দাঁত-নখ বার করে নিরীহ শান্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে শুধু রাজনৈতিক লড়াই নয়, সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমেছে।
কিন্তু প্রতিবাদ কোথায়? ক্ষীণ কণ্ঠে দু-একটি দুর্বল দেশ চিৎকার করলেও সেটা কারও কানে পৌঁছচ্ছে না। এমনকি জাতিসংঘে ‘যুদ্ধ-বন্ধ’-এর একাধিক প্রস্তাব জঞ্জালের বাক্সে ফেলে দিয়ে যুদ্ধবাজের দল নিজেদের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতেই এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ!
এমন একটি কঠিন মুহূর্তে কিঞ্চিৎ আশা ও ভবিষ্যতের আলো দেখতে ইউরোপের একাধিস দেশ ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ডের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে ইউক্রেন এবং প্যালেস্টাইনের কিছু সচেতন ফিল্ম কর্মী, সিনেমা পরিচালক এবং জনহিতের জন্য নিয়োজিত কিছু ফিল্ম প্রযোজনা সংস্থা। তাঁদের উদ্যোগেই তৈরি সাম্প্রতিক ছয়টি বিস্ফোরক তথ্যচিত্র দেখা যাবে এই কলকাতায়। যে ছবি কেন্দ্রীয় সরকারের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কাছে অচ্ছুৎ! এমনকি আমাদের কলকাতা ফিল্ম উৎসবও আন্তর্জাতিক সুসম্পর্কের দোহাই দিয়ে ছবিগুলোকে সরিয়ে রাখবে।
কিন্তু, কলকাতারই অগ্রণী ফিল্ম ক্লাব বা সংস্থা ‘পিপলস্ ফিল্ম কালেক্টিভ’ আসছে ১৫ আগস্ট এমন বাছাই করা ‘প্রতিবাদী’ ছয়টি ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে উত্তম মঞ্চে সারাটা দিন ধরে। তালিকায় রয়েছে গত বছর অস্কারজয়ী সেরা তথ্যচিত্র ‘টোয়েন্টি ডেজ ইন মারিউপোল’ (পরিচালক: স্মিতস্লাভ চেরনভ — ইউক্রেন), ল্যুইথের্যোর ‘দ্য স্টেলার্স’, রেইনবো কালেক্টিভের ‘টু কিল এ ওয়ার মেশিন’, এলিনর ওয়েবারের ‘দেয়ার উইল বি নো মোর লাইট’, ‘সঙস অফ দ্য স্লো বার্নিং আথ’ এবং গাই দাভিদির ‘ইননসেন্সে’ (ইজরায়েল), চেরনভের ছবির অস্কার প্রাপ্তি ছাড়া ‘টু কিল ও ওয়ার মেশিন’ (পরিচালক: হান্নান মাজিদ) এই জুলাই মাসেই ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এই ছবির প্রদর্র্শনীর ওপর। অথচ হান্নান মাজিদের এই ছবি দেখানো হয়েছে ভেনিস উৎসবে।
এবার দেখা যাক এই ছবিগুলোয় এমন কী দেখানো হয়েছে বা বলা হয়েছে, যা যুদ্ধবাজ আগ্রাসী, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আঘাত করছে! ল্যুই থের্যোর ‘দ্য স্টেলার্স’ দেখিয়েছে প্যালেস্টাইনের মধ্যে ‘ওয়েস্ট ব্যাংক’ নামের একটি অংশ সেই ছয়ের দশক থেকে গা-জোয়ারি করে দখল নিয়েছে ইজরায়েল। সেখানে প্যালেস্টাইনিরাও রয়েছে। কিন্তু ‘স্বভূমি’ তাঁদের অবস্থা প্রবাসী বা বেআইনি উদ্বাস্তুদের মতো। বিবরণ এলাকা দিয়ে এপার-ওপার করা যায় বটে, সেটাও পাসপোর্ট নির্ভর এবং ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন। এখানেই তিনি আরি এক রিসর্ট মালিক আব্রামোউইৎজ এবং এলাকায় ‘গডমাদার’ নামে পরিচিত ৭৯ বছরের ড্যানেয়োল ওয়াইজের দেখা পেয়েছেন, সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। এঁরা দু’জনেই স্পষ্ট কণ্ঠে বলেছেন, ‘প্যালেস্টাইনিদের কোনও অস্তিত্বই নেই!’ একধাপ এগিয়ে প্রায় প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় তাঁর গলায় ড্যানিয়েল ক্যামেরার সামনেই বলেছেন— ‘প্যালেস্টাইনিরা এই জায়গা ছেড়ে অন্য দেশে যাক। তুরস্ক থেকে কানাডা কত জায়গাই তো রয়েছে!’ মধ্য প্রাচ্যের ম্যাপ দেখিয়ে ড্যানিয়েলের বক্তব্য, ‘…এই যে লেবানন, জর্ডন, সৌদি আরব, ইরাক, সিরিয়ার একটা অংশ— সবই তো গ্রেটার ইজরায়েল!’ গাজা সীমান্তে ড্যানিয়েল ডব লিওর নামে এক রাব্বিকে (ইহুদী পুরোহিত?) দিয়ে বলিয়েছেন— ‘…এই পবিত্র ইজরায়েলের মাটি থেকে উট সাওয়ার’দের সরাতেই হবে।
প্যালেস্টাইনিদের বিরুদ্ধে ইহুদীর ক্ষেপিয়ে তোলার আরও একটি নমুনা মিলবে গাই ডাভিভি’র ‘ইননোসেন্স’ ছবিতে। পরিচালক গাই বলেছেন— ‘ইজরায়েল দেশটায় এবং তাঁদের জীবনযাত্রায় ‘সারল্য’ শব্দটার কোনও জায়গা নেই। ছোট্ট বয়সে কিশোরদের মানসিকতায় ‘সামরিকীকরণ’ করা হয়। অন্তত তিন বছর মিলিটারি বিভাগে কাজ করাটা ইজরায়েলি তরুণ-তরুণীর বাধ্যতামূলক। সামরিক শিক্ষার শুরু হয় স্কুলজীবন থেকেই। ইহুদী জাত্যাবোধের বীজ বুনে দেওয়া তাদের মনে। বাবা-মায়েরাও পরোক্ষভাবে ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক-সুন্দর জীবন থেকে জিয়নিস্ট ‘অস্মিতা’য় তাঁদের বড় করে তোলেন। এবং মিলিটারি সার্ভিসে গিয়ে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আস্ফালনের ব্যাপারটা মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এবং নেয়ও। ইজরায়েলে চলে পুরো সামরিক শাসন। তাই ভিন্ন মত ও প্রতিবাদী বাবা-মা কিংবা তরুণ সহজে মুখ খুলতে পারেন না।’ গাই ডাভিডি বুকে সাহস নিয়েই এই ছবিটা করছেন! অসংখ্য ইজরায়েলি তরুণ বয়সী সৈনিকদের ডায়রি উদ্ধৃত করে কিংবা তাঁদের বাবা-মা-পরিজনদের সাক্ষাৎকার নিয়ে গাই দেখাতে চেয়েছে ইজরায়েলি কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের জীবন থেকে স্বাভাবিক ‘সারল্য’ হঠিয়ে দিয়ে তাদের যুদ্ধবাজ, যুদ্ধোন্মাদ করে তোলা হয়।
চেরনভের ‘টোয়েন্টি ডেজ ইন মারিওপুল’ তৈরি হয়েছে রুশ শাসকের ইউক্রেন আক্রমমের শুরুতেই! সীমান্ত শহর মারিওপুলে আটকে পড়েছিল চিত্রসাংবাদিক স্মিতস্লাভ চেরনভ। তাঁর ক্যামেরাতেই প্রথম উঠে আসে রুশ আক্রমণের বিধ্বংসী ও জনক্ষয়ের প্রকৃত ছবি! অস্কার পুরস্কার নিয়ে সেই সন্ধ্যাতেই চেরনভ বলেছিলেন, ‘এই পুরস্কার নিতে আমি নিশ্চয়ই সম্মানিত বোধ করছি। অথচ আমিই বোধ হয় এই মঞ্চে প্রথম পরিচালক যিনি বলতে চাইছেন এই ছবি আমি বানাতে চাইনি।’ কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে দিয়ে এই ছবি করিয়ে নিয়েছে।’ তবে এটাও সত্যি যে সিনেমা, বিশেষ করে তথ্যচিত্র বা এই ধরনের প্রতিস্পর্ধী সিনেমা ‘কালেকশন অফ মেমরিজ’ আর মেমরিজই তৈরি করে বা লিখে চলে ইতিহাস!
আরও এক ইউক্রেনিয় পরিচালক ওলহা ঝুঠা দেখানো হবে তাঁর ছবি ‘সঙস অফ স্লো বার্নিং আর্থ’। ছবিটিকে বলা হয় ‘রুশ আক্রমণের প্রথম দু’বছরে কীভাবে প্রায় পুরো দেশটাই ধ্বংসের চেহারা নিয়েছিল তারই এক অডিওভিস্যুয়াল ডায়রি!’ দেশজুড়ে ধ্বংসের চেহারা ওলহার ক্যামেরায় যেন এক মেটাফিজিক্যাল ল্যান্ডস্কোপ! তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্মের তরুণরা কল্পনা করতে চাইছে এক অন্যতর ভবিষ্যতের। ঝুধার প্রথম ফিচার ‘আউটসাইড’ বার্লিনের হিউম্যান রাইটস ফিল্ম উৎসবে উইলি ব্র্যান্ডৎ পুরস্কার জিতেছিল। তাঁর এই নতুন ছবির জন্য সহযোগিতা করেছে চেক রিপাবলিকের মিশেল চাজকোভা, ফ্রান্সের ‘আর্ট’, ডেনমার্কের ফাইনান্স কার্য, সুইডেন এবং ইউক্রেনের ডারিয়া ব্যাসেল।
উৎসবে ‘ইননোসেন্স’ এবং ‘দ্য সেটলার্স’ যদি হয় ইজরায়েল পক্ষের ছবি, তাহলে রেইনবো কালেকটিভের হয়ে তোলা হান্নান মাজিদের ‘টু কিল এ ওয়ার মেশিন’কে প্যালেস্টাইনি পক্ষের ছবি বলতে পারেন কেউ। ‘প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’ নামের একটি দল আছে—যাঁরা গত পাঁচ বছর ধরে ইউকে’র বিভিন্ন অস্ত্রনির্মাণকারীদের কারখানায় চোরাগোপ্তা আক্রমণ করে জানিয়ে দিতে চায় তারা যেন ইজরায়েলকে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ না করে! এঁদের ছবি তোলার কৌশলটাও অন্যরকম। এঁরা বডি ক্যামেরা ব্যবহার করে। ফোন ফুটেজ নিয়ে আক্রমণ করে। এই ছবি দেখে স্বাভাবিক ভাবেই কিয়ের স্টার্মারের মন্ত্রিসভা বেজায়। ইউ-কে’তে এই ছবি নিষিদ্ধ। কিন্তু প্যালেস্টাইন অ্যাকশন গ্রুপ পিছু না হটে এই ছবির প্রদর্শনী করছে সারা ইউরোপ জুড়ে, বিভিন্ন ফিল্ম উৎসবে। আনন্দের খবর, এবার আসছে কলকাতায়ও।
‘আমার নাম তোমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’ স্লোগান হারিয়ে গেছে এই শহরের ইথার থেকে। এখন আর ইউক্রেন বা প্যালেস্টাইন নিয়ে তেমন বড় রকমের মিছিল দেখা যায় না! হয়তো আমরা ‘যথার্থ’ আন্তর্জাতিক হয়েছি, নতুবা বিশ্বায়নের ফাঁস গলায় জড়িয়ে আত্ম-অস্মিমাতার শামুকি খোলসের নিরাপদে নিজেদের ‘টিকিয়ে’ রাখতে ব্যস্ত সবাই! এই ছবিগুলো দেখার পরও জানি কিছু ঘটবে না। আর এও জানি অন্ধ বলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে!