প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় নজর দিতে হবে

প্রতীকী ছবি (Getty Images)

বার্ধক্য কোনও রােগ বা অসুস্থতা নয়,জীবনের সর্বশেষ পর্যায়,যা অবধারিত এবং অলঙঘনীয়।জীবনভর আমরা কেউই বুড়াে হতে চাই না,বয়সের ছাপ দেখাতে চাই না,বরং নানা প্রসাধনীর আড়ালে চেহারায় জৌলুস আনতে কার্পণ্য করি না।কিন্তু বার্ধক্য বড়ই নিষ্ঠুর।আমাদের সব উদীয়মান চিন্তাভাবনা তছনছ করে দেহে-মনে,সমাজ-সংস্কারে,রাষ্ট্রে-বিশ্বে সুকরুণভাবে বার্ধক্য তার নির্মম ও সরব উপস্থিতি তুলে ধরে।১৯২১সালের ২০বছরের গড় আয়ুধারী বঙ্গবাসী এখন এই ভারতে প্রায় ৭০-৮০ বছর অবধি দিব্যি বেঁচে থাকছেন।দুঃখজনক ঘটনা হল,প্রবীণরা আজ ভালাে নেই।তাদের অনেকেই নিজেদের বাড়িতে বা পরিবারে নানা ধরনের নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন হয়ে শারীরিক ও আবেগীয় নানা সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছেন।প্রবীণদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনের মাত্রাও যেন বেড়ে চলেছে।এ বিষয়ে প্রয়ােজন সবার সক্রিয় নজরদারি।অবাক ব্যাপার হল,প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে হামেশা সংগঠিত হওয়া এ ধরনের অবহেলা,নিপীড়ন বা বিকৃত আচরণকে সমাজের সবাই মামুলি,গুরুত্বহীন,ব্যক্তিগত এবং এমনকী নিয়তির স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করে থাকে।

বিজ্ঞান প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষে এসেও বিশ্ব সমাজে মানুষ যেন শান্তিতে নেই,স্বস্তিতে নেই,সুরক্ষায় নেই।বিশ্ববাসীর গৌরবােজ্জ্বল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবােধ,বিশ্বস্ততা,অধিকার,পরম সহিষ্ণুতা,ধৈর্য-সহ্য ইত্যাদি মানবিক গুণ ক্রমে যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে।সার্বভৌমত্ব,মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের কথা উচ্চারণ করলেও লিঙ্গ,ধর্ম,বর্ণ,গােত্র,প্রতিবন্ধকতা,অবস্থান ইত্যাদি যেন সদা সর্বত্র ক্ষমতাবানদের বিবেচ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে।এতে প্রবীণ,প্রতিবন্ধী,দুঃস্থ নারী ও শিশু সংখ্যালঘু আর হতদরিদ্ররা ক্রমেই ভীষণ অসহায় এবং অতি ঝুঁকিতে পতিত হচ্ছেন।অবস্থার উন্নয়নে সুদীর্ঘ দিনের নির্মোহ অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রবীণরাই আমাদের পথের দিশা দেখাতে পারেন।সংগত যুক্তিতে বলা হয়,’প্রবীণের যুক্তি আর নবীনের শক্তি,এই দুয়ে মিলে সমাজের মুক্তি’।

প্রবীণদের চ্যালেঞ্জগুলাে মুলত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট,কর্মসংস্থান ও আয়-উপার্জন সংক্রান্ত,সমবয়সীদের সাহচর্য বিষয়ক এবং পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক।প্রসঙ্গত জাতিসংঘ বলছে,কাউকে পিছনে ফেলে রেখে নয়,বরং সবাইকে নিয়েই বিশ্বসমাজের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে হবে।প্রবীণদের আছে গৌরবােজ্জ্বল অভিজ্ঞতা,দক্ষতা,নৈপুণ্য আর লাগসই সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্মোহ সামর্থ্য।প্রবীণদের এসব মেধা এবং সম্পদ কাজে লাগিয়ে সবার জন্য মর্যাদা আর অধিকারভিত্তিক সমাজ গড়তে পারলে আমরাই উপকৃত হব।


ভারতের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি।এর নির্দয় প্রভাবে প্রবীণ-প্রবীণারা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।গ্রামীণ ও নিম্নবিত্ত পরিবারে এদের অনেকেই আজ ঘর থেকে বারান্দায়,বারান্দা থেকে গােয়ালঘরে এবং সবশেষে রাস্তায় অপসারিত হচ্ছেন।সচ্ছল ও ধনী প্রবীণরা সামাজিক নিরাপত্তা এবং বিশ্বস্ত সেবাকর্মী ও অত্যাবশ্যক সেবা সরবরাহের অনিশ্চয়তায় চরম বিড়ম্বনার মুখােমুখি হচ্ছেন।ধনী পরিবারের প্রবীণদের ঠাই হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।আগামীতে দেশের ভূমি আরও কমতে থাকবে,বাড়বে ফ্ল্যাট কালচার আর প্রবীণজনদের ভােগান্তি জটিলাকার ধারণ করবে।তাই পরবর্তী ৫০- ১০০ বছরের অবস্থা মাথায় রেখে আগামীর বিরাট সংখ্যক প্রবীণদের জন্য স্বস্তিময় এবং আরামদায়ক আধুনিক আবাসন গড়ে তােলার দুরদর্শী উদ্যোগ নিতে হবে।বার্ধক্য মােকাবিলায় সরকারি উদ্যোগে নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা এবং অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলাের সংশ্লিষ্টায় বার্ধক্য বিমা বা সামাজিক নিরাপত্তার কৌশল হিসেবে সর্বজনীন নাগরিক পেনশন ব্যবস্থার প্রচলন করা এখন সময়ের দাবি।যেমন তিরিশ বছর বয়স হলে প্রত্যেক নাগরিক তাদের ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ভিত্তিতে মাসিক বা বার্ষিক প্রিমিয়াম জমা দেবেন এবং ৬০বছর বয়স হলে বা বার্ধক্যে পৌছে ব্যক্তি ওই বিমার সুবিধা ক্রমাগত ভােগ করতে থাকবেন।বর্তমানের গ্রামীণ এবং অতি দরিদ্র প্রবীণদের ২-৫ বছরের প্রাথমিক প্রিমিয়াম সরকারের চলমান বয়স্ক ভাতা খাত থেকে পরিশােধের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।

এভাবে শুরু করলে আশা করা যায়,অদূর ভবিষ্যতে বয়স্ক ভাতা হিসেবে সরকারি বরাদ্দের পুরােটাই বার্ধক্য বিমা ব্যবস্থার আওতায় চলে আসবে।এতে রাষ্ট্রের ওপর ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপ যেমন লাঘব হবে,পাশাপাশি নাগরিকদের বার্ধক্যের সফল প্রস্তুতি,অংশীদারিত্ব এবং সমাজে তাদের অধিকারভিত্তিক প্রাপ্য মর্যাদাও নিশ্চিত হবে।

উল্লেখ্য, ব্যাঙ্ক,বিমা এবং সংশ্লিষ্ট অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলাে অত্যন্ত লাভজনক এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বলেও আমরা মনে করি।

প্রবীণবান্ধব এবং সব বয়সীর জন্য সমান উপযােগী দেশ গড়ে তুলতে হলে সরকারি পর্যায়ে আরও যেসব উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করা উচিত হবে,তা হল-

১) প্রবীণকল্যাণ বিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় স্থাপন করে জাতীয় প্রবীণ বিচক্ষণ উদ্যোগ গ্রহণ করা । ২) প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইন পাশ করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা।

৩)প্রবীণদের জনভিত্তিক,আর্থ সামাজিক এবং স্বাস্থ্যগত তথ্যের একটি জাতীয় ডেটাবেস তৈরি করা।

৪)প্রবীণদের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী নানা ধরনের সহজলভ্য স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা চালু করা।

৫)দেশের প্রবীণদের সার্বিক সুরক্ষায় বাস্তবমুখী কর্মসূচি হাতে নেওয়া।

৬)দেশে প্রচলিত সব সাধারণ ও পেশাগত শিক্ষা কার্যক্রমে বার্ধক্য ও প্রবীণদের সেবা বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা।

৭)সব গণমাধ্যমে বার্ধক্য ও প্রবীণদের বিষয়ে ইতিবাচক এবং অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকারী প্রােগ্রাম চালু করা।

৮) প্রতিবন্ধী,আর্টিস্টিক,সমাজবিচ্ছিন্ন ইত্যাদি শ্রেণির প্রবীণদের জন্য বিশেষ সেবা ব্যবস্থার আয়ােজন করা।

৯)প্রবীণদের জন্য সরকারি আবাসন গড়ে তােলা এবং বার্ধক্য বিমা চালুর জন্য অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী করা।

১০)হতদরিদ্র এবং গ্রামীণ প্রবীণদের সুরক্ষায় স্থানীয় পর্যায়ে স্বনির্ভর কর্মসূচি গ্রহণ করা।

১১)অতি প্রবীণদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী যত্ন (Long Term Care)এবং যাতনা প্রশমন সেবা(Paliative Care)গড়ে তােলা।

উপযুক্ত কর্মসূচি গ্রহণ,বাস্তবায়ন এবং তা দীর্ঘমেয়াদী করার ক্ষেত্রে প্রবীণদের অভিজ্ঞতা,মেধা এবং অংশগ্রণ খুবই প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য।আসুন কর্মময়,স্বস্তিময় এবং সফল বার্ধক্যের স্বার্থে আমরা আন্তরিকভাবে সক্রিয় হই এবং সবার বাসযােগ্য অনিন্দ্যসুন্দর দেশ গড়ে তুলি।