জয়া চৌধুরী
সেদিন গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন ছিল। ১৯৭৩ এর ১১ সেপ্টেম্বর। কারণ দুপুরবেলা প্রেসিডেন্ট আইয়েন্দে জাতির প্রতি “জরুরী জাতীয় অর্থনীতি” বিষয়ে একটি বক্তৃতা দেবেন স্থির করেছিলেন। তারপরে একটি গণভোটের আহ্বান জানাবেন যাতে দেশবাসী বেছে নিতে পারেন সরকার গৃহীত পথ এবং বিরোধী পক্ষ প্রস্তাবিত পথের মধ্যে যে কোনও একটিকে।
সেদিন সকাল থেকেই আপনি প্রেসিডেন্ট ভবনে ছিলেন…
১০ তারিখ রাতে একটা মিটিং ছিল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যেটা রাত দেড়টায় শেষ হয়। সেখানে ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অর্লান্দো লেতেলিয়ের, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কার্লোস ব্রিওন, ও জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল অধিকর্তা আগুস্তো ওলিভারেস। পরদিন রাষ্ট্রপতি আইয়েন্দে কী ভাষণ দেবেন তার প্রস্তুতি চলছিল। আমাকে রাতে ভবনেই থাকতে হয়েছিল কেননা আমাদের মিটিং সেদিন শেষ হয়নি। পরদিন ভোরেই বাকিটা হবার কথা ছিল। কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেলের ডিরেক্টর আমাকে সকাল সোয়া সাতটায় ডেকে তুললেন এই বলে যে ভালপারাইসো বন্দরে একটি অশান্তি হয়েছে।
তখন…
তখন আমরা প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে নিয়ে ভবন থেকে প্রাসাদে পৌঁছলাম। প্রেসিডেন্ট ঘরে পৌঁছলেন এই সংবাদ নিয়ে যে, আর্মি রাষ্ট্রপতির প্রতি অনুগত আছে। এবং সাংবিধানিক উপায়ে রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করবার জন্য প্রয়োজনীয় স্থানে তাদের পজিশন নিয়ে নিয়েছে। সময় যত এগোতে লাগল সংবাদ এলো ততক্ষণে অভ্যুত্থান এগিয়ে আসছে। সকাল সাড়ে আটটায় যৌথ বাহিনীর ফার্স্ট কমান্ড্যার এসে প্রেসিডেন্টকে বললেন তিনি যেন তাঁর রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে মিলিটারি বাহিনীর প্রধান হবার বৈধতাগুলি সমর্পণ করেন বাহিনীর কাছে। এবং অবধারিত ভাবে প্রেসিডেন্ট আইয়েন্দে রাজি হন না। সকাল নটা নাগাদ প্রেসিডেন্ট তাঁর শেষ বক্তৃতা দিলেন। এবং সেটি শেষ হওয়া মাত্র বাহিনী আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সাঁজোয়া বাহিনী দিয়ে আর আকাশপথে আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। যার ফলে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ ধোঁয়া আর ধুলোয় ভরে যায় এমন ভাবে যে, শ্বাস নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট তাঁর সমস্ত সহকারীকে বলেন প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যেতে, কারণ সেখানে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
আপনি? পুরোটা সময় ওখানেই ছিলেন?
হ্যাঁ ওখানেই। সারা সকাল সোয়া এগারোটা পর্যন্ত আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গেই ছিলাম যতক্ষণ না তিনি আমায় চলে যেতে বলেন। আর এভাবেই আমি নিজের প্রাণ বাঁচাই।
ঠিক কীভাবে বলেছিলেন তিনি কথাগুলো?
সকাল এগারোটা নাগাদ তিনি তাঁর সব অনুগামী অফিসারদের একজায়গায় ডেকে আনলেন। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে নিজের দায়িত্বের কথা এবং বাকিদের দায়িত্বের কথা বললেন। কিন্তু ততক্ষণে তাদের সকলেই মারা গিয়েছিল। তাই এসবের কোনো অর্থ ছিল না। আমরা তাই মুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক সেইসময় তিনি আমার দিকে ঘুরে তাকালেন। বললেন আমি যেন বেরিয়ে যাই। জানি না কেন তিনি এ নির্দেশ আমাকেই দিলেন। ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম এ জায়গা ছেড়ে আমি কেন বেরিয়ে যাব। তিনি আমায় বোঝালেন। সেসব কারণের একটা হল, ভবিষ্যতে দুনিয়ার লোকদের এই ঘটনাগুলো জানানোর জন্য কেউ তো থাকবে। “কেবল তুমিই এ কাজ করতে পারো”— বললেন। আমাকে তিনি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তাই আজ আমি বেঁচে আছি।
ওঁকে ছেড়ে আসার জন্য কখনও কি অনুশোচনা হয়েছিল আপনার?
অনুশোচনা করা তো সম্ভব নয়। কেননা তার ফলেই তো আজ আমি বেঁচে আছি। আপনাকে একটা ঘটনা বলি। অভ্যুত্থানের দু’দিন পরে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানের ইকোনমিক কমিশনের ডিরেক্টর জেনারেল এনরিকে ইগলেসিয়াস, অভ্যুত্থানে বিদেশ দফতরের নেতা অ্যাডমিরাল উয়ের্তাকে আমার সঙ্গে মধ্যস্থতা করতে বলেন। ওকে বলেন সেই মুহূর্তে দুটো মানুষকে উনি খুঁজছেন গ্রেফতার করার জন্য। একজন হলেন কার্লোস আলতামিরানো, চিলের সোশ্যালিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল আর অন্যজন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা— এই আমি। আসল কথাটা হল ১৩ তারিখে ওদের আর্মির যে মিটিং হয় সেখানেও আমাকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এটুকুই বলার যে, আইয়েন্দে দৃশ্যত আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে। চিলের রাজধানী সান্তিয়াগোর একটি সংবাদ সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। সারা বিশ্বের বামপন্থী নেতাদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয়, সমাজতান্ত্রিক নেতা হিসাবে বিশ্বের প্রথম ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসা প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আইয়েন্দে নিজের বাসভবনে আত্মহত্যা করলেন। তাঁরই মিলিটারি বাহিনীর প্রধান আগুস্তো পিনোচে তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। কিন্তু সে আত্মহত্যা কি তিনি ভয়ে করেছিলেন? অথবা তিনি কি প্রতিরোধের শেষ পন্থা হিসাবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন এই পথ? ২০২৩ সালে বিবিসির সাংবাদিক ফেরনান্দা পাউল স্পেনের মাদ্রিদে চিলের প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আইয়েন্দের প্রধান পরামর্শদাতা খোয়ান গারসেসের সঙ্গে এ উপলক্ষ্যে আলাপচারিতা করেছিলেন। উপরের কথোপকথনটি সেখান থেকেই নেয়া। কথোপকথনের সময়েও ওঁর ঘরের টেবিলে রাখা ছিল ১৯৭২ সালে তোলা একটি ফটো। সেখানে গারসেসের সঙ্গে সালভাদোর আইয়েন্দে স্বয়ং এবং চিলেয় নিযুক্ত তৎকালীন স্পেনের রাষ্ট্রদূত অস্কার আগুইয়েরোর ছবি ছিল। সে বছরই চিলে তথা লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় বামপন্থী রাষ্ট্রপতি সালভাদোর আইয়েন্দের প্রয়াণের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আজ বুঝতে চেষ্টা করা চিলের বুকে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটিকেই।
আজকের এই ২০২৪ সালে প্রায় কুড়ি কোটি মানুষের দেশ প্রজাতান্ত্রিক চিলেয় গণতন্ত্র আবার প্রতিষ্ঠিত। বহু ঘাত প্রতিঘাত পার হয়ে দেশটিতে শাসন করছে লিবেরিটারিয়ান সোশ্যালিস্ট নেতা, প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল বরিক। দেশের তরুণতম এই নেতার (৩৮ বছর বয়স) নেতৃত্বে চিলের সবক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটে চলেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আইয়েন্দে যখন নির্বাচিত হয়েছিলেন তৎকালীন চিলেয় পরিস্থিতি কেমন ছিল? সেসময় ঠান্ডা যুদ্ধের পৃথিবী। সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথে বিশ্ব রাজনীতি টালমাটাল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে তিনি চিলের প্রথম সোশ্যালিস্ট প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কিন্তু এইখানে বুঝতে হবে তাঁর বাস্তব পরিস্থিতির কথা। তার আগে সে সময় চিলেয় ক্ষমতায় ছিল ডানপন্থীরা। সিআইএ বিশেষ ভাবে ক্রিয়াশীল ছিল যাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী শক্তিরই আবার জয় হয়। সেবারকার নির্বাচনে কনজারভেটিভ আর লিবারাল— দু’পক্ষের ভোটেই নির্বাচিত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি খোর্খে আলেসসান্দ্রি পেয়েছিলেন পঁয়ত্রিশ শতাংশ ভোট আর তৃতীয় স্থানের প্রার্থী পান সাতাশ শতাংশ। আর আইয়েন্দে পান মাত্র ছত্রিশ শতাংশ ভোট। সে দেশের সংবিধান অনুসারে এরকম পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত ভাবে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন সে দেশের কংগ্রেস তাঁকেই প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে থাকেন। কিন্তু মিলিটারি বাহিনী তখনো আইয়েন্দেকে সমর্থন করতে পারছিল না। এরকম পরিস্থিতিতে সেনেটও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না কাকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করবে। এক মাস কেটে যায় সিদ্ধান্তহীনতায়। এমন সময় চিলের আর্মি কমান্ডার রেনে শ্নেডারকে আততায়ীরা হত্যা করে। রেনে ছিলেন “আর্মি রাজনীতিতে নাক গলাবে না” এই ধারণার সমর্থক। কিন্তু রেনের মৃত্যু আর্মিকে কিছুটা টলিয়ে দেয়। আইয়েন্দের প্রতি সমর্থন করার অনিচ্ছা থেকে তারা নিজেদের সরিয়ে নেয়। সেসময় বিদায়ী প্রেসিডেন্ট এদুয়ারদো ফ্রেই, রোবেরতো ভিয়াউক্সকে আর্মি প্রধান হিসাবে রেনের স্থলাভিষিক্ত করেন। ফ্রেই ছিলেন দক্ষিণপন্থী জোটের নেতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ পছন্দের নেতা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সালভাদোর আইয়েন্দে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে চুক্তি করেন। তাঁদের সঙ্গে তিনি Statute of Constitutional Guarantees আইনে সাক্ষর করে, তাদের সমর্থন নিয়েই রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেন। সুতরাং সত্যের খাতিরে একে নিরঙ্কুশ ভাবে জয়লাভ করে প্রেসিডেন্ট হওয়া কোনোভাবেই বলা যাবে না।
১৯৫২ সাল থেকে আইয়েন্দে সে দেশের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হবার জন্য প্রার্থী হয়েছেন। ১৯৫২, ১৯৫৮, ১৯৬৪ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পরাজিত হয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭০ সালে এই পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। চিলেয় এই দীর্ঘ সময়কালে যে গণতান্ত্রিক রেজিম চলেছিল তা নানা দিক থেকেই সে দেশকে ক্রমাগত উন্নতির পথে নিয়ে গেছে। এক বৃহৎ সংখ্যক নাগরিককে রাজনীতির মূল স্রোতের অঙ্গীভূত করেছিলেন। ১৯৫২ সালে দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা নির্বাচনে ভোটাধিকার পেলেন। ১৯৬৪ সালে ভোটাধিকার দেয়া হল ১৮ ও তদূর্ধ্ব তরুণ সমাজকে। এমনকী বিকলাঙ্গদেরও ভোটাধিকার দেয়া হল। এই পরিবর্তন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। আসলে ১৯৩২ সাল থেকে আইয়েন্দের আত্মহত্যা পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০ বছর ছিল চিলেয় গণতান্ত্রিক রেজিম। এই সময়কালেই আধুনিকীকরণ হয়েছিল সে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মহলের। মনে রাখতে হবে চিলে থেকে সাহিত্যে যে দু’জন মাত্র নোবেল পদক লাভ করেছিলেন তাঁরা দুজনেই এই সময়কালের অর্জন। ১৯৪৫ সালে গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং ১৯৭১ সালে পাবলো নেরুদা।
প্রকৃতপক্ষে চিলেয় যে গণতন্ত্র শুরু হয়েছিল ১৯৩২ সাল থেকে তা চূড়ান্ত সাফল্যে পৌঁছায় আইয়েন্দে ১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর। জনসাধারণের দাবী ছিল মূলত চারটি— তামার খনিগুলির জাতীয়করণ, কৃষিসংস্কার, সামাজিক ক্ষেত্রটি বাড়ানো এবং অর্থনীতির মিশ্রণ ঘটানো। প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি সে দিকেই মন দিয়েছিলেন। প্রথমেই ঘোষণা করেন এবার চিলে La via chilena al socialismo অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের দিকে চিলিয়ান পথ নেবে। এবং তিনি প্রথমেই বেশ কিছু সংস্কার নীতি নিলেন। তার মধ্যে বৃহৎ শিল্পগুলিকে রাষ্ট্রীয়করণ করে দিলেন। বিশেষ করে তামা এবং ব্যাংকিং সিস্টেম। পাথুরে ও কর্কশ আবহাওয়ার দেশ চিলেতে তামার জোগান অফুরান।
অন্যদিকে দরিদ্রতম শ্রেণীর উন্নতির জন্য নতুন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বা পাবলিক- ওয়ার্ক প্রোজেক্ট ঘোষণা করতে লাগলেন যাতে গরীবদের কর্ম সংস্থান হয়। অজস্র জনকল্যাণকারী নীতি নিতে শুরু করলেন যার মধ্যে মাপুচের মত পশ্চাৎপদ জনজাতির জন্য বৃত্তি চালু করা, প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কর বৃদ্ধি রদ ঘোষণা, আসন্ন-প্রসবা মায়েদের নিখরচায় দুগ্ধ প্রদান, রুটির দাম স্থির করে দেয়া থেকে শিক্ষার সম্প্রসারণে আধ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা যাদের কাজ অংক সহ প্রাথমিক প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান করা, চিকিৎসা পরিষেবা কম খরচে বা বিনা খরচে ছড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি অসংখ্য কাজ। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দিলেন সারা দেশে। অন্যদিকে করের বোঝা কমানোয় মধ্যবিত্ত শ্রেণী উপকৃত হচ্ছিল। সারা দেশে অর্থনীতি এমন প্রভাবিত হয়েছিল যে সে দেশে এক বছরে (১৯৭০ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে) মানুষের ক্রয়ক্ষমতা প্রায় আঠাশ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল এক লাফে। কিন্তু পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতিও বেড়ে চলছিল। আইয়েন্দে এবার কৃষি সংস্কার নীতি গ্রহণ করলেন। কৃষিক্ষেত্রে চিলে বরাবরই আমদানি করা খাদ্যপণ্যের উপর নির্ভর ছিল। কিন্তু সংস্কারের পরে এখন তা আরো বেড়ে যাচ্ছিল। ওদিকে চিলের প্রধানতম রপ্তানি দ্রব্য তামার উৎপাদন হু-হু করে কমে যাচ্ছিল। আগে যদি রপ্তানি ছেষট্টি শতাংশ থাকত এখন তা নেমে আটচল্লিশ শতাংশে এসে পৌঁছেছিল।
ঠিক সেইসময় কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো চিলে সফর করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিউবার সম্পর্ক তখন খুব খারাপ ছিল। ফিদেলের চিলে সফর হয়েছিল ১০ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে। টানা তেইশ দিন তিনি সেদেশে ছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ৪৫ জন সদস্যের একটি দল। সেখানে থাকাকালীন কোথায় না যাননি তিনি! তামা, কয়লা, ও অন্যান্য খনি অঞ্চল থেকে কারখানা সর্বত্র পরিদর্শন করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট আইয়েন্দে ও ফিদেলের মধ্যে বন্ধুত্বের গভীর বন্ধন দেশটিকে উন্নতির পথে নিয়ে যাবার জন্য নানাবিধ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছিল। সে বছরেই নোবেল পেয়েছিলেন পাবলো নেরুদা। সত্তর হাজার মানুষের সামনে স্টেডিয়ামে প্রেসিডেন্ট আইয়েন্দে তাঁকে গণ সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। নেরুদার সঙ্গে গভীর প্রীতির সম্বন্ধ ছিল তাঁর। এমনকী এর আগে ১৯৬৯ সালে তাঁর হয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রচারও করেছিলেন নেরুদা। এসব কাহিনীই হল আনন্দের, সুখে ও উন্নতির কাহিনী।
কিন্তু সালভাদোর আইয়েন্দের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল কবে? এবং কীভাবে? সে কথা বলতে গেলে আবার ফিরে যাব ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে। কেননা প্রেসিডেন্ট পদে আইয়েন্দে যাতে শপথ না নিতে পারেন তার জন্য মার্কিন সংস্থা সিআইএ অত্যন্ত ক্রিয়াশীল ছিল সেই ১৯৭০ সালে নির্বাচনের সময় থেকেই। ২০০০ সালে প্রকাশিত তথ্যে সিআইএ-র পক্ষ থেকে সে কথা স্বীকার করেও নেয়া হয়। পাঠকের মনে থাকবে এই নিবন্ধের শুরুর দিকেই শ্নেইডারের মৃত্যুর কথা জেনেছিলাম আমরা। আসলে শপথ গ্রহণের আগেই তারা তৎকালীন আর্মি প্রধান রেনে শ্নেইডারকে প্রস্তাব দিয়েছিল অভ্যুত্থান ঘটানোর। তিনি অস্বীকার করেন সে প্রস্তাব। তার পরেই তাকে হত্যা করে আততায়ীরা। এ ঘটনাতে আর্মির পক্ষেও সালভাদোর আইয়েন্দের পক্ষে দাঁড়াতে সিদ্ধান্ত নিতে আর অসুবিধা হয়নি। ১৯৭৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর মাঝরাত থেকেই অভ্যুত্থানের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। আইয়েন্দে খবর পেলেন তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হতে পারে। তিনি তাঁর সব নেতা মন্ত্রী বন্ধু অনুগামীদের পরদিন সকালে বাসভবনে ডেকে পাঠালেন। সকাল ছ’টায় ভাল পারাইসোতে অভ্যুত্থান শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপতি ভবন
লা মোনেদা-তে পৌঁছেই প্রথমে খোঁজ নেন সেনাধ্যক্ষ আগুস্তো পিনোচে কোথায়?
বিশিষ্ট খ্রিস্টান নেতা খাইমে গাসমুরি যিনি ক্যাথলিক বাম নেতা হিসাবে ক্ষমতাশালী জোট উনিদাদ পপুলার গঠনে মধ্যস্থতা করেছিলেন, ১৯৯৮ সালে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন— “আইয়েন্দে অন্তত একমাস আগে থেকে জানতে পেরেছিলেন বিরাট বিপর্যয় আসতে চলেছে, এক মিলিটারি অভ্যুত্থান হতে চলেছে। এবং আর্মির সমস্ত স্তর থেকে এর সপক্ষে সায় রয়েছে। কিন্তু তিনি নিজেও পালিয়ে না গিয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।” প্রাসাদের কুড়ি কিলোমিটার দূরে তখন পিনোচে। তিনি তাঁর বিমান বাহিনী প্রধান গুস্তাভো লেই এবং সামরিক প্রধান খোসে তোরিবিওকে বাহিনীর সামনে সালভাদোর আইয়েন্দের উদ্দেশে চাঁছাছোলা নির্দেশ দিলেন “নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, কোনো সংসদীয় কচকচি নয়”। ১৫/২০ জন্য বিশ্বস্ত বন্দুকধারী দেহরক্ষী ছিল আইয়েন্দের। আর ছিল প্রচুর সৈন্য। তাদের প্রস্তাব দেয়া হল হয় মরো নাহয় প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাও। অধিকাংশই একে একে প্রাসাদ ছেড়ে প্রেসিডেন্টকে ছেড়ে চলে গেল। এমনকি রক্ষীবাহিনীর নেতা সেপুলভেদাও। প্রধান পরামর্শদাতা খোয়ান গারসেসও চলে যান। কিন্তু যাই হোক আইয়েন্দে তারপর তাঁর কন্যা ও সচিব বেয়াত্রিসকে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে বলেন, রাষ্ট্রপতির সংবাদমুখ্য ফ্রিদা মোদাকের সঙ্গে তাঁকে কিউবার হাভানায় পালিয়ে যেতে বলেন। সে ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছিলেন।
অবশিষ্ট ছিলেন গোয়েন্দা প্রধান এদুয়ারদো পারেদেস এবং সাংবাদিক আগুস্তো অলিভার। তাঁদের পরিণতিও আইয়েন্দের মতই হয়েছিল। সাড়ে এগারোটা থেকে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ লা মনেদা থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করে। এবং শুরু হয়ে বোমা বারুদ বিস্ফোরণ। এই আগুন বোমার মাঝখানেই প্রেসিডেন্ট রেডিও মাগাইয়েনকে তাঁর শেষ বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যার অন্তিমে ছিল এই বাক্য— “সেদিন দেরী নেই খুব বেশি যেদিন মুক্ত মানুষেরা পথ খুঁজে নেবে উন্নত সমাজ গড়বার”। সেখানে উপস্থিত মানুষেরা পরবর্তীকালে বলেছিলেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিরন্তর গুলি বোমার ধোঁয়ায় প্রাসাদ হয়ে উঠেছিল নরক। নিঃশ্বাস নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। বিকেল তিনটের সময় সব প্রতিরোধ শেষ হল।
প্রথমটায় নানারকম সংবাদ আসছিল। কেউ বলছিল তাঁর শরীরের ঊর্ধ্বাংশে ১৩টা গুলি ঢুকেছিল, কেউ বলছিল হাতে ও মাথায় একটি করে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল… ইত্যাদি। অনেক পরে ফিদেল কাস্ত্রো স্বয়ং ঘোষণা করেন— “সালভাদোর আইয়েন্দে শেষ নিঃশ্বাস অবধি সিংহের মত লড়াই করেছেন। তাঁকে অভ্যুত্থানের নেতারা হত্যা করেছে না তিনি আত্মহত্যা করেছেন— এ দুই তথ্যের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। কেউ বলছেন শেষ গুলি তিনি নিজেই নিজেকে করেছেন যাতে বন্দী না হতে হয়। আবার কেউ বলছেন শত্রুর গুলিতেই তিনি মারা গেছেন। প্রাসাদে ট্যাংক ও হেলিকপ্টার থেকে বোমা বর্ষণে ছারখার করা হয়েছে বিনা বাধায়। দুটি ভাবেই এই লড়াইয়ের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই”।
এই হত্যা না আত্মহত্যা বিতর্কে অধিকাংশ নেতাই বলেছেন নিঃসন্দেহে আত্মহত্যা। তাঁর বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ দেখে হত্যা বলবার কোনো যুক্তি নেই। কেননা অভ্যুত্থানের সংবাদ তিনি আগেই পেয়েছিলেন। সমস্ত অনুগামীকে তিনি সরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পলাতক হয়ে জীবন বাঁচানোর বদলে যে রাজনীতিতে তাঁর বিশ্বাস ছিল দেশের প্রতি সেই বার্তা রেখেই মারা গিয়েছিলেন, পালানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও। অবশ্য চার দশক পরে ২০১১ সালে নানা তদন্ত করবার পর চিলের আদালত মৃত্যু বিষয়ে রায়দান করেছেন যে, মস্তিস্কে একে-৪৭ রাইফেলের গুলি তীব্র গতিতে প্রবেশ করার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আইয়েন্দে আত্মহত্যা করেছিলেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী স্বনামধন্য লেখিকা ইসাবেল আইয়েন্দে, সোশ্যালিস্ট দলের সেনেটর হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। একটি বিচারালয় সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে তাঁর বীরত্ব এবং বিশুদ্ধতা চলে যায়নি। তিনি স্বেচ্ছায় এ অবস্থায় নিজেকে এনেছিলেন, কেননা তিনি শত্রুর হাতে অপমানিত হতে চাননি। মানুষের পক্ষে যতটা সম্ভব তিনি ততটাই প্রতিরোধ করেছিলেন। এটা গর্বের বিষয়”। সমাজতত্ত্ববিদ আলফ্রেদো খোইগ্ন্যান্ট-এর কথা দিয়েই লেখাটি শেষ করি। “আইয়েন্দের মৃত্যু এত বিরল, এতই মহৎ যে ঐতিহাসিকভাবেই ব্যতিক্রমী। সত্যিকারের বিরল ঘটনা। এক অর্থে এটা এমন সংকটময় মুহূর্ত যেখানে তিনি নিহত না আত্মহত্যা করেছেন তাতে কিছু যায় আসে না। তাঁকে মরতে হত, তিনি মৃত্যু বরণ করেছিলেন। সমস্ত পারিপার্শ্বিক তথ্য বলছে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। এতে কি তাঁর বিশ্বময় যে ভাবমূর্তি ছিল তাতে কোনও পার্থক্য ঘটেছে? একেবারেই নয়। তাঁর নায়কত্ব ও রাষ্ট্রপতি হয়ে শহীদ হওয়া দুটি বিষয়ই সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত প্রথমদিন থেকে।”
আগুস্তো পিনোচে এরপর চিলের সর্বময় কর্তা হয়ে ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তাঁর শাসন চলে। চিলের অন্ধকারময় দিন ঘনিয়ে আসে। ১৫ হাজার দেশবাসীকে খুন আর ৩ হাজারের বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়েছিল তাঁর শাসনেই। সাম্প্রতিক কালে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ঘটে যাবার পরে উপমহাদেশের অস্থির পরিস্থিতি দেখে ইতিহাসের পাতা ওল্টানোর কথা মনে হল। ইতিহাস থেকে আমরা কি কোনও শিক্ষাই নেব না?