নন্দিতা আচার্য
নন্দনের পর্দায় বিস্তীর্ণ জলাভূমি, ওড়িশার চিল্কার মতো, আবার নয়ও, এ যেন উত্তর চব্বিশ পরগনার হাড়োয়া। জলজ গাছে ভর্তি এই হাওরে এপাশ ওপাশ দেখা যায় না। মধ্যবয়সী এক পুরুষ, মুখে তার এত কাটাকুটি যে, বৃদ্ধই বলা যায়। কাঠের বিবর্ণ নৌকাটি নিয়ে জল ভেঙে এগোচ্ছে সে; হাতে লম্বা ছিপ, ছিপের মাথাটা একটু অন্যরকম। কিউবার ছবি ‘টু দ্য ওয়েস্ট জাপাটা’, পরিচালক ডেভিড বীম। ছবির মানুষটা ছিপ নিয়ে কী ভয়ঙ্কর লড়াই না করে, এক পূর্ণবয়স্ক কুমীরের সঙ্গে। এবার বোঝা গেল, জীবনযুদ্ধ তার মুখে এই কারিকুরি করেছে। কুমীর কাঁধে মানুষটি, জঙ্গলের গাছ আর পাথরের মাঝে কোনোরকম ছাউনি দিয়ে করা তার ঘরে ফিরে আসে। এ পর্যন্ত কোনও ডায়লগ নেই। চরিত্রটির নেশা ভাগ্যিস আদ্যিকালের এক রেডিও, তাই দর্শক জানতে পারে— সময়কাল, পরিস্থিতি। পরে অল্প সময়ের জন্য দর্শক দেখে এবং শোনে, জঙ্গলের বাইরে তার পরিবারকে। স্ত্রীর মুখেও সেই ক্র্যাক, কিশোর সন্তানকে কোলে নিয়ে সমুদ্রের জল মাড়িয়ে সে হেঁটে যায়, ধু-ধু সমুদ্র আর আকাশ— দৃশ্যটি চোখে লেগে থাকে। কুমীরের মাংস ডাল-পাতার আগুনে ঝলসে খাচ্ছে জঙ্গলবাসী মানুষ। রাত গভীর হয়ে আসার আগে তার হাতের পাতায় আশ্রয় নেয় কাঠবিড়ালি। এ ছবি দেখার সময় ইচ্ছে হয়, একদিন অন্তত এমনভাবে প্রকৃতির ভাষা শুনি।
Advertisement
জীবনানন্দের প্রিয় ঋতু হেমন্ত। ‘হেমন্তের ধান ওঠে ফলে/ দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে।’ শুধু কবি জীবনানন্দই নন, সিনেমাপ্রেমীরাও অধীর আগ্রহে বসে থাকে হেমন্তের পদধ্বনির জন্য— আমরা ‘কান পেতে থাকি হেমন্তে’। নভেম্বরের মাঝামাঝি, এ সময়েই বরাবর শুরু হয় ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’। একমাত্র কোভিডকালে সময় একটু বদলে গিয়েছিল। এবার একত্রিশতম বছর। এখন এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন বহু লোকজন। ফেস্টিভ্যাল এখন সর্বজনের। তারকার আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে উৎসবের আপন আলো; মানুষ শুধু সেই আলোয় সেঁকে নেন আপন হৃদয়।
Advertisement
কলকাতা থেকে অনেক দূরের মানুষও এসে উপস্থিত হন এই মহা-উৎসবে। তাঁরা উচ্ছ্বসিত হয়ে দেখেন, সিনেমা এবং সিরিয়ালের প্রিয় অভিনেতারা হেঁটে বেড়াচ্ছেন ফেস্টিভ্যাল চত্বরে। কবীর সুমন এবং বহু বিখ্যাত গায়ক এসে গান গাইছেন খোলা একতারা মঞ্চে। এই সব দেখা এবং শোনার জন্য প্রয়োজন নেই কোনও ডেলিগেট বা গেস্ট কার্ডের।
এবার ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষ। পরিচালকদের পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, শিশির মঞ্চের পাশে গগনেন্দ্র প্রদর্শশালা সেজে উঠেছে তাঁর বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি নিয়ে। একই সঙ্গে চলছে ঋত্বিকের ছবির ক্লিপিংস। উৎসব কমিটি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছে মহাসমারোহে। এরই সঙ্গে স্মৃতিচারণ গুরু দত্ত, সলিল চৌধুরী, প্রদীপ কুমার, রিচার্ড বাটন, রাজ খোসলাকে নিয়ে। সিনেমাপ্রেমী মানুষের জন্য এই ফেস্টিভ্যাল অন্যতম প্রিয় গর্বের উৎসব। এত বৈচিত্র্য, সারাদিন ধরে দেখেও শেষ করা যায় না। শুধু সিনেমা নয়, সাংবাদিক বৈঠক, ওপেন ফোরামে মাস্টার ক্লাস, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বক্তব্য, সন্ধ্যায় মাঠের ওপর একতারা মঞ্চে গানের ইন্দ্রধনু। কবীর সুমন, বাবুল সুপ্রিয়, অরিন্দম গাঙ্গুলি, ইন্দ্রনীল সেন, রূপঙ্কর বাগচি, ইমন চক্রবর্তী— বহু বিশিষ্ট শিল্পীর গানের সুরে মশগুল হয় ফেস্টিভ্যাল চত্বর।
নন্দন, রবীন্দ্রসদন, শিশিরমঞ্চ এবং কলকাতার বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে চলছে একের পর এক দেশি বিদেশি সিনেমা। সাতদিনের উৎসবে দু’শো পনেরোটা ছবি। বিদেশি সিনেমার সঙ্গে বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ছবি এসেছে উৎসবে। একটা দেখতে গেলে আর একটা মিস হয়ে যায়। চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথমদিন, ধনধান্য অডিটোরিয়ামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বোধন করলেন এই অনুষ্ঠানের। উদ্বোধনী ছবি দর্শকের চিরকালের প্রিয় ‘সপ্তপদী’, পরিচালক অজয় কর। মুখ্যমন্ত্রী সেদিন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের
‘বঙ্গবিভূষণ’ পুরস্কারে সম্মানিত করলেন।
এবার ‘থিম কান্ট্রি’ পোল্যান্ড। পোল্যান্ডের ‘ফ্রাঞ্জ’, পরিচালক আগ্নিইয়ন্সকা হল্যান্ড। নন্দনে সেদিন দর্শকদের ভিড় চোখে পড়ার মত। কাফকার জীবনছায়ায় বানানো এক অপূর্ব ছবি। তাঁর যে জীবন আমরা জানি, স্ক্রিন জুড়ে তারই বিস্তারিত রূপ। আজ থেকে একশো পঁচিশ বছর আগের প্রাগ। কিশোর ফ্রাঞ্জ, পরবর্তীকালে বিমা কোম্পানিতে কর্মরত তরুণ। ভালো লাগে না সেই কাজ তাঁর। হৃদয়ে অন্য আবেগ, লেখার আকাঙ্ক্ষা।
সন্ন্যাসীর তপস্যা সেখানে। কিন্তু বাবা হারম্যান কাফকা তাঁর লেখার আকুলতাকে বুঝতেই চাননি, সমানে বাধা দিয়ে গিয়েছেন। ফ্রাঞ্জ নিজের জীবনের বেদনাকে, বলা যায় নিজেকেই মুক্ত করেছেন নিজের লেখায়। নিয়তি এমন, সেই সব অসামান্য লেখা, জীবিত থাকতে তাঁকে কোনও খ্যাতির স্বাদ পেতে দেয়নি। পরিচালক হল্যান্ড তুলে ধরেছেন নিঃসঙ্গ, অস্থির, গভীর এবং জটিল এক মনস্তত্বের রূপ। কাফকার লেখার মতই একটার পর একটা হেঁয়ালির ঘূর্ণি, স্বস্তি দেয় না, অথচ প্রবলভাবে আঁকড়ে রাখে মন। চরিত্র ঘটনা পরিবেশ— নিদারুণ জীবন্ত, আর, এক মুহূর্তও ছেড়ে যায় না দর্শকের হাত।
সারা বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধ, হিংসা, হানাহানি, শরণার্থী মানুষের ঢল। ৩১তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম সেমিনার এই নিয়েই— ‘বিয়ন্ড বর্ডারস’। মাইগ্রেশন, ডিসপ্লেসমেন্ট অ্যান্ড ইমপ্যাক্ট। এবার উৎসবে একাধিক ছবির বিষয়বস্তু যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, শরণার্থী। জ্বলন্ত আগুনের মত কখনো ধিকিধিকি, কখনো তীব্র হয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে পর্দায়।
সেই রকমই এক অপূর্ব জ্যান্ত ছবি, ‘আফ্রিকা ব্লাঙ্কা’ (মরক্কো), পরিচালক অ্যাজলারবে আলাওউব, নিদারুণ অসম লড়াই। উদ্বাস্তুর জীবন, প্রাচীন শহর। মরুভূমির রাশি রাশি বালি, সমুদ্র, জঙ্গল পেরিয়ে বাঁচার এক চূড়ান্ত উন্মাদনা। এক বয়স্কা মা হঠাৎ চোখের আড়াল হওয়া সন্তানকে আপ্রাণ খুঁজে বেড়ায় পরিত্যক্ত শরণার্থী শিবিরে। বেঁচে থাকার লড়াই, মায়ের যুবক সন্তানও কিছুর অনুসন্ধানেই গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে, মা আর বেঁচে নেই। সম্ভবত, পৃথিবীতে বাস করার একখণ্ড ভূমির সন্ধানে পালিয়ে যেতে যেতে ক্লান্ত— এর মধ্যে ছেলেকে খুঁজে না পাওয়া, সমস্ত মিলিয়ে ভয়াবহ উদ্বেগ আর নিতে পারেনি। মায়ের মৃতদেহের সামনে ভেঙে পড়ে ছেলে। পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে নৌকায় উঠতে, তাদের জন্য নিরাপদ পৃথিবীর সন্ধানে। না হলে সহযাত্রীরাও বিপদে পড়বে। কী মর্মান্তিক! পারল না সে যেতে, কাঁদতে কাঁদতে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে যায় পরিত্যক্ত নির্জন ভূখণ্ডটির দিকে, যেখানে নেই কোনও নিরাপত্তা। সেখানে রয়েছে শুধু তার মায়ের মৃতদেহ। এই জার্নিতেই সামান্য পরিচয় থেকে গাঢ় বন্ধুত্ব হয় যে মেয়েটির সঙ্গে, সেও সাঁতরে ফিরে আসে ছেলেটির সঙ্গে। স্নেহ মায়া প্রেমের এমন দৃশ্যের কাছে, চোখের জল আটকানো যায় না। দেখতে দেখতে কখনও কখনও শ্বাস আটকে যায় বুকের ভেতর। মন বলে, এমনও জীবন আসে!
সার্বিয়ার ছবি ‘হাউ কামস ইটস অল গ্রিন আউট হিয়ার’, পরিচালক নিকোলা লেজাইক। ছবিটি দেখতে গিয়ে অনেকেই নিজের সঙ্গে রিলেট করে ফেলবে। দেশভাগ জানে সারা ভারত, জানে বাংলার মানুষ। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী এসেছেন এই পশ্চিমবঙ্গে, দিল্লিতে। ছড়িয়ে গিয়েছেন তাঁরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। ত্রিপুরা, আসাম, আন্দামান ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায়। দেশ ছেড়ে আসার তীব্র বেদনা এই সিনেমায়। দেখা যায় এক যুবককে, শৈশবের ছেড়ে যাওয়া জন্মভূমি দেখতে এসেছে সে। তাদের বাড়ি, বাগানের আমন্ড গাছ, ঘরের মেঝেতে ধুলোর মধ্যে পড়ে থাকা গ্রুপ ফোটো, যাবতীয় ফেলে যাওয়া স্মৃতির কোলাজ—দর্শকের চোখে জল এনে দেয়।
লেবাননের ছবি ‘টেলস অফ দ্য উন্ডেড ল্যান্ড’, পরিচালক আব্বাস ফাহ্দেল। সে এক বিস্তীর্ণ বিধ্বংসী রূপ। যে সব বাড়ি, স্থাপত্য বানাতে বছরের পর বছরের শ্রম এবং অর্থ ব্যয় হয়েছে, নিমেষে তা ধ্বংস। মনে হল বড়পর্দায় যুদ্ধের লাইভ টেলিকাস্ট দেখছি! তারই মাঝে ফুটন্ত রঙিন ফুলে ভর্তি গাছের পাশে ছোট্ট ক্যামেলিয়া। অনবরত বোমার শব্দে তার ভয়ে কান্না পায়; ধ্বংসের মাঝে ছোট্ট শিশুটির জীবনের প্রাণচঞ্চলতা। বাদামি রঙের একটি সুস্থ সতেজ ঘোড়া ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে মন্থর গতিতে ছুটছে আর চারদিকে দেখছে। হয়তো সে তার মালিককে খুঁজছে, খাবার খুঁজছে। হঠাৎ এক ইঙ্গিত বয়ে আনে তা; যেন অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষে ছেড়ে দেওয়া কোনও ঘোড়া! এত অপূর্ব সে প্রাণীটি, চোখ ফেরানো যায় না তার দিক থেকে। নিষ্পাপ প্রাণটি জানেও না, তার পায়ের ক্ষুরের তলায় বাজছে যুদ্ধ-দামামার ইঙ্গিত!
আলবেয়ার কামুর জীবনছায়ায় ফ্রান্সের ছবি, ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’। পরিচালক ফ্রানকয়েস ওজন। ছবিটি দেখে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে হয়; মনে হয়, এমন মানুষ কেন মৃত্যুর কাছে দাঁড়াতে বাধ্য হয়? জীবন কেন তাঁকে পিষে মারতে চায়! দৃশ্যগুলো বহুদিন মনে লেপটে থাকবে। সব থেকে বেশি ঘা দিল জেলখানার ভেতর বন্দী স্ট্রেঞ্জার আর তার সামনে উপস্থিত ধর্মযাজক। হয়তো কয়েক ঘণ্টা আছে তার জীবন, অথবা তা নাও হতে পারে; পুরোটাই অনিশ্চিত— কোনও নীতিকথা কি এ সময়ে মনে দাগ কাটে? পরিচালক ফ্রানকয়েস এমনভাবে দৃশ্যটি তুলে ধরেছেন, যে দর্শক বেদনায় বিমুঢ় হয়ে পড়ে, আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে থাকে! সিনেমা শেষে যখন এসে দাঁড়াই নন্দনের দোতলার ল্যান্ডিঙে, কাচের দেওয়ালের ওপারে তখন আলোর বন্যায় মানুষের ঢেউ, হাসি, আনন্দ। সুখ-দুঃখের ভেতরকার দোদুল্যমান সাঁকোটি কি সুখ এবং দুঃখের অন্তর-হৃদয়কে বোঝে!
এবার আসি ফ্রান্সের ছবি ‘ড্রাকুলা এ লাভ টেল’-এ, পরিচালক লুক বেসান। আধুনিক ড্রাকুলার কর্মযোগে নিয়ে এসেছেন পনেরো শতকের নস্টালজিয়া; মুগ্ধ হয়ে দেখার মত ঐশ্বর্যের ঝলকানি, প্রাচীন মিথ। কবেকার এক অতৃপ্ত আত্মা, একুশ শতকে এসে খুঁজে পায় তার প্রেমিকাকে। অবিকল এক মুখ ও চেহারা। ড্রাকুলার বাসভবনে সোনার পাহাড়, ঐশ্বর্যের সমুদ্র। অপূর্ব এক প্রাসাদ। তার বাইরে অসামান্য একটুকরো পৃথিবী। ড্রাকুলা শুনে দেখব না ভেবেছিলাম, মিডিয়া সামলানো বান্ধবী ঠেলে পাঠালো ভাগ্যিস। তাই চোখ ভরে দেখলাম সম্পদ আর প্রকৃতির অকল্পনীয় ঐশ্বর্য। রক্তচোষা ড্রাকুলা কি একুশ শতকেও নেই? ড্রাকুলা ঘাড় কামড়ে ধরলেই সে ব্যক্তি আর এক ড্রাকুলাতে পরিণত হয়। এইভাবেই আধুনিক পৃথিবীতে ড্রাকুলারা রয়ে গিয়েছে, হয়তো তাদের বাসভবনও ঐশ্বর্যের ঘাঁটি।
জার্মানির সিনেমা ‘দ্য লাইট’, পরিচালক টমি টাইকার, ১৬২ মিনিটের দীর্ঘ একটি ছবি। সেখানের রাস্তাঘাট, বাড়ির অন্দর মহল, আশ্চর্য আকর্ষণীয় মুখের একটি কিশোর, তার মা; সব মিলিয়ে গল্প কিন্তু জমে উঠেছিল। বাড়ি ফিরতে পারবে না বলে লাস্ট শোয়ের এই দীর্ঘ সিনেমা, শেষ অব্দি দেখার ইচ্ছে থাকলেও অনেক দর্শক দেখতে পারেননি।
ইউএসএ-র সিনেমা ‘লেট ফেম’, পরিচালক কেন্ট জোন্স। স্ক্রিনের ওপর একগুচ্ছ অল্পবয়সী ফুটফুটে ছেলেমেয়ের সঙ্গে এক বয়স্ক মানুষ… কাহিনী ছুটে চলেছে টগবগ করে। দৃশ্যের পর দৃশ্য, বসিয়েই রাখে দর্শককে।
ফেস্টিভ্যালের আর এক আকর্ষণ প্রেস মিট। সেখানে দেশ-বিদেশের পরিচালক এবং কলাকুশলীদের ভিড়। বছর দুয়েক আগে, ফেস্টিভ্যাল বুলেটিনে অনুরাগ কাশ্যপ আর মনোজ বাজপেয়ীর প্রেস মিটের অনুষ্ঠান কভার করার দায়িত্ব ছিল। দু’জনেই অত্যন্ত প্রিয়, ভিড় ভেঙে পড়া প্রেসকর্নারে কোনোরকমে বসে, মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম তাঁদের কথা। সেখানেই একবার পরিচয় হয়েছিল ইরানের এক অত্যন্ত সুপুরুষ পরিচালকের সঙ্গে। তিনি আমাকে লাঞ্চ না খাইয়ে ছাড়বেনই না। কোনোরকমে এক কাপ কফি খেয়ে ছুটেছিলাম পরবর্তী মাস্টার ক্লাসে।
আর ঠিক সেভাবেই এক মাস্টার ক্লাসে দেখা হল, সোনির এক বিখ্যাত কর্তাব্যক্তির সঙ্গে। তাঁর ষাট মিনিটের সেই স্পিচ বুঁদ হয়ে শুনেছিলাম। মনে হচ্ছিল, মাস্টার ক্লাস নয়, এ যেন আইআইএম-এর ম্যানেজমেন্টের ক্লাস। কঠিন বিষয়ও এত সহজ ও রসসিক্ত করে বলা যে যায়, সে অভিজ্ঞতা আমাকে অবাক করেছিল! একবার মনে আছে, বিখ্যাত একটি ছবি দেখতে গিয়ে দর্শকরা রবীন্দ্রসদনকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। আমি তো ব্যাকডোর দিয়ে ঢুকে মাটিতে বসে পড়ি, কারণ আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল।
৩১তম উৎসবে চমৎকার সব শর্ট ফিল্ম ছিল। সেরা স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবির পুরস্কার জিতল, ‘নাইমা; থ্রু হার আইজ’। সেরা তথ্যচিত্র, ‘বিজয়ী যাপনের পটকথা।’ দ্য বেস্ট ফিল্ম বিভাগে সেরার পুরস্কার, গোল্ডেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার (৫১ লক্ষ টাকা) পেল কিউবার ছবি, ডেভিড বিমের ‘টু দ্য ওয়েস্ট ইন জাপাটা।’ এটি হচ্ছে সেই সিনেমা, যার কথা দিয়ে শুরু করেছি এই প্রতিবেদনটি। ফিল্ম ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ডও জিতে নিল এই সিনেমা।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজেস বিভাগে, সেরা পরিচালকের হাতে গোল্ডেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার পুরস্কার তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। শ্রীলঙ্কার পরিচালক ললিত রত্নায়কে ২১ লক্ষ টাকা অর্থমূল্যের এই পুরস্কার পেলেন, তাঁর ‘রিভারস্টোন’ ছবিটির জন্য। আঞ্চলিক ভাষার ছবিকে এবার প্রাধান্য দেওয়া হয়। হীরালাল সেন মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড পেলেন তরুণ পরিচালক, সিকিমের মেয়ে ত্রিবেণী রাই। ছবির নাম, ‘ছোরা জাস্তাই’। খাসি ভাষার ছবি, ‘দ্য এলিসিয়ান ফিল্ড’-এর জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার গেল প্রদীপ কুরবার কাছে।
বেঙ্গলি প্যানোরামা বিভাগে সেরা পুরস্কার নিলেন চন্দ্রাশিস রায়, ছবির নাম ‘পড়শি’। জীবনকৃতি সম্মাননা দেওয়া হল কিফের চেয়ারম্যান গৌতম ঘোষকে।
সিনেমার কথা বলতে বলতে মনে হল, উৎসবের ভাইব্রেশন সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই বললাম না। আমরা যারা বছরের পর বছর ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে জড়িয়ে আছি, পরস্পর পরস্পরকে বেশ চিনে ফেলেছি। উৎসব চলাকালীন দৌড়োদৌড়ির মধ্যে চলছে আমাদের টুকরো টুকরো আড্ডা। দু’জন ঢুকে চারজনের সিট রেখে দিচ্ছে। আমাদের সব গল্পই তখন সিনেমা নিয়ে। এ সব আড্ডা বেশি জমে ওঠে চা পানের সঙ্গে। দিনের শেষে নন্দন চত্বরের রাস্তায় রাস্তায় চেনা চা-ওলা, তাদের চারপাশে বড় বড় শূন্য কেটলি, কৌতূহলবশে এক জায়গায় গুনে দেখলাম, মোট এগারোটা! চা বিক্রেতাটি কেটলির মাঝে দাঁড়িয়ে, চারদিক ঘিরে তার ক্রেতারা। যেন চক্রব্যূহে দাঁড়িয়ে অভিমন্যু! দৃশ্যটি অদ্ভুত আকর্ষণীয়। মন বলে, আহা, যদি রঙ তুলিতে এ ছবি আঁকতে পারতাম!
প্রেস কর্নারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসেন বিদেশি অতিথিরা। তাঁদের সব কিছুতেই আগ্রহ। দেশটাকে জানার কৌতূহল। এক বিদেশিনীকে দেখি ধবধবে সাদা চুলে টকটকে লাল গোলাপ গুঁজে মহা আনন্দে হেঁটে যাচ্ছেন। বড় এলোমেলো করে পরা তাঁর শাড়ির কুঁচি, উৎসবের বাতাসে মহানন্দে দুলছে। অন্যদিকে দেখি আমার এক মাস্টার ট্যালেন্ট বন্ধু, ‘আমন্ত্রণ’-এর স্পেশাল ফিসফ্রাই হাতে দৌড়চ্ছে শিশিরমঞ্চের দিকে। গতকাল একটি গেস্ট কার্ডকে কুমীরছানার গল্পের মতো বারবার দেখিয়ে, পাঁচজন বন্ধুকে সিনেমা দেখিয়েছে নন্দন ওয়ানে। প্রত্যেকবার ঢোকা এবং বেরনোর রুট অবশ্য সে বদলে নিয়েছে। হাসব না ভ্রূকুটি করব, বুঝতে পারি না। এই সব লুকোচুরির দুষ্টুমি চলতেই থাকে। আর একজন আবার তার ছবিসাঁটা ডেলিগেট কার্ডকে বয়ফ্রেন্ডের গলায় ঝুলিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল রবীন্দ্রসদনে। বোঝ কাণ্ড, ধরা পড়লে কী হতো, জানি না। তবে তার সেই ছেলেবন্ধু এত নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল যে, হলে ঢুকে সে হাঁটতে হাঁটতে একদম ফার্স্ট রোয়ে এসে থেমেছিল।
সেটা ছিল কয়েক বছর আগের এক ফিল্ম ফেস্ট; একটি বিখ্যাত সিনেমা দেখানো হচ্ছে নন্দন ওয়ানের লাস্ট শোয়ে। রাত বাড়ছে তখন। ভিড়ের মধ্যে হাতাহাতি লেগে গেছে। কাজ থেকে সময় করে সেই সিনেমা দেখব বলে আমিও রেডি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দাঁড়িয়ে যাই আমি। প্রেস কর্নারের বাইরে সাঁকোয় দাঁড়িয়ে দু’কাপ চা কিনি। একটি আমার, আর একটি অনেক দিনের চেনা বাঁশিওয়ালার। কার্তিকের হালকা হিমধরা সন্ধ্যায় তার বাঁশি মোহময় হয়ে উঠছিল। সিনেমা দেখতে না পাওয়ার দুঃখ ভুলিয়ে দিচ্ছিল সেই সুর। হন্তদন্ত হয়ে আর এক সাংবাদিক বন্ধু দেখি প্রেসের দিকেই আসছে। আমায় দেখে সে বলে, চল, এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আমি বলি, ভিড়ে ঢুকতে পারব না। আমার কথাকে গ্রাহ্যই করে না সে; ভিড় ঠেলে টেনে নিয়ে গিয়ে ফাঁকা থাকা একটি ভিআইপি সিটে বসিয়ে দেয়। নিজে বসে মেঝেতে। পরে বুঝতে পারি, আমি অপর্ণা সেনের পাশে বসেছি। সত্তর আশির দশকের হার্ট থ্রব, এখনকার জেনারেশনেরও হার্ট থ্রব অপর্ণা সেন; একটি বালিকার মত উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার সঙ্গেও সিনেমা নিয়ে তাঁর আবেগ শেয়ার করছেন। এদিকে মাটিতে বসা বন্ধুর পাশে চাপা গলায় ঝগড়া লেগে গিয়েছে। সাইড সিটের কে নাকি ঘুমিয়ে পড়ে নাক ডাকছে, আর সেই নাক নাকি মেঝেতে বসা একটি ছেলের কানে ঢুকে গেছে। ছেলেটি বলছে, আপনার নাক এবং নাক ডাকা নিজের কাছে রাখুন না, আঙ্কল?
সবশেষে আসি নন্দনের পর্দা জুড়ে কালজয়ী ফিল্ম, সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে। আপামর দর্শকের হৃদয় তোলপাড় করে ওঠে; মন বলে, অপরূপ, অসাধারণ !
প্রত্যেক বারের মত, এবারেও সাত দিনের এই সিনেমা উৎসব পরিক্রমা, আমাকে বিশ্বভ্রমণ করিয়ে ছাড়ে!
Advertisement



