সেই কতদিন আগে, যেন কত যুগের ওপার থেকে নতুন এক গানের সুর ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল আসমুদ্র হিমাচল। ‘দিল কা আলম ম্যায় ক্যা বাতাউঁ তুঝে, এক চেহরে নে বহুত প্যার সে দেখা মুঝে’। গেয়ে উঠেছিলেন কুমার শানু। আশিকি, নয়ের দশকের একেবারে শুরুতে। সুরকার নাদিম শ্রবণ। তারপর একের পর এক হিট। সমুদ্রের ঝোড়ো বাতাসের মতো সেই গান ঢুকে পড়েছিল আমাদের মফস্বল শহরে, তার অলিতে গলিতে। লেগেছিল বাড়ির কার্নিসে, ছাদের অ্যান্টেনায়, শিল্পীর ক্যানভাসে, লোকাল ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে। রান্নাঘরের মিটসেফ আর রাস্তা ধারের বসার রোয়াকে। তখনও একদল বালক বালিকা জানে না সেইসব গানের মানে। অনুভব করে উঠতে পারেনি ‘দিল’, ‘আশিকি’ এইসব আরবি, ফারসি শব্দের অনুচ্চারিত গভীরতা। তখনও ইন্টারনেট আসেনি পাড়ায় পাড়ায়, হাতে হাতে মোবাইল হ্যান্ডসেট। উচ্চবিত্তের ঘরে শুধু শোভা হয়ে থাকত একঘেয়ে, কর্কশ বেজে চলা অসুখী এক টেলিফোন। যেন শুয়ে থাকত নিঃসঙ্গ, শয্যাশায়ী রোগীর মতো। গ্রীষ্মের শেষ হতে না চাওয়া লম্বা ঠাঠা দুপুরে অদৃশ্য কুবোপাখি ডেকে যেত পরিত্যক্ত বাড়ির পিছনের বাগানে। যেন বলে যেত
না-বলা কত কথা। দূরে কোথাও মন উতল করা কাঠঠোকরার একটানা ঠক ঠক আওয়াজ, পথের পাঁচালির অপুর ছেলেবেলা। পৃথিবীর সব কিছু তখনও জানা হয়ে ওঠেনি অবলীলায়। শহর, গ্রাম, মফস্বল মিশে যায়নি এক সর্বগ্রাসী ডিজিটাল মিডিয়ায়।
তখন হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্টে ঢাকছে পিউবিক হেয়ার। নাকের নীচে গজাচ্ছে কচি ঘাস। মেয়েরা সচেতন হয়ে উঠছে জামায় ঢাকা তাদের সুপ্তোত্থিত স্তন নিয়ে। বাল্যকাল ছাড়িয়ে কৈশোরে পা রাখছে গোটা একটা প্রজন্ম । যে প্রজন্ম তখনও জানে না তাদের কৈশোরের শুরুতেই টানা হয়ে গেছে এক অদৃশ্য বিভাজন রেখা। এও যেন সেই কাঁটাতারের বেড়া। ইতিহাসের র্যাডক্লিফ লাইন। একই দেশ, একই সংস্কৃতি, একই ভাষা। তবুও পৈতৃক ভিটের মতো নিজের নয়, ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের মতো যেন ‘নিজের’ বলে দেগে দেওয়া অন্য একটা কিছু যেখানে ভোরের শিশির পড়ে তখনও, শীতের কুয়াশা, শরতের শিউলিফুল। কিন্তু হাঁটা যায় না সেই মেঠো পথ ধরে, ছোঁয়া যায় না, অনুভব করা যায় না মাটির ঘ্রাণ। জন্মদিনের পায়েস, ধান দুর্বার আশীর্বাদ আর মায়ের স্নেহ। সেসবের মাঝে যেন এক কাচের দেওয়াল। কষ্টের ইতিহাস। ওপারের শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ আসতে দেয় না কোনোটাই। বড় ব্র্যান্ডের কেক, মোমবাতি, বিলিতি কায়দার রাতপার্টি ধীরে ধীরে দখল নেয় সবকিছুর।
নয়ের দশকের সেই বালক বালিকারা তখনও জানত না চারপাশটা আমূল পালটে যেতে চলেছে খুব দ্রুত। ডাংকেল প্রস্তাব পাশ হয়ে গেছে। কারা যেন সই করে দিয়েছে গ্যাট চুক্তিপত্র। সুদিনের আহ্বানে বন্ধক দেওয়া হয়ে গেছে আমাদের চির পরিচিত শহর, নগর, গ্রাম, মফস্বল। তার সাদাকালো রাস্তাঘাট, পুকুরপারের জায়গা জমি, আগান-বাগান, পাখির বাসা এমনকি ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য তুলে রাখা ছাদের ওপর ওই নীল আকাশটাও। সেইসব বালক বালিকারা পড়াশোনা করত মিউনিসিপ্যালিটির স্কুলে। নীল, সাদা ইউনিফর্ম আর সাদা কাপড়ের জুতোয়। জুতোর ভেতর বুড়ো আঙুলের কাছে ছেঁড়া মোজা। তখন কো-এডুকেশনের প্রচলন ছিল না সেভাবে। ছেলেদের স্কুল, মেয়েদের স্কুল আলাদা আলাদা। একই পথে, হয়তো বা একই পাঁচিলের এধার ওধার। ছেলেরা সকালের প্রেয়ার ফাঁকি দিত। দেরি করে ক্লাসে আসত, পাঁচিল টপকে স্কুল পালাত। টিফিন পিরিয়ডে ফুটবল খেলত ধুলো উড়িয়ে। মাস্টার মশাইদের পিছনে ম্যাঁও ডাকত। মেয়েরা বিনুনি বাঁধতো, কানে কানে কথা ছড়াত। কিতকিত খেলত মাটিতে দাগ কেটে, হাঁটু ভেঙে দড়িলাফ লাফাত এক অদ্ভুত কায়দায়। তারপর ক্লাস বসার ঘন্টা পড়লে সদ্য কৈশোরে পড়া পা নিয়ে সেই দাগ ফেলে রেখে ফিরে যেত নিজের নিজের ডেস্কে। লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো মুখ করে বসে থাকত দিদিমণিদের দিকে তাকিয়ে। দু’দলই বেঞ্চের ওপর কাঁটা কম্পাসে নাম লিখত নিজেদের। বিশ্বাস করত যোগ চিহ্ন দিয়ে দু’জনের নামের আদ্যাক্ষর লিখে রাখলে প্রেম কিম্বা বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী হয় অথবা কাঁটা পড়ে বিচ্ছেদের দুয়ারে।
তারা জানত না, তারা বেড়ে উঠছে সময়ের এক অদৃশ্য সঙ্গমস্থলে। হুগলিনদীতে ঠিক যেভাবে সরস্বতী এসে মিশেছে চাঁদের নগরের অদূরে সেভাবেই এক অদৃশ্য স্রোত পৃথিবী ঘুরে এসে মিশে যেতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে তাদেরও যাপনে। জীবনকে করে তুলতে চলেছে অযথা জটিল, কর্কশ, ক্ষমাহীন। তারা মোহিত হয়ে ছিল বট অশ্বত্থের ঘন ছায়ায় চুঁইয়ে আসা আলোর জাফরির দিকে তাকিয়ে, পড়ন্ত বিকেলে হাইওয়ের ধারে দাঁড়িয়ে অস্তগামী সূর্যের লাল আভা দেখতে। সচিনের ব্যাটিংয়ে, শারজার মরুঝড়ে, জুরাসিক পার্কে, টম অ্যান্ড জেরির কার্টুনে। তারা অবাক হয়েছিল প্রিন্স ডায়ানার সৌন্দর্যে, প্রকাশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে সাদ্দাম হোসেনের হেঁটে যাওয়া দেখে। আর্চিসের কার্ডে, পার্কারপেন-এ, শনির ওয়াকম্যানে।
তাজা হাওয়ার মতো সেই গান তখন ছুঁয়ে যাচ্ছিল প্রতিটি কৈশোর, প্রথম যৌবন। যেভাবে রুক্ষ প্রদেশে ঢেউ ওঠে বার্লির ক্ষেতে, যেভাবে কায়রোস্তামি বলে যান ‘উইন্ড উইল ক্যারি আস’ সেভাবেই সবকিছু যেন ভেসে চলেছিল তখন, কাটা ঘুড়ির মতো হাওয়ার স্রোতে। একটা এলোমেলো ব্যথা খেলা করছিল রঙিন মাছের মতো। অহেতুক এক মনখারাপ থেকে থেকেই পাক খেয়ে উঠছিল সেই সুরের ওঠা পড়ার সঙ্গে, কোনদিকে যেন ছুটে যেতে চাইছিল। নিজেকে ভাবাতে শেখাচ্ছিল নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন। সাগরপারে পড়ে থাকা যেন কোনও অবহেলার ঝিনুক যার বুকে কান পাতলে শোনা যায় সেই কবেকার শোঁ শোঁ শব্দ। যেন সেই আশ্চর্য প্রদীপ, আলাদিন ঘুমিয়ে আছে যার ভেতর।
তখনও তারা জানত না, এসবই আসলে পূর্বরাগ। প্রেমে পড়ার ঠিক আগের স্টেশন। এও যেন সেই এক ঈশ্বরের বাগান তৈরির কাজ। যত্ন করে মাটিতে সার, জল দেওয়া। অজান্তে মায়া, মমতা মেশানো। কাজ শেষ হলে, গাছ লাগালে এসে দাঁড়াবে ফুলের মতো ফুটফুটে সেই সুন্দর ষোড়শী মেয়েটি। যে মেয়েটির টানা চোখ, ইউ শেপ চুল। ডল পুতুলের মতো ফোলা গাল। গালে লেগে থাকা একমুঠো কপট রাগ, যেন আত্মরক্ষার হাতিয়ার। এপ্রিলের দুপুরে নিঝুম রোদে যে মেয়েটি একাকী হেঁটে যায় রবিবার নাচের স্কুলের সাদা পোশাক পরে। কাঁধের ঝোলা ব্যাগে ঘুঙুরের ছম ছম শব্দ, হেঁটে যাওয়ার তালে তালে। দূরে কোথাও হাঁক দিয়ে যায় আইস্ক্রিমওয়ালা কিম্বা মায়াবী ঘন্টি বাজিয়ে চলে যায় কুলফিমালাই। ঠেলাগাড়ি নিয়ে হেঁটে যায় পাশের পাড়া দিয়ে।
সেই মেয়েটির নাম নীলাঞ্জনা ছিল না। তবুও একটি কিশোর ছেলে তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকত একা, কোনও এক মফস্বল শহরে নামহীন গলির ভাঁজে, একটিবার তার চোখ তুলে দেখার অপেক্ষায়। রুলটানা খাতার ছেঁড়া পাতায় ফাউন্টেন পেনে লেখা ছোট্ট এক চিরকুট সবার চোখ এড়িয়ে তাকে পৌঁছে দেওয়ার আশায়। গোটা অক্ষরে, রাতজাগা চোখে হয়তো বা ভুল বানানে সে লিখে এনেছিল সামান্য এক বার্তা— ভালোবাসি।
সে ছিল এক হাতচিঠির যুগ। যৌন বন্ধুত্ব আসেনি তখনও। রাস্তাধারের ওষুধের দোকানগুলো ছেয়ে যায়নি সুগন্ধী কনডমের প্যাকেটে। কন্ট্রাসেপটিভ পিল, প্রকাশ্য ধূমপান হয়ে ওঠেনি নারী স্বাধীনতার তথাকথিত প্রতীক। সে ছিল শুধু একবার ছুঁয়ে দেখার সময়। সন্ধ্যাপুজোর আরতি, নবমীর ভোগ কিম্বা পুষ্পাঞ্জলির ফুলে। সে ছিল সামান্য হাসি কথা বিনিময়ের যুগ। স্কুল টাইমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা, বিকেলে সাইকেল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা, বড়জোর অন্ধকার সিনেমা হলে কোনার চেয়ারে বসে ঠোঁটে ঠোঁট রাখা।
তখনও মাল্টিপ্লেক্স আসেনি। সামান্য ভুট্টাদানা হয়ে ওঠেনি মহার্ঘ পপকর্ন। তখনও সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা বহন করে চলেছে শহরের আভিজাত্য। পোস্টার পড়ছে রাস্তাধারের পাঁচিলে পাঁচিলে, ইলেকট্রিকের পোলে। এক আশ্চর্য মানুষ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসছে মোটা একগোছা প্ল্যাকার্ড আর একটা মই। সঙ্গে বালতিতে গোলা আঠা। সেই আঠা লাগিয়ে দেয়ালে সেঁটে যাচ্ছে বেশি বয়সের অমিতাভ, জয়াপ্রদা। নবাগত আমির, সলমন। এদিকে প্রসেনজিৎ, তাপস, দেবশ্রী, শতাব্দী। ‘আমি কলকাতার রসগোল্লা’ কিম্বা ‘ঝাল লেগেছে আমার ঝাল লেগেছে’। মা-কাকিমা, প্রেমিক-প্রেমিকা, বিবাহবার্ষিকীর স্বামী-স্ত্রী কিম্বা সদ্য মাধ্যমিক শেষ হওয়া ছাত্রছাত্রীর দল আছড়ে পড়ছে হলের ভেতর। শেষ বেলায় টিকিট ব্ল্যাকাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে বুকের বোতাম খুলে, জামায় গিঁট বেঁধে। কানের গোড়ায় এক অদ্ভুত অ্যাকসেন্টে অনবরত বলে যাচ্ছে এক কা দশ, এক কা দশ। সিনেমা হলের সামনে ছড়িয়ে দিচ্ছে উত্তেজনা। তখনও কেবল টিভি, ডি টি এইচ, ওটিটি-র উত্থান ঘটেনি। আসেনি একশো, দু’শো কিম্বা পাঁচশো কোটির ক্লাবের অস্তিত্ব। স্পেশাল ইফেক্টস্ অথবা ভি এফ্ এক্স। সাধারণ হাসি কান্নার মধ্যেই এগিয়ে চলত গল্প। মানবিক সম্পর্ক, সম্পর্কের ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন। মানুষ তখনও হয়তো বিশ্বাস করত রক্ত মাংসের হৃদয়ের আড়ালে মন বলে একটা বস্তু আছে। মানুষে মানুষে সম্পর্কের মধ্যে মায়া নামের এক বাঁধন আছে। দেশ আছে, সমাজ আছে, পরিবার আছে। পারিবারিক শিক্ষা, সংস্কার, আভিজাত্যের একটা মূল্য আছে। নীতি আছে, আদর্শ আছে।
কিন্তু হঠাৎ-ই যেন এক অদৃশ্য আদেশ বলে কোনও এক আস্তাকুঁড় থেকে ঝোলা ভরে সেসব নিয়ে চলে গেল ভোর রাতে কাগজ কুড়াতে আসা ছেলেটা। নিয়ে গেল বিক্রি না হওয়া কবিতার স্বীকৃতি, চাকরি না পাওয়া মেধাবীর সম্মান, আরও যেন কত কী! এক পরিত্যক্ত সভ্যতার মতো রেখে গেল বন্ধ প্রেক্ষাগৃহ, ওপরের ব্যালকনি, বাতিল প্রজেক্টর। ফুরিয়ে যাওয়া কিছু সম্পর্ক, না রাখা কথা, অব্যক্ত ব্যথা যন্ত্রণা।
আর রেখে গেল খুব সাধারণ চেহারার এক ছটফটে ছেলে ‘জ্বর আসা বিকেলের মতো’ একদিন যে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছিল বাড়ির উঠোনে। চেনা হাসি, টোল পড়া গাল আর গভীর এক আবেদনে ভরা চোখ নিয়ে। যেন ভেতর থেকে বলে উঠেছিল কেউ তীব্র এক আর্তি কন্ঠস্বরে মিশিয়ে, ‘মুঝে মউত কি গোদ মে শোনে দে, তেরি রুহ্ মে জিসম ডুবোনে দে’। গত জন্মের এক ব্যথা যেন পাক খেয়ে উঠেছিল ধূ-ধূ মরু প্রান্তরে। সেই যে ছেলেমেয়েগুলো সন্ধিক্ষণ পার করছিল নিজেদের কৈশোর যৌবনের তারা খুঁজে পেয়েছিল আলো ছায়া মাখা তাদের সেই কাল্পনিক মূর্তিকে, বেঁচে থাকার এক নিঃশর্ত অবলম্বন নিয়ে রুপোলি পর্দায় ফুটে উঠেছিল যে।
সেই সময় সরযূ নদীগর্ভে অতি সন্তর্পণে বয়ে চলেছিল রাজনীতির এক চোরা স্রোত। ক্ষমতার এক নতুন দিশা। প্রতিদিন একটু একটু পালটে যাচ্ছিল অস্তগামী সূর্যের রঙ। নিভৃতে লেখা হয়ে চলেছিল ইতিহাসের নতুন এক মুখবন্ধ। খুব দ্রুত সরে সরে যাচ্ছিল এক সভারেন, সোশ্যালিস্ট, সেক্যুলার, ডেমক্র্যাটিক, রিপাবলিকের ক্যালিডোস্কোপ। যেন ছুঁড়ে ফেলছিল এতদিনের জমানো সবকিছু। বদলে যাচ্ছিল যা কিছু নিত্য সত্য। যা কিছু জানা হয়ে এসেছিল বংশ পরম্পরায়, পূর্ব পুরুষের হাত ধরে। দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষের পরিচয়ে। প্রতিবেশীর আচার বিচারে। শিল্পীর সৃষ্টিতে।
ওদিকে সেই সাধারণ চেহারার ছটফটে ছেলেটি ছেয়ে যাচ্ছিল সর্বত্র। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছের রণ থেকে কলকাতা। ছেয়ে যাচ্ছিল কথার জাদুতে, গভীর চাহনিতে, হাসির সারল্যে, মজাদার কান্ড কারখানায়। কখনও ম্যান্ডোলিনের সুরে, কখনও ঝরে পড়া চিনার পাতায় আবার কখনও বা হলুদ সরষে ফুলের ক্ষেতে। রেখে যাচ্ছিল এক স্বর্গীয় ভালোবাসার অনুভূতি। বলে যাচ্ছিল হেরে যেতে যেতে জিতে যাওয়ার কথা। হাঁটু মুড়ে বসেছিল সে ভালোবাসার সামনে। দু’হাত ছড়িয়ে আলিঙ্গন করেছিল তাকে।
তখন এক ভারি এলোমেলো সময়। খবরের কাগজের প্রথম পাতার দখল নিয়েছে জিডিপি, মাথাপিছু আয়, অবমূল্যায়ন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ব্যাল্যান্স অফ পেমেন্ট ঘাটতির মতো কঠিন কঠিন সব বিষয়। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের ঋণ। তখন খুলে দেওয়া হচ্ছে পরিষেবা ক্ষেত্র। বিদেশি পুঁজি একটু একটু করে ঢুকতে শুরু করেছে যেন সমুদ্রের ধারের বিরাট লম্বা, উঁচু পাঁচিলের গায়ের ছোট্ট ফাটল গলে। অচিরেই সেই জল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে শহর। রাস্তার ধারে ধারে গড়ে উঠবে বিদেশি ব্র্যান্ডের আউটলেট, উঁচু উঁচু আলো ঝলমলে শপিং মল। বড় বড় হোর্ডিং, কাট আউটে ভরে যাবে চারদিক। ঢাকা পড়ে যাবে ছোট ছোট মুদির দোকান, আলো আসার এক চিলতে জানালা, চিলেকোঠার ঘর। দেহবেচা মেয়েদের মতো সাদাকালো নিরীহ শহর হয়ে উঠবে রঙের বেসাতি। সন্ধেবেলায় মুখে রঙ মেখে দাঁড়াবে গঙ্গার ধারে, ভাঙা সিঁড়ি চাতালে এসে মিশেছে যেখানে তার ঠিক পাশটিতে, অন্ধকারের গা ঘেঁষে। শহরের ফুটপাথ থেকে বিলীন হয়ে যাবে শিল কাটাও, বদল বিস্কুটের মায়াবী ডাক আর জুতো তৈরির চীনে দোকানগুলি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যারা থেকে গেছিল শহরের ধুলোবালিতে, ঘিঞ্জি জনবহুল বসতিতে, দেখা মিলবে না তাদের। মানুষ ভিটে মাটি বেচে উঠে যাবে চারতলা ফ্ল্যাটে। পরিত্যক্ত তুলসীমঞ্চ, ছাদভাঙা কড়ি বরগার সামনে এসে দাঁড়াবে নতুন এক শ্রেণীর
জমি-হাঙর। তারা গাছ কাটবে, পুকুর বোজাবে, ধ্বংস করবে ঐতিহ্য। অনুমতি জোগার করবে, ভিত কাটবে, গড়ে তুলবে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট, হাউজিং কমপ্লেক্স। খেয়ে নেবে ছেলে পুলেদের খেলার মাঠ। শহরের মধ্যে গড়ে তুলবে আরও অনেক নামী দামি শহর। রাষ্ট্র ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেবে তার কল্যাণময় হাত, চাকরির নিশ্চয়তা। কমিয়ে দেবে স্বল্প সঞ্চয়ের সুদ, উঠিয়ে দেবে পেনশন। এক নিশ্চিত ভবিষ্যত থেকে মানুষ হেঁটে যাবে চরম এক অনিশ্চয়তার দিকে। বন্দর ছেড়ে যাওয়া জাহাজের ডাকের মতো ক্রমশ মিলিয়ে যাবে মিছিলের ‘জবাব চাই জবাব দাও’ স্লোগান, শ্রমিকের আটঘণ্টা কাজের দাবির প্রাসঙ্গিকতা। সংস্কারের মানবিক মুখ কেড়ে নেবে বহু মানুষের ভাতের অধিকার।
বয়স কিম্বা সময়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা সেই প্রজন্ম তখনও জানবে না এতসব। তারা টান দেবে সিগারেটের শেষ কাউন্টারে। হলুদ মলাটে বটতলার চটি বই পড়বে, রগরগে রঙিন ছবি দেখবে। অক্লেশে মাখবে পৃথিবীর ধুলো-কাদা, মলিন যা কিছু। মধ্যরাতে উৎসাহী চোখে জেগে থাকবে বেওয়াচের পামেলা অ্যান্ডারসনে। নিজেকে তৃপ্ত করবে স্বমেহনে। ধীরে ধীরে যেন এক নতুন জগৎ খুলে যাবে তাদের সামনে। বয়ঃসন্ধির সেই ছেলেমেয়েগুলো যারা তাদের প্রিয়তমা কিম্বা প্রিয়তমর নাম স্কুল ডেস্কে লিখে রাখত এই সেদিনও যোগ চিহ্ন দিয়ে, হঠাৎ-ই যেন বড় হয়ে উঠবে কোনও এক সোনার কাঠির ছোঁয়ায়। অনুভূতির সঙ্গে মিশবে কামনা। কিছুদিন আগেও ‘দিল’, ‘আশিকি’র মতো যে শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত মানে ভাসা ভাসা ঠেকতো, রোদ ওঠা শীতের সকালের মতো সেগুলো হঠাৎ-ই স্পষ্ট হয়ে উঠবে তাদের কাছে। সঙ্গে যোগ হবে রক্তমাংসের শরীরের অধিকার পাওয়ার এক অদম্য বাসনা। টেপ রেকর্ডারে ঘুরে চলা ক্যাসেটের পিঠ তারা বারবার রি-ওয়াইন্ড করে শুনবে ‘অ্যায় আজনবি তু ভী কভি আওয়াজ দে কঁহি সে’। বালিশে মুখ গুঁজে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে সেদিনের কিশোর ছেলেটি ভাববে সেই মেয়েটির মুখ এপ্রিলের খাঁ খাঁ দুপুরে যে হেঁটে যেত নাচের স্কুলের দিকে, ফোলা ফোলা গালে কপট রাগ মেখে। এক অদৃশ্য ঝড় উঠবে ছেলেটার বুকে। সে খুঁজে বেড়াবে সেই মেয়েটিকে রাস্তাঘাটে, বিয়ে বাড়িতে, কলেজ ফেস্টে। কম্পিউটারের নতুন ক্লাসে, ইন্টারনেটের অজানা ব্যান্ডউইথ-এ, সদ্য গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের এক সামাজিক মাধ্যমে। রুপোলি পর্দার গল্প আর বাস্তব জীবনের কল্পনা মিলেমিশে যাবে তার কাছে। তার মতো আরও হাজার হাজার ছেলেমেয়ের কাছে। জীবনটাই যেন হয়ে উঠবে এক আস্ত সিনেমা। তারা বসে থাকবে মিষ্টি জলের হ্রদের কাছে। এক বুক তেষ্টা নিয়ে চেয়ে থাকবে দূরের জলাশয়ের দিকে।
আর সেই অন্যমনস্কতার সুযোগে খুব সামান্য দামে কর্পোরেট কিনে নেবে একটা গোটা প্রজন্মের নিয়তি যেভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একদিন বাংলা বিহার উড়িষ্যার ভাগ্য কিনে নিয়েছিল মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্ আলমের কাছ থেকে। ঝাঁ চকচকে ফ্লোর, কাচের বিল্ডিং, স্মার্টনেস, কোট-টাইয়ের ফাঁসে আর বিদেশি ডলারের প্রলোভনে আটকে ফেলবে চারাগাছের মতো বেড়ে ওঠা দেশীয় সতেজ মেধা। কোনও এক ভুল ইঞ্জেকশনে তারা ভুলিয়ে দেবে দেশ, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন। ভুলিয়ে দেবে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ছোট থেকে শিখে আসা সামাজিক যা কিছু শিক্ষা। গড়ে তুলবে এক সর্বব্যাপী বাজার ব্যবস্থা। চাহিদা, জোগান, প্রতিযোগিতা। প্রতি মুহূর্তে টিকে থাকার লড়াই। যারা মেধাহীন, ছুড়ে ফেলবে ভবিষ্যতের গভীর অন্ধকারে। ধরিয়ে দেবে পিঙ্ক স্লিপ— ইয়োর সার্ভিস ইজ নো মোর রিকোয়্যার্ড।
বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েগুলো ততদিনে পা রেখেছে যৌবনে। দলে দলে তারা ছুটে গেছে যেন এক অমোঘ হাতছানির দিকে। নিজেকে রক্তাক্ত করেছে প্রতিদিন আয়নার সামনে শেভিং ব্লেডের টানে আভিজাত্যের অহঙ্কারে, নিজেকে নীলাভ করে তোলার নেশায়। কিম্বা টাইট পোশাকে মোহময়ী হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায়। তারা ক্যাট ওয়াক করেছে, অফিস গেছে ল্যাপটপ নিয়ে। তারপর সারাদিন কল অ্যাটেন্ড, ক্লায়েন্ট মিট। সফ্টওয়্যারের জটিল ধাঁধা। কোনও এক অদৃশ্য জাদুবলে তারা ভুলে থেকেছে বাড়িতে মায়ের অসুখ, বাবার উৎকন্ঠা, বউয়ের প্রেগনেন্সি কিম্বা প্রেমিকার অপেক্ষার কথা। ভুলে থেকেছে চিঠি লেখার সঠিক ঠিকানা, দরজায় কড়া নাড়ার কথা। তাদের সন্ধে পেরিয়ে গেছে অদ্ভুত এক হুড়োতাড়ায়। ঝিমিয়ে এসেছে অফিস পাড়া, কলেজ মোড়ের বাসস্ট্যান্ড। একটা একটা করে নিভে গেছে আলো পাশের উঁচু বিল্ডিংয়ে। দূর পৃথিবীর গায়ে ফুটে উঠেছে তারাদের মতো ফুটকি ফুটকি মায়াবী আলো। তারা অপেক্ষা করেছে ফ্রাইডে নাইটের। নিজেকে পুড়িয়েছে বন্ধু-বান্ধবী, পার্টি, নাচানাচি, উপচে পড়া বিয়ারের ফেনায়। আকন্ঠ মদ্যপান আর ফ্রি সেক্সের ফাইভস্টারে। তারপর ফিরে এসেছে ক্লান্ত পায়ে, গুটিগুটি নির্জন ফ্ল্যাটে। ঘুমের মধ্যে হেঁটে যেতে দেখেছে সেই ষোড়শী মেয়েটির ছায়া। মনে করতে চেয়েছে তার মুখ। শনাক্ত করতে চেয়েছে ঘুঙুরের সেই শব্দ। ঘুম ভাঙা চোখে জেগে বসেছে বিছানায়। আবিষ্কার করেছে সবকিছু কবে যেন অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার ভেতর। অযাচিত এক পাপবোধ তাড়া করে ফিরেছে তাকে।
তারা ঘর ভেঙেছে, সম্পর্ক ভেঙেছে। নিজেকে করে তুলেছে অস্থির। রুপোলি পর্দার নায়কের মতো বারবার ফিরে যেতে চেয়েছে সেই মেয়েটির কাছে, নির্জন দুপুরে তার হেঁটে যাওয়ার কাছে। তারা ফিরে যেতে চেয়েছে ফেলে যাওয়া সময়ের কাছে। পুরোনো সাদাকালো শহরের সেই গলির মুখে। এক নিষ্কাম ভালোবাসার কাছে। কিন্তু পেরে ওঠেনি কিছুতেই।
নয়ের দশকে বেড়ে ওঠা এক কবি জয়াশিস ঘোষ লিখেছেন, ‘এখানে কেউ কারো নয়, তবু মায়াজন্মের ছলে/ পাশাপাশি বসে আছে আকাশের তলে/ ফেনাদুধ গড়িয়েছে জ্যোৎস্না আঁতুর/ রাতের বুক থেকে, ফোঁটা ফোঁটা সানাইয়ের সুর/ নদীর গভীরে চলে গেছে/ কে জানে, গতজন্মে কে কাকে কবুল বলেছে!’
ক্ষত বিক্ষত এক প্রজন্ম ছুটে চলেছে ভাটির টানে।