সারদা সরস্বতী

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

স্বামী ঊর্জিতানন্দ

সরস্বতী হলেন বিদ্যার দেবী। ব্যাপকার্থে জ্ঞান, শিক্ষা, শিখন, কলা, বাক, পদ্য, সঙ্গীত, পবিত্রতা, ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছুরই অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন শ্বেতাম্বরা, হংসাসনা মাতা সরস্বতী। প্রাচীন বেদে সরস্বতী নদীর সঙ্গে দেবী সরস্বতীর সরাসরি সম্বন্ধ থাকলেও পরবর্তী সময়ে মূলত বাগদেবী হিসাবেই সরস্বতী বন্দনা মুখ্য হয়ে ওঠে। শুভ্রকান্তি দেবীর সাদা রং সত্ত্বগুণের প্রতীক। সরস্বতীর দ্বিভূজা ও চতুর্ভূজা— দুই রূপই বর্তমান। দেবীর বিভিন্ন হস্তে ধৃত পুস্তক বেদ তথা জ্ঞানের প্রতীক, জপমালা মনঃসংযম ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক, জলের পাত্র বিবেক অর্থাৎ ভালো ও মন্দকে পৃথক করতে পারার প্রতীক, পাত্রস্থ জল জ্ঞান ও মুক্তিকে দ্যোতিত করে এবং বীণা সৃষ্টিশীলতার প্রতীক! দেবীর বাহন হংস মহাজ্ঞানীর প্রতীক, যে কিনা জল ও দুধ আলাদা করতে পারে! দেবী ভারতী সকলকে ‘ধী’ প্রদান করেন।

গায়ত্রী, সাবিত্রী, শক্তিপীঠ শারদাপীঠের ‘শারদা দেবী’ প্রমুখরা হলেন দেবী সরস্বতীর ভিন্ন ভিন্ন রূপ! সরস্বতীর ধ্যানমন্ত্রে আছে ‘ওঁ তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ।/ কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিষন্না সিতাব্জে।।/ নিজকরকমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ।/ সকলবিভবসিদ্ধ্যৈ পাতুর্বাগদেবতা নঃ।।’ পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে দেবী ভারতীকে অর্ঘ্য দেওয়া হয় ‘ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ। /


বেদবেদাঙ্গবেদান্তবিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।।’ আবার মাকে প্রণাম জানিয়ে বলা হয় ‘ওঁ জয় জয় দেবীচরাচরসারে কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।/ বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে ভগবতী ভারতী দেবী নমস্তে।।/ ওঁ সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে। / বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে।।’

শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের দৃষ্টিতে মা সারদা— সর্বদেবদেবীস্বরূপ শ্রীরামকৃষ্ণদেব জগজ্জননী সারদাদেবীর সম্বন্ধে বলতেন ‘ও সারদা— সরস্বতী, জ্ঞান দিতে এসেছে। ও কি যে সে! ও আমার শক্তি।’ ‘গাই গীত শুনাতে তোমায়’ কবিতায় স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছেন, ‘দাস তব দোঁহাকার, সশক্তিক নমি তব পদে।’ স্বামীজির কাছেও শ্রীমা ছিলেন স্বয়ং জ্ঞানস্বরূপিণী মা সরস্বতী। তাই যেকোনো সঙ্কটেই চরম সমাধানের জন্য স্বামীজি মা সারদারই শরণাপন্ন হতেন এবং নির্দ্বিধায় শ্রীমা প্রদত্ত সমাধানসূত্রকেই মাথায় তুলে নিতেন। আমেরিকা যাবার সঙ্কল্পবদ্ধ হয়ে স্বামীজি শ্রীমায়ের অনুমতি প্রার্থনা করে তাঁকে চিঠি লিখলে শ্রীমা অনুমতি দেন। হাঁফ ছেড়ে বেঁচে বিবেকানন্দ মন্তব্য করেন, ‘আঃ, এতক্ষণে সব ঠিক হল; মারও ইচ্ছা আমি যাই।’ কবিজিহবাগ্রবাসিনী সরস্বতী সারদার আশীর্বাদে ভুবন বিজয় করে দেশে ফিরে বিশ্ববন্দিত বিবেকানন্দ শ্রীমাকে বলেছিলেন, ‘মা, আপনার আশীর্বাদে এ যুগে লাফিয়ে না গিয়ে তাদের তৈরী জাহাজে চড়ে সে মুল্লুকে গিয়েছি।’ কুমুদবন্ধু সেন সবিস্তারে এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন— ‘মা তাঁর ঘরের দরজায় সর্বাঙ্গ চাদরে ঢেকে নীরবে দাঁড়িয়েছিলেন।

স্বামীজী তাঁর সামনে এসেই সোজা মাটিতে শুয়ে তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন।… কিন্তু সাধারণ রীতি অনুযায়ী তাঁর পাদস্পর্শ করলেন না। তারপর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে উপস্থিত আমরা যারা স্বামীজীর পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম তাদের কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘যাও, মাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম কর। কিন্তু কেউ তাঁর চরণ স্পর্শ কোরো না। তাঁর এতই করুণা, এতই কোমল তাঁর প্রকৃতি, এতই তিনি স্নেহময়ী যে যখন কেউ তাঁর পাদস্পর্শ করে তিনি তাঁর সর্বগ্রাসী করুণা, সীমাহীন ভালবাসা এবং সমবেদনা দ্বারা তৎক্ষণাৎ তার যাবতীয় দুঃখকষ্ট নিজের মধ্যে আকর্ষণ করে নেন। তার ফলে তাঁকে নীরবে অপরের জন্য কষ্ট ভোগ করতে হয়। ধীরে ধীরে একে একে তাঁর সন্মুখে সাষ্টাঙ্গে প্রণত হও। মুখে কেউ কিছু না বলে তোমাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে নীরবে তাঁর কাছে সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা কর ও তাঁর আশীর্বাদ ভিক্ষা কর। তিনি সর্বদাই অতিলৌকিক স্তরে অবস্থান করেন এবং সকলের মনের কথা জানেন— তিনি অন্তর্যামিনী।’ স্বামীজি স্বামী শিবানন্দ মহারাজকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘দাদা, রাগ ক’রো না, তোমরা এখনও কেউ মাকে বোঝনি। মায়ের কৃপা আমার উপর বাপের কৃপার চেয়ে লক্ষ গুণ বড়।… ঐ মায়ের দিকে আমিও একটু গোঁড়া। মার হুকুম হলেই বীরভদ্র ভূতপ্রেত সব করতে পারে।… দাদা, এই দারুণ শীতে গাঁয়ে গাঁয়ে লেকচার ক’রে লড়াই ক’রে টাকার যোগাড় করছি— মায়ের মঠ হবে। দাদা, মায়ের কথা মনে পড়লে সময় সময় বলি, ‘কো রামঃ?’ দাদা, ও ঐ যে বলছি, ওই খানটায় আমার গোঁড়ামি।’

শ্রীমা’র স্বমুখে সারদা-স্বরূপ উন্মোচন— সর্বদেবদেবীস্বরূপিণ্যৈ শ্রীমা সারদাদেবীও অনেক ক্ষেত্রেই স্বমুখে বলেছেন যে তিনিই মা সরস্বতী! সুরেন্দ্র সেনের অনুরোধে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁকে দীক্ষা দিতে সম্মত হলেও দীক্ষার দিনে স্বামীজি অন্যান্য সকলকে দীক্ষা দেবার পর সুরেন্দ্রকে ডেকে জানালেন, ‘ঠাকুর বললেন, আমি তোর গুরু নই; ঠাকুর দেখিয়ে দিলেন, যিনি তোকে দীক্ষা দেবেন তিনি আমার চেয়েও বড়।’ সেসময় সুরেন্দ্র ভেবেছিলেন যে, তিনি অনুপযুক্ত বলে স্বামীজির থেকে দীক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেলেন না এবং যাতে তাঁর মনে দুঃখ না হয় সেই জন্য স্বামীজি নানাবিধ কথা বলে তাঁকে প্রবোধ দিয়েছেন মাত্র! কিন্তু দিনকয়েক পরেই সুরেন্দ্র রাত্রে স্বপ্ন দেখলেন যে, তিনি ঠাকুরের কোলে বসে আছেন এবং এক উজ্জ্বল দেবীমূর্তি তাঁকে বলছেন, ‘একটি মন্ত্র নাও।’ সুরেন্দ্র সেই বিষয়ে অনাগ্রহী হলেও সেই দেবীমূর্তি মন্ত্র নিতে জোর করতে লাগলে সুরেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে?’ সেই দেবীমূর্তি ‘আমি সরস্বতী’ বলেই দীক্ষামন্ত্র উচ্চারণ করলেন। অতঃপর সুরেন্দ্র পুনরায় যখন জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘এতে কি হবে?’ তখন উত্তর এল, ‘কবি হতে পারবি।’ এই কথা শুনে সুরেন্দ্র অবজ্ঞা করে বলে বসেন, ‘আমি কবি হতে চাই না।’ দেবীমূর্তি তখন বুঝিয়ে বললেন, ‘কবি মানে জানিস? কবি মানে জ্ঞানী।’ এরপর সেই দেবীমূর্তি জপ করবার প্রণালী নির্দেশ করে অন্তত ১০৮ বার জপ করতে নির্দেশ দিলেন। তারপর প্রায় নয় বছর অতিক্রান্ত। শ্রী শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর প্রেরণায় শ্রীশ্রীমা’কে দর্শন করতে সুরেন্দ্র তিন–চার দিনের জন্য জয়রামবাটী যান। দ্বিতীয় দিন মা তাঁকে দীক্ষার কথা বলেন এবং তৃতীয় দিন লক্ষ্মী পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীশ্রীমা তাঁকে দীক্ষা দেন। দীক্ষার সময় মা তাঁর ডান হাত সুরেন্দ্রবাবুর মাথায় এবং বাম হাত চিবুকে রেখে দীক্ষা দিয়েছিলেন। মায়ের দেওয়া মন্ত্র শুনে সুরেন্দ্রবাবু দীর্ঘকাল পূর্বে দৃষ্ট সেই স্বপ্ন দর্শনের কথা স্মরণ করে ক্ষণিকের জন্য সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। প্রকৃতিস্থ হবার পর যখন তিনি দেখলেন যে, সেই স্বপ্নদৃষ্ট দেবীমূর্তি ও মায়ের মূর্তি এক। তখন তিনি সেই কথা মাকে বলার চেষ্টা করতেই মা স্বয়ং বললেন, ‘কেন, মিলছে না? ঠিক মিলেছে তো?’

‘অনন্তরূপিণী অনন্ত গুণময়ী’ শ্রীমা সারদার জীবনে বিদ্যাদায়িনী রূপ বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল নানা রূপে, নানা রঙে, নানা রসে! বহুধা বিচ্ছুরিত সেই বর্ণালির পৃথক পৃথক রূপগুলি নিয়ে আলোচনা করলে সরস্বতীরূপিণী শ্রীশ্রীমায়ের যে যুগন্ধর মাতৃমূর্তি মহাকালের শাশ্বত ক্যানভাসে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সেগুলি হল—

১) জ্ঞানপ্রদায়িনী মা— শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন ‘থিয়েটারে লোকশিক্ষা হয়।’ তাই শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পরও গিরিশবাবু অভিনয় ছাড়েননি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংসারের অসারতা ও নিজের অন্তর্লীন বৈরাগ্যের প্রেরণায় গিরিশবাবু অস্থির হয়ে ওঠেন এবং ১৮৯১ সালে যখন তিনি জয়রামবাটী যান, তখন শ্রীশ্রীমায়ের কাছে সকাতরে সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য অনুমতি চেয়ে বসেন। কিন্তু মা খুব ভালো করেই জানতেন যে, রামকৃষ্ণ লীলানাট্যে গিরিশবাবুর সুনির্দিষ্ট ভূমিকা আছে, বাহ্যসন্ন্যাস ‘ভক্ত-ভৈরবে’র জন্য নয়! তাই গিরিশবাবুর নানান অনুরোধ উপরোধেও মা তাঁকে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দেননি। গিরিশবাবুও ভগবতীর ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে ঠাকুরের স্মরণ-মনন ও শিক্ষা-পুস্তক প্রণয়নাদি কাজেই বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। আর তাঁর যাবতীয় সারস্বত সেবার প্রেরণা ছিলেন ‘অবতারবরিষ্ঠ’ শ্রীরামকৃষ্ণ এবং ‘ভক্তিবিজ্ঞানদাত্রী’ মা সারদা সরস্বতী!

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত রচনা ও পুস্তকরূপে প্রকাশের প্রাক্কালে কথামৃতকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে শ্রীমা ১৮৯৭ সালের ৪ জুলাই আশীর্বাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘বাবাজীবন, তাঁহার নিকট যাহা শুনিয়াছিলে, সেই কথাই সত্য। ইহাতে তোমার কোন ভয় নাই। একসময় তিনি তোমার কাছে এ সকল কথা রাখিয়াছিলেন। এক্ষণে আবশ্যকমত তিনি প্রকাশ করাইতেছেন। ঐ সকল কথা ব্যক্ত না করিলে লোকের চৈতন্য হইবে নাই, জানিবে। তোমার নিকট যে সমস্ত তাঁহার কথা আছে তাহা সবই সত্য। একদিন তোমার মুখে শুনিয়া আমার বোধ হইল, তিনিই ঐ সমস্ত কথা বলিতেছেন।’ ‘বর্ণেশ্বরী’ শ্রীমায়ের অশেষ আশীর্বাদ ও অনন্ত উৎসাহ— প্রেরণাই ছিল মহেন্দ্র গুপ্তের সাফল্যের সঙ্গে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থ রচনার মূল চাবিকাঠি! শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথিকার অক্ষয়কুমার সেন শ্রীমাকে পুঁথি পড়ে শোনান, আর ‘শ্রবণান্তে মাতা তবে কৈল আশীর্বাদ।/নির্বিঘ্নে সমাধা পুঁথি পূর্ণ হবে সাধ।’ পুঁথি পাঠ করে স্বামীজি ১৮৯৫ সালে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ মহারাজকে চিঠিতে পাঠ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘শাঁকচুন্নি (অক্ষয় কুমার সেনকে শ্রদ্ধামিশ্রিত প্রীতিতে স্বামীজি এই নামেই সম্বোধন করতেন) যে ঠাকুরের পুঁথি পাঠাইয়াছে, তাহা পরম সুন্দর। কিন্তু প্রথমে শক্তির বর্ণনা নাই, এই মহাদোষ। দ্বিতীয় edition–এ শুদ্ধ করিতে বলিবে।’ স্বামীজির যথাযথ পরামর্শে তাঁর প্রিয় ‘শাঁকচুন্নি’ পুঁথির দ্বিতীয় সংস্করণে শক্তির জয়গাথা অর্থাৎ গুরুমাতা সারদাদেবীর বন্দনা যুক্ত করে লিখেছিলেন, ‘জয় জয় গুরুমাতা জগত-জননী।/রামকৃষ্ণ ভক্তিদাত্রী চৈতন্যদায়িনী।’ মা সারদা বলতেন, ‘সাধু ভাল, বিদ্বান সাধু আরও ভাল। যেন সোনা দিয়ে বাঁধানো হাতির দাঁত।’ একদিন শ্রীমা তাঁর কয়েকজন সন্তানকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছিলেন, সেখানে স্বামী মাধবানন্দ মহারাজও উপস্থিত ছিলেন। শ্রীমা স্বামী মাধবানন্দ মহারাজকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এই ছেলেটি কবি হবে। কবি মানে জানো? কবি মানে জ্ঞানী।’ বাস্তবিক সরস্বতী সারদার আশীর্বাদে স্বামী মাধবানন্দ মহারাজ শাস্ত্রে সুগভীর পণ্ডিত, আধ্যাত্মিকতায় সুমহান সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছিলেন! রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে তাঁর প্রজ্ঞানিস্নাত বিচক্ষণতা রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ইতিহাসে কিংবদন্তী হয়ে আছে! প্রকৃতপক্ষে স্বয়ং মহামায়াই তো ‘বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা’ হয়ে সকলকে পরিচালিত করেন, আর সরস্বতীরূপিণী মা সারদার অনন্ত কৃপায় স্বামী মাধবানন্দ ‘যেন সোনা দিয়ে বাঁধানো হাতির দাঁত’ হয়ে উঠেছিলেন! শ্রীমা নিজে বিদ্যোৎসাহী ছিলেন, সাধুদের ইংরাজি শিখতেও উৎসাহ প্রদান করতেন, যাতে সন্ন্যাসীরা পাশ্চাত্য ভক্তদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে কথাবার্তা বলতে পারেন— এই কারণে শ্রীমা এমনকি ইংরাজি শেখার জন্য শিক্ষক নিয়োগও করেছিলেন।

২) নারী শিক্ষার আলোকবর্তিকা— নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতার প্রশ্নেও শ্রীমা ছিলেন আলোকবর্তিকা স্বরূপ। ভগিনী নিবেদিতার নারী বিদ্যালয়ের শুভ সূচনা হয়েছিল সরস্বতীস্বরূপা মা সারদার মাধ্যমেই, তিনি দু’হাত তুলে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেছিলেন। হর্ষিত আনন্দে নিবেদিতা জানিয়েছিলেন, ‘ভবিষ্যতের শিক্ষিতা হিন্দু নারী জাতির পক্ষে শ্রীমার আশীর্বাদ অপেক্ষা কোন মহত্তর শুভ লক্ষণ আমি কল্পনা করিতে পারি না।’ এক স্ত্রী-ভক্তের অবিবাহিত পাঁচটি কন্যার জন্য দুশ্চিন্তা করার প্রেক্ষিতে মা বলেছিলেন, ‘বে দিতে না পার, এত ভাবনা করে কী হবে? নিবেদিতার স্কুলে রেখে দিও-– লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে।’ সারদেশ্বরী আশ্রমের প্রতিষ্ঠাত্রী গৌরী মাকে শ্রীমা বলেছিলেন, ‘মেয়েদের বুঝিয়ে দিও, তারা কেবল থোড়বড়িখাড়া, আর খাড়াবড়িথোড় করতে [এ-জগতে] আসেনি।’ মা সারদার অমোঘ আশীর্বাণী ছিল ‘গৌরদাসীর আশ্রমের সলতেটি পর্যন্ত যে উসকে দেবে, তার কেনা বৈকুণ্ঠ।’

৩) যুক্তিনিষ্ঠা— অনুক্ষণ মানসিক সচেতনতা (Mental Alertness), চারপাশের জীবন-জগৎ সম্বন্ধে সদাজাগ্রত ভাব, অন্তর্লীন আধ্যাত্মিকতা ও চূড়ান্ত বাস্তববাদিতার নিরুপম সমন্বয়ের পরাকাষ্ঠা ছিলেন শ্রীমা সারদাদেবী, তিনি ছিলেন যথার্থ অর্থেই আধুনিক। সদা শান্ত, লজ্জাপটাবৃতা হলেও বাস্তব বুদ্ধিতে শ্রীমা ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমতী। তিনি বলতেন, ‘দেখ মা, যেখান দিয়ে যাবে তার চতুর্দিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব দেখে রাখবে। আর যেখানে থাকবে সেখানকারও সব খবরগুলি জানা থাকা চাই।’ নানাবিধ দুরূহ, অনতিক্রম্য, আপাত জটিল জাগতিক সমস্যার প্রশ্নাতীত ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতিমূর্তি ছিলেন রামকৃষ্ণগতপ্রাণা মা সারদা। সে কারণে, শুধু গৃহী ভক্তরাই নন স্বামীজি ও তাঁর গুরুভাইয়েরাও নানাবিধ সমস্যায় শ্রীমায়ের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং মাতৃপ্রদত্ত সমাধানসূত্রকে শর্তহীন আনুগত্যে গ্রহণ করেছেন। বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজার সময়ে স্বামীজির মনে তন্ত্রোক্ত আচার যথাবিধি পালন করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু মা সামগ্রিকভাবে পূজা করার ক্ষেত্রে অকুন্ঠ সমর্থন প্রকাশ করেও বলেছিলেন, ‘তবে বাবা, বলি দিও না, প্রাণী হত্যা কোরো না। তোমরা হলে সন্ন্যাসী, সর্বভূতে অভয়দানই তোমাদের ব্রত।’ বিশ্ববন্দিত স্বামী বিবেকানন্দের কথাতেও যদি কারও কখনও সংশয় হতো সেক্ষেত্রে শ্রীমা-ই হয়ে উঠতেন শেষ বিচারের চূড়ান্ত বাণী! স্বামীজির নিষেধ সত্ত্বেও একদা মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমে গোপনে দ্বৈত পূজার আচারাদি পালন করা হচ্ছে জানতে পেরে স্বামীজি খুবই বিরক্ত হন। সেসময় কেউ কেউ শ্রীমার হস্তক্ষেপ ও মতামত প্রার্থনা করলে শ্রীশ্রীমা পত্রযোগে তাঁর মতামত জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘তোমাদের গুরু অদ্বৈত, তোমরা অবশ্যই অদ্বৈত।’ অর্থাৎ তিনি স্বামীজির মতেই মত দিয়ে বলেছিলেন, অদ্বৈত আশ্রমে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অন্যান্য কেন্দ্রের ন্যায় নিত্যপূজা ও ভোগরাগাদি না হওয়াই কাম্য। বেলুড় মঠে একজন পাচক বারংবার চুরি করে ধরা পড়লে স্বামী প্রেমানন্দ মহারাজ বিরক্ত হয়ে তাঁকে তাড়িয়ে দেন, কিন্তু পরম করুণাময়ী শ্রীমা তাঁকে পুনর্বহাল করার আদেশ দিলে মায়ের বাবুরাম বিনা বাক্যব্যয়ে তা মেনে নিয়েছিলেন। কথামৃতকার মাস্টারমশাইয়ের একটা ধারণা ছিল যে, সাধনভজন করে ঈশ্বরলাভ না করে সমাজসেবায় ব্রতী হওয়া ঠিক শ্রীরামকৃষ্ণের কাজ নয়। শ্রীশ্রীমা একদা কাশী সেবাশ্রমে গিয়ে নরনারায়ণের সেবা দেখে খুব খুশি হয়ে মন্তব্য করেন, ‘দেখলুম ঠাকুর সেখানে প্রত্যক্ষ বিরাজ করছেন— তাই এসব কাজ হচ্ছে। এসব তাঁরই কাজ।’ তখন মাস্টারমশাই মন্তব্য করেছিলেন, ‘আর অস্বীকার করবার জো নেই।’ শিবাবতার স্বামীজি নিজ গুরু ‘চির-উন্মদ-প্রেম-পাথার’ শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও ‘করুণা-পাথার-জননী’ সারদার মতই মানুষের প্রতি ‘ভালবাসায় আন্ডিল’ হয়ে গিয়েছিলেন। তাই কলকাতায় মহামারী প্লেগের সময় সেবাকার্যের জন্য যখন প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব দেখা দেয়, সেই সময় স্বামীজি তাঁর প্রাণপ্রিয় বেলুড় মঠের জমি বিক্রি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। সেই ক্রান্তিকালে স্বামীজির সুতীব্র প্রেমোন্মত্ততায় লাগাম দিয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীমা। যে মহাশক্তি মানববুদ্ধির অগম্যা, কিন্তু যিনি কৃপা করে সর্বভূতে বুদ্ধিরূপে সংস্থিতা হন— সেই সারদা সরস্বতী স্বামীজিকে বলেছিলেন, ‘সে কি বাবা, বেলুড় মঠ বিক্রি করবে কি? মঠ-স্থাপনায় আমার নামে সঙ্কল্প করেছ এবং ঠাকুরের নামে উৎসর্গ করেছ, তোমার ও-সব বিক্রি করবার অধিকারই বা কোথায়?… বেলুড় মঠ কি একটা সেবাকাজেই শেষ হয়ে যাবে? তাঁর কত কাজ। ঠাকুরের অনন্ত ভাব সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। যুগ যুগ ধরে এইভাবে চলবে।’ যদিও শ্রীমায়ের কৃপায় পরে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান হয়ে যায় এবং তাঁরই কৃপায় আজও বেলুড় মঠ যুগযুগ নররূপী নারায়ণের সেবা করে চলেছে। শ্রীমায়ের যুক্তিনিষ্ঠার আড়ালে অনন্ত প্রেমে বেহিসাবি এক মাতৃহৃদয় সদাই বিরাজিতা ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিরন্ময় যুক্তিনিষ্ঠা ও মানুষের প্রতি সুগভীর ভালোবাসায় মা সারদা এমনতর সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন, যা দেশ-কাল ছাপিয়ে অতি আধুনিক মানুষদেরও ভাবনার অতীত ছিল। জনৈক ব্যক্তির উপপত্নীর প্রতি সেবায় মুগ্ধ হয়ে মা সারদা বলেছিলেন, ‘কি সেবাটাই করেছে, মা, এমন দেখিনি! একেই বলে সেবা, একেই বলে টান!’ আবার কোয়ালপাড়ায় এক ডোমের মেয়ের উপপতি তাকে ছেড়ে চলে গেলে তাকে মা বলেছিলেন, ‘ও তোমার জন্য যথাসর্বস্ব ফেলে এসেছে; এতকাল তুমি ওর সেবাও নিয়েচ; এখন যদি একে ত্যাগ কর, তোমার মহা অধর্ম হবে— নরকেও স্থান হবে না।’ শ্রীমাকে ভক্ত সন্তানের খাওয়া এঁটো পরিষ্কার করতে দেখে গোলাপ মা আপত্তি জানালে, শ্রীমা সঙ্কোচহীন দৃঢ়তায় বলে ওঠেন, ‘শুদ্দুর কে, গোলাপ? ভক্তের জাত আছে কি?’ জ্ঞান ও প্রেমের শাশ্বত জারণে মথিত এই সকল ঘটনাই বুঝিয়ে দেয় সাক্ষাৎ ভগবতী ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে এইরকম সুগভীর যুক্তিনিষ্ঠা ও সুতীব্র প্রেমের যুগলবন্দি ঘটা সম্ভব নয়।

৪) সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী ক্ষমতা— শরীর ধারণ করে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে যে দিব্যলীলা করে গিয়েছিলেন, সেই লীলাখেলার মূল কারণ কী ছিল? তাঁর আগমনের মুখ্য উদ্দেশ্যই বা কী ছিল? এই বিষয় নিয়ে একবার ভক্তদের মধ্যে আলোচনা চলছে—নানাবিধ মতের মধ্যেই একসময় ‘সর্বধর্ম সমন্বয়ে’র প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল। এই বিষয়ে শ্রীমায়ের মত জানতে চাওয়া হলে সরস্বতীস্বরূপিণী মা সারদা তাঁর অপূর্ব সূক্ষ্ম ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, ‘সমন্বয় ভাল বটে, তবে ঠাকুর এসেছিলেন ত্যাগের ভাব দেখাতে… তিনি (ঠাকুর) যে মতলব করে সমন্বয় প্রচার করেছেন, তা কিন্তু আমার মনে হয় না। তিনি ত্যাগের ভাবই দেখিয়েছেন প্রচার করেছেন।’ তিনি যেহেতু স্বয়ং সর্বজ্ঞা, ব্রহ্মবাদিনী, সকল ভাবনার উৎসস্বরূপা ছিলেন, তাই অনায়াসে যেকোনো ঘটনার ভাবার্থ ও সারার্থ গ্রহণে পারঙ্গম ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে শান্তি স্থাপনার উদ্দেশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন চোদ্দ দফা সন্ধিশর্ত ঘোষণা করলে জ্ঞানী-গুণী বহু মানুষ তার নানাবিধ পর্যালোচনা করেছিলেন। কিন্তু এই ঘটনার প্রেক্ষিতে শ্রীমার মন্তব্য ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, ‘ওরা যা বলে, ওসব মুখস্থ।… যদি অন্তঃস্থ হত তাহলে কথা ছিল না।’ পরবর্তীকালের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে এই জাতীয় শান্তিচুক্তি ও তার শর্তাবলী কতটা প্রাণহীন-কৃত্রিমতায় ভরা হয়ে থাকে। আর এই ক্ষেত্রে শ্রীশ্রীমায়ের দৈবী দূরদর্শিতা ছিল বিস্ময়করভাবে অভ্রান্ত! আবার প্রাচ্য দেশে জন্মে ও তথাকথিত শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হয়েও সর্বভূতান্তরবাসিনী মায়ের মধ্যে সার্বজনীন আন্তর্জাতিকতা বোধ ছিল পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। সর্বগ্রাহী উদার মন দিয়ে মা ভিন্ন সংস্কৃতির আচারাদি ও তার অন্তঃস্থ নির্যাসও অনায়াসে গ্রহণ করতে পারতেন। একবার ভগিনী নিবেদিতা ও ভগিনী ক্রিস্টিন খ্রিস্টান বিবাহপ্রথা অভিনয় করে দেখানোর সময় বিবাহের মন্ত্র উচ্চারণ করেন, ‘সম্পদে-বিপদে, ঐশ্বর্যে-দারিদ্রে, রোগে-স্বাস্থ্যে— যতদিন মৃত্যু আমাদের বিছিন্ন না করে।’ এই শাশ্বত বাক্য শুনে চমৎকৃত মা সারদা বলে ওঠেন ‘আহা, কী ধর্মী কথা! কী ন্যায়পূর্ণ কথা!’ ১৯১৭ সালের দুর্গাপূজার সময় শ্রীমা স্বামী ঈশানানন্দ মহারাজকে ভাইপো-ভাইঝিদের জামাকাপড় কেনার ভার দিলে স্বদেশি ভাবাপন্ন মহারাজ দেশি মিলের কাপড় কিনে নিয়ে যান। কিন্তু ওই মোটা কাপড় অন্যদের অপছন্দ হলে তারা বিদেশি মিহি কাপড়ের ফরমাশ করতে থাকেন, আর তাতে বিরক্ত হয়ে মহারাজ বলেন, ‘ওসব তো বিলিতি হবে, ও আবার কি আনব?’ শ্রীমা হাসতে হাসতে বলেন, ‘বাবা, তারাও (বিলাতের লোকেরা) তো আমার ছেলে। আমার সকলকে নিয়ে ঘর করতে হয়। আমার কি একরোখা হলে চলে? ওরা যেমন বলছে, তাই সব এনে দাও। এদেরকেও (নলিনী দি, মাকু দি) মনটি বুঝে আমায় চলতে হয়। আমাকে অনেক ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হয়, বাবা।’ কিন্তু পরবর্তীকালে বিলিতি দ্রব্য কেনার হলে শ্রীমা ঈশানানন্দ মহারাজকে না বলে অন্য কাউকে দিয়ে কাপড় আনাতেন, কারণ কারোর ভাবে আঘাত দেওয়াটা তাঁর একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ ছিল।

৫) অন্যান্য শিল্পকলার সমর্থক— দেবী সরস্বতী পড়াশুনার পাশাপাশি বিভিন্ন গান্ধর্ব বিদ্যারও অধিষ্ঠাত্রী দেবী। মা সারদাও সঙ্গীত, অভিনয়, শিল্পকলা ইত্যাদির গুণগ্রাহী ছিলেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ মহারাজের নির্দেশে অপরেশচন্দ্র মজুমদার ‘রামানুজ’ নাটক রচনা করেন এবং স্বামী অম্বিকানন্দ তাতে সুরারোপ করেছিলেন। সেকালে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা থিয়েটারে যেহেতু অভিনয় করতেন না, তাই ‘রামানুজ’ যখন মঞ্চস্থ হয় সেখানে অভিনয় করেছিলেন পতিতা অভিনেত্রীরা। কিন্তু যেভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ ‘ত্যাজি জাতি কুলমান’ হয়ে স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা দেখতে গিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই মা সারদাও থিয়েটারে ‘রামানুজ’ নাটক দেখতে যান। তারাসুন্দরী, নীরদাসুন্দরী প্রমুখ অভিনেত্রীদের তিনি দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করেছিলেন। তারাসুন্দরীকে তো ‘আয় মা, আয়’ বলে আদর পর্যন্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে তারাসুন্দরীর কাছে মা গান শুনতেও চেয়েছিলেন। শ্রীমা ছিলেন কর্মাধীশ ভগবতী, তাই তাঁর মধ্যে কর্মাধীন মানুষের ন্যায় জাগতিক সংস্কার ছিল না। তিনি স্বমুখেই বলেছেন, ‘তখন, মা, যাত্রা কথকতা এইসব ছিল। আমরা কত শুনেছি।’ দুর্গাপুরী দেবীর বয়ানে জানা যায়, ‘মাতাঠাকুরাণী সঙ্গীতানুরাগিণী ছিলেন, নিজেও গাহিতে পারিতেন। তাঁহার কণ্ঠ ছিল অতি মধুর, কিন্তু পাছে কেহ শুনিতে পায় এইজন্য নিম্নকণ্ঠে গাহিতেন।’ স্বরত্মিকামা সারদা নিজেও বলেছেন, ‘গানের তুল্য কি জিনিষ আছে? গানে ভগবানকে পাওয়া যায়।’ সেকালের প্রথিতযশা গায়ক অঘোরনাথ চক্রবর্তীর গান শুনে শ্রীমা যেমন বিভোর হয়েছেন, ঠিক তেমনি মাতৃসেবক স্বামী সারদানন্দ মহারাজ, পুলিনচন্দ্র মিত্র, জ্ঞানেন্দ্রনাথ কাঞ্জিলাল, লক্ষ্মী দিদি প্রমুখদের ঘরোয়া ভক্তিসঙ্গীত শুনেও শ্রীমা সমআনন্দে আত্মস্থ হয়েছেন। পরবর্তী জীবনে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন সোহরাব মোদী যিনি যৌবনে শ্রীমার কাছে মন্ত্রদীক্ষা পেয়েছিলেন।

৬) কৌতুক ও রঙ্গপ্রিয়তা— তৈত্তিরীয় উপনিষদের একটি বিখ্যাত শ্লোক ‘রসো বৈ সঃ’ যার অর্থ হল, ব্রহ্ম (ঈশ্বর) আনন্দস্বরূপ বা রসের আধার। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, ‘আমি শুষ্ক সন্ন্যাসী হব না, রসে বশে থাকব।’ শ্রীমাও সে কথার সমর্থন করে বলেছেন ‘ঠাকুরকে কখনও নিরানন্দ দেখিনি।’ সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী লিখছেন, ‘ঠাকুর সংসারকে মজার রসে রসিয়ে দেখতেন। তাঁর কাছে এলে মানুষ না হেসে পারত না। সকলে ফিরে যেত প্রসন্নতা নিয়ে। গভীর রসের সঙ্গে হাসির রসের মিলন— এ এক রেয়ার কম্বিনেশন। আমরা গুরু বলতে বুঝি— তিনি ২৪ ঘন্টার গুরু মশাই। আর আমার এই ঠাকুর ২৪ ঘন্টার আপনজন।’ এই একই কথা মায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং মা সারদাকে বলেছেন ‘আনন্দময়ী’। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতানুসারে ভগবান তিনটি আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে প্রকাশ পান— সন্ধিনী (অস্তিত্বের শক্তি), সম্বিত (জ্ঞানের শক্তি) ও হ্লাদিনী (আনন্দের শক্তি)। হ্লাদিনী শক্তির মাধ্যমে ঈশ্বর নিজে আনন্দ অনুভব করেন এবং সেই আনন্দ ভক্তদের মধ্যে সঞ্চারিত করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ অবতার লীলায় শক্তিস্বরূপিনী সারদা ছিলেন অনন্ত আনন্দের উৎসবিন্দু— যেখান থেকে উৎসারিত আনন্দধারা অবতার পুরুষ ও তাঁর আগত-অনাগত সকল ভক্তদের প্রেম-প্রীতির ঊর্জিতা স্রোতে স্নাত করেছে। শুধুমাত্র সত্তাগতভাবেই নয়, বাস্তব আচরণেও শ্রীমার মধ্যে সম্বিত শক্তি ও হ্লাদিনী শক্তির যুগল সন্মিলন প্রকাশ পেয়েছে অহরহ!

উপসংহার— স্বামী গম্ভীরানন্দ তাঁর ‘শ্রীমা সারদা দেবী’ গ্রন্থে সারদা সরস্বতীর সম্বন্ধে লিেখছেন, ‘এই অখণ্ড শক্তিকে প্রকৃতপক্ষে বিশ্লেষণ করা চলে না;… [কারণ] আমাদের সসীম বুদ্ধি অসীমকে ধরিতে পারে না। আমাদের ধারণাশক্তির অক্ষমতাবশতঃ আমরা শ্রীমাকে জননী, গুরু, দেবী ইত্যাদির অন্যতমরূপে ভাবিতে চেষ্টা করি; কিন্তু একটু চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারি যে, এই লোকাতীত জীবনে গুরু, দেবী ও মাতা — এই ত্রিবিধ রূপই অঙ্গাঙ্গিভাবে সংশ্লিষ্ট। যখনই আমরা তাঁহাকে জননীরূপে পাই, তখনই আমাদের সম্মুখে ফুটিয়া উঠে তাঁহার অমোঘ জ্ঞানদায়িনী শক্তি; যখনই তাঁহাকে দেখিতে চাই গুরুরূপে, তখনই তিনি মাতৃরূপে আমাদিগকে ক্রোড়ে টানিয়া লন; আবার গুরু ও জননীরূপে তাঁহাকে ধরিতে গিয়া দেখি তিনি সমস্তের ঊর্ধ্বে দেবীরূপে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।’ শান্তিদা-মোক্ষদা-বরদা-জ্ঞানদা সারদেশ্বরী সকল জীবকে শুরুতে অপরা এবং অন্তিমে পরাবিদ্যার জ্ঞান প্রদান করে ভবসাগর পার করে দেন— তাই তিনি ‘ভবতারিণী’, তিনি ‘সর্ববিদ্যাস্বরূপিণী’ সারদা সরস্বতী।

উৎস গ্রন্থাদি—
১) শ্রীমা সারদা দেবী, স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়
২) শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, শ্রীম, উদ্বোধন কার্যালয়
৩) শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপুঁথি, অক্ষয় কুমার সেন, উদ্বোধন কার্যালয়
৪) স্বামীজীর বাণী ও রচনা, উদ্বোধন কার্যালয়
৫) শতরূপে সারদা, রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অফ কালচার, গোলপার্ক
৬) ভগিনী নিবেদিতা, প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা, সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুল
৭) সারদা-রামকৃষ্ণ, দুর্গাপুরী দেবী, শ্রীশ্রীসারদেশ্বরী আশ্রম
৮) শ্রীশ্রীসারদা দেবী, ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, ক্যালকাটা বুক হাউস