সুস্মিতা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়
‘আমি পথিক, পথ আমারি সাথী
যত আশা পথের আশা,
পথে যেতেই ভালোবাসা,
পথে চলার নিত্যরসে দিনে দিনে
জীবন ওঠে মাতি’….
শুধু অনন্তের পথে নয়, পথমাত্রই কবির চিত্তকে চঞ্চল করে। পথিক কবির অতীতের প্রতি মায়া নেই। ভবিষ্যতের আশা তিনি রাখেন না— শেলীর স্কাইলার্কের মত বর্তমান তাঁর উপভোগ্য। অনন্ত পথের পরিব্রাজক কবির পরম বন্ধু যেন পথ। কবি একলা সেই অজানা পথের যাত্রী। চলার পথেই তিনি মাতিয়ে চলেছেন। কবি বলেছেন, ‘গৃহই অতীতের জন্য শোক করে, বর্তমানের জন্য ভাবে, ভবিষ্যতের আশায় পথ চাহিয়া থাকে।’
পথবিলাসী কবি তাই পথের ধর্মই লাভ করেছেন জীবন পথে চলতে চলতে। পথের বাণীকে তিনি রাজপথের রূপ দিয়েছেন। কবির জীবনে অজানার জন্য অসীম ব্যাকুলতা— নিত্যনতুন সাধনাতে নিত্যনতুন ব্যথা।
গৃহের চেয়ে পথই তাঁর আপনার। কবির জীবনে অবিরাম যাত্রা অজানার উদ্দেশে। অজানা কবিকে আকর্ষণ করে, কিন্তু পথের শেষে কী আছে তা তিনি জানেন না— তিনি পথ চলার মধ্যেই আনন্দ পান— নিত্যই হাতে হাতে পথে পথেই সেই আনন্দ। এই আনন্দই তাঁর পাথেয়, এই আনন্দই তাঁকে অগ্রগমনে উৎসাহ ও উদ্দীপনা দান করে। কবি বলেছেন—
‘পেলেই সে তো ফুরিয়ে ফেলি, আবার আমি দুহাত মেলি—
নিত্য দেওয়া ফুরায় না যে, নিত্য নেওয়া তাই।’
আসলে তৃষ্ণা অসীম। তৃষ্ণার তৃপ্তির জন্য প্রার্থনার অন্ত নেই— প্রাপ্তিরও সীমা নেই। অনিশ্চিতকে গ্রহণ করার জন্য মানুষকে আত্মমগ্নতা থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসতেই হয়। নিজের ‘আমিত্ব’কে বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে দেবার জন্য বিস্ময়বোধ একটি বিশেষ অনুঘটকের কাজ করে। যে কোনও কবি-শিল্পীর মধ্যেই এই বিস্ময়বোধ থাকে, কিন্তু তার পাশাপাশি যেখানে তিনি একজন ব্যক্তি মানুষমাত্র সেখানে তাঁর আমিত্বের আত্মকেন্দ্রিকতাও থেকে যায়। সেখানেই তিনি অন্য অকবির মতো নিশ্চিত আশ্রয় খোঁজেন না। রবীন্দ্রনাথও সম্ভবত এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। বিচিত্র পৃথিবীর পানে তাকিয়ে তাঁর বিস্ময়, সমর্পণ তাই সত্যি।
রবীন্দ্রনাথের মতে, প্রেম এক শক্তিশালী শক্তি যা সৃষ্টির উৎস এবং এর মাধ্যমেই মানুষ তার আত্মিক উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে। আসলে রবীন্দ্রনাথের দর্শনে আত্মার অমরত্ব একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা প্রকৃতি ও মানবতাবাদী চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রেমের মাধ্যমে আত্মার পূর্ণতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা অর্জনের মধ্যেই এর সার্থকতা নিহিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ‘আধ্যাত্মিক সাধনা’ অরূপের সাধনা। সাধকরা বস্তু পৃথিবীর বাইরে অতীন্দ্রিয় জগতের অনুসন্ধান করেন সেই সাধনায়। ‘আধ্যাত্মিকতা’ আমাদের চেতনাকে ঈশ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এর মাধ্যমে তাঁর আনন্দরূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সন্ন্যাসী কিংবা সাধক ছিলেন না। তিনি সুফিধারাসহ অন্য মরমিয়াদের মতো অধ্যাত্মসাধনায় নিমগ্নও হননি। তিনি ছিলেন কবি। তবে তাঁর সমগ্র চেতনার মধ্যে একটা নিগূঢ় অধ্যাত্ম-অনুভূতি ছিল— সেই অনুভূতিই তাঁর শিল্পচেতনার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কাব্যরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাঁর খেয়া-গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালি কাব্য এবং অন্যান্য রচনায় আধ্যাত্মচেতনা প্রকাশিত হয়েছে। কবির আধ্যাত্মসাধনা নিঃসন্দেহে সর্বজনীন চেতনা দ্বারা পরিশুদ্ধ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শনে, আত্মা এক অবিরাম যাত্রা, যা প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত এবং ক্রমবিকাশের পথে চলে। তিনি আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করতেন, তবে তা জাগতিক ধারণার বাইরে, এক অসীম সত্তার সঙ্গে মিশে যাওয়া। তাঁর মতে, মানুষের জীবন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আত্মা ক্রমাগত বিকশিত হয় এবং প্রকৃতির বৃহত্তর সত্তার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার দিকে এগিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, আত্মা শরীর ত্যাগের পরেও ধ্বংস হয় না, বরং প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিদ্যমান থাকে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয় না, বরং বৃহত্তর সত্তার সঙ্গে মিশে যায়। আত্মার পূর্ণতা জাগতিক বস্তু বা খ্যাতিতে নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা এবং বৃহত্তর সত্তার উপলব্ধি ও প্রেম-ভালোবাসার মাধ্যমে আসে। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির প্রতিটি স্তরে ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করতেন এবং মানুষের জীবনকে প্রকৃতির বৃহত্তর ধারার সঙ্গে যুক্ত মনে করতেন। তাই প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করা এবং তার সৌন্দর্য ও রহস্য উপলব্ধি করা আত্মার বিকাশে সহায়ক। রবীন্দ্রনাথের দর্শনে মানবতাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। তিনি মনে করতেন, মানুষের প্রতি প্রেম ও সেবার মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি ঘটে এবং এটিই আত্মার পূর্ণতার পথ।
উপনিষদের ব্যাপকতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে সর্বত্র, কি কবিতায়, কি গল্পে। আবার গানের ছত্রে ছত্রে দুরন্ত বহতা নদীর মতো প্রবাহমান। উদাহরণস্বরূপ, গীতাঞ্জলি কাব্যে তিনি লিখেছেন: ‘জীবনে যত পূজা হল না সারা, জানি হে জানি তাও হয়নি হারা। যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে, যে নদী মরুপথে হারালো ধারা—’। এটি ঔপনিষদিক ধারণাকে প্রতিফলিত করে যে, শাশ্বতই একমাত্র আশ্রয়। ভারতে মায়া গানটিতে তিনি গেয়েছেন ‘হে মা, বিশ্ব তোমার দেহ’। কিংবা ‘হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ, কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান’। এটি ঔপনিষদিক ধারণাকে প্রতিফলিত করে যে, মহাবিশ্ব ব্রহ্মের একটি প্রকাশ। ব্রহ্ম হল চরম বাস্তবতা, সর্বব্যাপী, মহাবিশ্বের চিরন্তন সারমর্ম। এটি সমস্ত অস্তিত্ব এবং জ্ঞানের উৎস। উপনিষদ শিক্ষা দেয় যে, ব্রহ্ম অতীন্দ্রিয় এবং অবিনশ্বর, সমস্ত কিছুকে পরিব্যাপ্ত করেও তাদের বাইরেও রয়েছে। ব্রহ্ম হল অপরিবর্তনীয় নীতি, যা অভূতপূর্ব জগতের অন্তর্গত। ঔপনিষদিক চিন্তাবিদদের জন্য, এই জ্ঞান হল প্রজ্ঞার সর্বোচ্চ রূপ, কারণ এটি উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায় যে, আত্মা স্বতন্ত্র, অবিভাজ্য বাস্তবতার অংশ। বাড়িতে ব্যক্তিগত শিক্ষকদের দ্বারা, ঠাকুর ব্রিটিশ উদারনীতির নতুন ধারণাগুলির সঙ্গেও উদ্ভাসিত হয়েছিলেন, যা ধীরে ধীরে ভারতের সমাজ ধারণ করতে শুরু করেছিল। এই আদর্শের সংমিশ্রণটি তাঁর লেখায় একটি বড় প্রভাব ফেলেছিল পরবর্তী সময়ে।
তিনি উপনিষদের আরেকটি চরম সত্য দার্শনিক ধারণা— ‘আত্মা’র দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ তাদের অভ্যন্তরের সঙ্গে সংযোগ করতে পারে এবং এই সংযোগ শান্তি এবং সুখ আনতে পারে। তিনি এই ধারণাটিকে তাঁর লেখায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তাঁর অনেক কাজই মানুষ এবং তাদের অন্তর্নিহিত চিন্তা ও অনুভূতির মধ্যের সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই তৈরি। উপনিষদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার উপর একটি বড় প্রভাব ফেলেছিল। তিনি মানব প্রকৃতির আধ্যাত্মিক দিকটি অন্বেষণ করার জন্য তাদের শিক্ষার উপর আকৃষ্ট হয়েছিলেন। উপনিষদ শিক্ষা দেয় যে, আত্মা চিরন্তন এবং আমাদের প্রকৃত প্রকৃতি হল ঐশ্বরিক। রবীন্দ্রনাথ এই দর্শন ব্যবহার করেছিলেন মানুষের হৃদয়ের গভীরতম গভীরতা অন্বেষণ করতে এবং সমস্ত মানুষের আধ্যাত্মিক সম্ভাবনাকে উদ্যাপন করতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ধারণাগুলিকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করেছিলেন এবং নিজস্ব একটি দার্শনিক ভাবধারা বিকাশের জন্য ব্যবহার করেছিলেন, যা উপাদানের চেয়ে আধ্যাত্মিকতাকে বেশি মূল্য দেয়। ঔপনিষদিক ধারণাগুলি রবীন্দ্রনাথের লেখার সর্বত্র দেখা গেলেও তাঁর কবিতায় তিনি মানব আত্মার আধ্যাত্মিক যাত্রার বর্ণনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, জীবনের গভীরতম সত্যগুলি কেবল কবিতার মাধ্যমেই ধরা যায় এবং শিল্পীর আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত জগতের মধ্যস্থতাকারী হিসাবে সমাজে একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘হৃদয়ের ধর্ম’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘উপনিষদ আমার পবিত্র গ্রন্থ। আমি তাদের আমার গুরু বলে মনে করি।’ তিনি তাঁর নিজস্ব অনন্য সাহিত্য ও দার্শনিক কাজ তৈরি করতে তাদের ধারণাগুলিকে নিজের চিন্তা-চেতনার মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করেন এক সমসাময়িক চিরন্তন দার্শনিক তত্ত্ব। তাঁর প্রবন্ধ, ‘ভারতের ধর্ম’তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন: ‘বেদান্ত আমাদের সংস্কৃতি তৈরিতে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে। এটি ভারতের আধ্যাত্মিক জীবনের উৎস এবং তার নৈতিক আদর্শের বসন্ত প্রবাহ। এটি তার চারুকলার জননী এবং তার দর্শনের ভিত্তি।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক লেখা তাঁর আধ্যাত্মিক এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। তিনি প্রায়শই অনুপ্রেরণার জন্য উপনিষদের দিকে চোখ ফেরাতেন। ঐক্য ও আত্ম-জ্ঞানের বিষয়বস্তু তাঁর কাজকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে। ঠাকুরের জন্য সাহিত্য ছিল জীবনের আধ্যাত্মিক মাত্রা অন্বেষণের একটি উপায় এবং উপনিষদগুলি অস্তিত্ব সম্পর্কে গভীরতম সত্য বোঝার মূল চাবিকাঠি। তিনি লিখেছেন: ‘উপনিষদ হল হিন্দুদের সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থ। এগুলিতে বেদের সারমর্ম রয়েছে এবং সমস্ত হিন্দু দর্শনের ভিত্তি। তারা শেখায় যে, আত্মা পরম সত্তার সঙ্গে এক এবং সমস্ত মহাবিশ্ব এক।’ রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়লে অনুধাবন করতে কোনও অসুবিধা হয় না যে, তিনি উপনিষদের একজন মহান অনুরাগী ছিলেন, যার প্রভাব তাঁর লেখায় স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। উপনিষদ বলে, আধ্যাত্মিক জগৎ ভৌত জগতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৭৮ সালে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন, যেটিতে আধ্যাত্মিক জগৎ সম্পর্কে কবিতা অন্তর্ভুক্ত ছিল। উপনিষদ এছাড়াও শিক্ষা দেয় যে আত্মা অমর এবং মানুষের একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করা উচিত। তিনি অন্যদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনের গুরুত্বেও বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর লেখা এই বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে। রবীন্দ্রনাথ অদ্বৈত বেদান্তের ভারতীয় দর্শন দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন, যা শেখায় যে ভৌত জগৎ একটি ভ্রম এবং শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক জগতই বাস্তব। এই দর্শন শিক্ষা দেয় যে, সমস্ত মানুষ শেষ পর্যন্ত এক।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, যৌবনে মৃত্যুর সম্ভাবনা দূরবর্তী। তাই তাকে নিয়ে কাব্যের মধ্যে দিয়ে লীলাবিলাস চলেছে। বার্ধক্যে মৃত্যু আসন্ন তখন তাকে নিয়ে আর লীলারস চলে না। মৃত্যুভয়কে একেবারে অস্বীকার তিনি করতে পারেননি। মৃত্যুভয়কে জয় করবার জন্য তিনি মৃত্যুর অনেক সঙ্গত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
কবি বলেছেন,
‘মানুষের মুখ্য ভয়, মৃত্যুভয়
কেমনে করিবে তারে জয় নাহি জানে।
তাই সে হেরিছে ধ্যানে—
মৃত্যুবিজয়ীর এটা হতে অক্ষয় অমৃত স্রোতে
প্রতিক্ষণে নামিছ ধরায়।’
কবি অনন্তপথ যাত্রার পরিকল্পনায় সান্ত্বনা লাভ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, আত্মা শাশ্বত, ব্রহ্মের সঙ্গে সংযুক্ত এক চূড়ান্ত বাস্তবতা। রবীন্দ্রনাথের জন্য, উপনিষদ ছিল তাঁর সারা জীবন অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনার উৎস। যে মানুষ একটি বৃহত্তর সমগ্রের শুধুমাত্র টুকরো অংশ, এবং আমরা বৃহত্তর মহাবিশ্বের সঙ্গে সংযোগ করেই প্রকৃত সুখ খুঁজে পেতে পারি। এই দর্শনটি তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয় বারবার, যা প্রায়শই পাঠকদের বইয়ের বাইরে চিন্তা করার এবং পৃথিবীতে বিদ্যমান সৌন্দর্য দেখতে আহ্বান জানায়। রবীন্দ্রনাথও উপনিষদের সমস্ত জীবনের ঐক্যের বিশ্বাস দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তিনি প্রায়শই মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে আধ্যাত্মিক সংযোগ সম্পর্কে লিখতেন। উপনিষদ তাঁকে দেখিয়েছিল যে, মহাবিশ্ব একটি একক, ঐশ্বরিক নীতির প্রকাশ এবং জীবনের লক্ষ্য এই নীতির সঙ্গে আমাদের ঐক্য উপলব্ধি করা। এই উপলব্ধি জ্ঞানের সর্বোচ্চ রূপ।
কবি বলেছেন, পরমাত্মার জন্য জীবাত্মার মিলনাগ্রহ মানবের স্বাভাবিক ধর্ম। আমরা প্রকৃতির বৈচিত্র্যের মধ্যে মাঝে মাঝে একে স্পষ্টভাবে ধরতে পারি। পূর্ণের পথের যাত্রী আত্মার অমরতা ও অসীমতায় বিশ্বাসী কবির অন্তরে একদিকে যেমন অসীম তৃষ্ণা, তেমনি অপরদিকে অসীম আশা। তিনি জানেন মানুষের কোনও সাধনাই ব্যর্থ নয়– যা কিছু অসম্পূর্ণ, সবই পূর্ণতা লাভ করবে একদিন।
‘এ জন্মের যা কিছু সুন্দর
স্পর্শ যা করেছে প্রাণ দীর্ঘ যাত্রাপথে
পূর্ণকার ইঙ্গিত জানায়ে
বাজে মনে নহে দূর নহে বহুদূর।’
নদী যেমন অসীমের মধ্যে পূর্ণতা লাভ করে তেমনি অসীমের মধ্যে আমাদের সকল সাধনাই একদিন পূর্ণতা লাভ করবে। এই সীমার জগতেও আমরা দেখি, যার অবসান হল মনে করি, তা নব নব রূপে ফিরে ফিরে আসে।
‘ফুরায় যাহা ফুরায় শুধু চোখে—
অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে।
পুরাতনের হৃদয় টুটে
আপনি নূতন উঠে ফুটে
জীবনে ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে।’
কবি অপূর্ণকে সূর্যের বিপরীত মনে করেন না। বলেন, পূর্ণাভিমুখী। তাই তো তিনি বলেছেন—
‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা
ধূলায় তাদের যত হ’ক অবহেলা
পূর্ণের পদপরশ তাদের পরে।’
কবি যেন সত্যের উপলব্ধি করে নিজেকে বার বার আশ্বস্ত করেছেন, সেই সত্যের কথা প্রভুর উদ্দেশে বলেছেন—
‘জীবনে যত পূজা হলো না সারা,
জানি হে জানি তাও হয়নি সারা।
যে ফুল না ফুটিয়ে ঝরেছে ধরণীতে,
যে নদী মরুপথে হারাল ধারা
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।’
‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান।/মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,/রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট/ তাপবিমোচন করুণ কোর তব/মৃত্যু অমৃত করে দান।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রথম প্রভাতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে অমৃতের স্বরূপ বলেই আহ্বান করেছিলেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে ‘মরণ’ কবিতায়। আবার বলেছেন, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’।
অসীম প্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে যেমন বিশ্বস্বীকৃতি এনে দিয়েছেন, তেমনি তাঁর চিন্তার স্তরে স্তরে যে মানবকল্যাণের বিচিত্র দিক প্রতিফলিত, রবীন্দ্র-গবেষণায় তা উঠে এসেছে। তবে সুদীর্ঘ জীবনে রবীন্দ্রনাথকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ধারণ-লালন করতে হয়েছে। বালক বয়সে মায়ের মৃত্যু এবং পরবর্তী সময়ে সন্তান ও স্ত্রীর অকালমৃত্যু এর মধ্যে অন্যতম। মৃত্যুর মতো বেদনাবহ ঘটনা যেখানে সমগ্র মানবসত্তাকে ওলোট-পালট করে দিতে সক্ষম, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একান্ত স্বজন হারিয়েও নিজেকে স্থির রেখেছিলেন। তবে কাব্য-সাহিত্যে কবির ‘মৃত্যু-দর্শন’ নানা অনুষঙ্গে বিকশিত ও সমন্বিত হওয়া থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, যতই তিনি বেদনাবহ ঘটনাগুলো সসম্মানে আত্মস্থ করে উপেক্ষা করুন না কেন— নিজের জন্মদিনের আড়ম্বর নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লেখেন— ‘খ্যাতির কলবরমুখর প্রাঙ্গণে আমার জন্মদিনের যে আসন পাতা রয়েছে, সেখানে স্থান নিতে আমার মন যায় না। আজ আমার প্রয়োজন স্তব্ধতায় শান্তিতে।’ আবার, নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থে ‘মৃত্যু’ কবিতায় বলেন—
‘মৃত্যু অজ্ঞাত মোর
আজি তার তরে
ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে
এত ভালোবাসি
বলে হয়েছে প্রত্যয়
মৃত্যুরে আমি ভালো
বাসিব নিশ্চয়।’
অস্বীকারের সুযোগ নেই, ‘মৃত্যু’ এমনই এক বাস্তব সত্য যে, মৃত্যু সম্পর্কে বিশ্বাসের কোনও প্রয়োজন পড়ে না। যদিও মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় করে মৃত্যুকে। তাই সবসময় মৃত্যুকে এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াতে চায়। তবুও মৃত্যুকে আলিঙ্গন না করে কোনও উপায় নেই মানুষের। কবির অধিকাংশ কবিতা এবং গানে পরমাত্মায় নিবিষ্ট হওয়ার গভীর আকুতি প্রতিভাত। পরমপুরুষের সান্নিধ্য লাভের মধ্য দিয়েই কবি যে পরম সুখের সন্ধান করেছেন, তা অনন্ত জীবনেরই ইঙ্গিতবাহী। রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বতানকে জীবন গানে’ মেলাবার চেষ্টা করেছেন। তিনি রচনা করেছেন দুঃখের গান, যা শুনে মানুষের মন অনন্তর পানে ধেয়ে যায়। এই অনাবিল অনন্তের ধারা মৃত্যু পরবর্তী অবস্থায় পর্যবসিত। তিনি বলেন—
‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো।
কর্ম যখন প্রবল-আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারিধার
হৃদয়প্রান্তে, হে জীবন নাথ, শান্ত চরণে এসো।’
জীবনকে আটকে রাখা যাবে না, এই পরম সত্যকে বারবার উপলব্ধিতে এনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় যে মৃত্যুদর্শন এঁকেছেন, তা কালক্রমে হয়ে উঠেছে নান্দনিক এক জীবনদর্শন। তিনি লিখেছেন, ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।’ তিনি স্বাভাবিকভাবে ঝরে যাওয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন লেখায়। এসব সত্য কবি জীবন দিয়ে বুঝেছেন। তাই তিনি মৃত্যু সম্পর্কে সানাই-এর ‘ক্ষণিক’ কবিতায় লিখেছেন—
‘এ চিকন তব লাবণ্য যবে দেখি
মনে মনে ভাবি একি
ক্ষণিকের পরে অসীমের বরদান
আড়ালে আবার ফিরে নেয় তারে
দিন হলে অবসান।’
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনেও প্রেক্ষণবিন্দুতে আছে একটি বোধ; আর তা হলো— মৃত্যু তার শোক ও দুঃখের মাধ্যমে জীবনে সত্যের, মুক্তির ও শক্তির— ত্রয়ীরূপকেই ফুটিয়ে তোলে। সুতরাং তাঁর মতে সুখের মতো দুঃখকেও স্বাগত জানাও, স্বাগত জানাও জীবনের মতো মৃত্যুকেও। এই চেতন-প্রক্রিয়া মৃত্যুর মাঝেও নান্দনিক অনুভবের ইঙ্গিতবাহী। রবীন্দ্রনাথ যাপনের অতলস্পর্শী হৃদয়মুখরতার গাম্ভীর্য থেকে খুঁজে এনেছেন মহিমান্বিত নান্দনিকতা। আবার সেই নান্দনিকতার কোলেই তিনি বস্তুত একা হয়েছেন। প্রাণময়ী উষ্ণতায় মেলে ধরেছেন জীবনের সহস্র রঙ। তাই রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দর্শন’-এর মতো তাঁর ‘মৃত্যু-দর্শন’ও গুরুত্বপূর্ণ। বোধ করি, জীবনের প্রতিটি মাধুর্যমণ্ডিত মুহূর্তেই তিনি পরম মমতায় মৃত্যুর অনিবার্য শূন্যতাকে উপলব্ধি করেছিলেন; তাই ছিন্নপত্রাবলীতে তিনি লিখেছেন— ‘ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্যোদয়কে সজ্ঞানভারে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মতো বিদায় দিই।’
রবীন্দ্রনাথ নিজে আপন সৃষ্টির বাঁধনে বাঁধা পড়েননি ঠিকই, কিন্তু এটি মর্মে মর্মে জানতেন তাঁর জাগতিক দেহ বিলীন হলেও তিনি তাঁর অমর সৃষ্টির মধ্যে চিরদিন তাঁর মমতাময়ী মর্ত্যভূমিতে অমর হয়ে থাকবেন। জীবনের সাধনায় তিনি যে পরিতৃপ্তি লাভ করেছেন, তা তাঁকে হাসিমুখে মরণকে বরণ করতে উৎসাহিত করে। এই পরিতৃপ্তিই তাঁর অন্ন, পথের পাথেয়। ‘বর্ষশেষ’ কবিতায় কবি লিখেছেন—
‘যাত্রা হয়ে আসে সারা আয়ুর পশ্চিম পথ শেষে
ঘনায় মৃত্যুর ছায়া এসে।
অস্তসূর্য্য আপনার দাক্ষিণ্যের শেষ বন্ধ টুটি
ছড়ায় ঐশ্বর্য্য তার ভরি দুই মুঠি।
বর্ণ সমারোহে দীপ্ত মরণের দিগন্তের সীমা
জীবনের হেরিনু মহিমা।’
তিনি বলেন— ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই— কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।’ প্রিয়জনদের নানারকম দুঃখ-সওয়া এবং দুঃখ-দেওয়া অকালমৃত্যুগুলি প্রত্যেকটিই একটিমাত্র প্রশ্ন করে বসে আছে রবীন্দ্রনাথের মনে— মানুষের জীবনে দুঃখের ভূমিকা কি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তিনি দুঃখকে বুঝতে সক্ষম হন। যে কারণে কবির ভাবনায় মৃত্যু কখনো প্রণয়ী, বাউল, কখনো বা বালিকা বধূর বর বেশে, সখা সেজে বন্ধুরূপে, অন্ধকারের ধ্যাননিমগ্ন ভাষার মতো অবগুণ্ঠনের আবরণ পরে, অরুণবহ্নির রুদ্র সাজে, জীবনরথের সারথি হয়ে, ললিত লোভন মোহন রূপে কিংবা জ্যোতির্ময়ের পরশমণি হয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি পুরোপুরি মানবকল্যাণে নিবেদিত ছিলেন বলেই হয়তো স্বজন বিয়োগবেদনা বা মৃত্যুবেদনা থেকে উত্থিত জীবনবিমুখতা তাঁর কাছে স্বার্থমগ্নতারই অন্য এক রূপ। মৃত্যুর সৌন্দর্য আস্বাদন করে তিনি সেই পরম উপলব্ধির অমিয়ধারা ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতা ও গানে, সাহিত্যের নানা শাখায়।
বিনাশ নয়, নিরন্তর চলার জন্যই মৃত্যুর স্পর্শলাভে দেহের খোলস বদলে যায় বারংবার। কারণ এমন বদলেই সম্ভব হয়, নানা রূপ পরিগ্রহের ভেতর দিয়ে বিবিধ বৈচিত্র্যের আস্বাদন— রবীন্দ্রনাথে যার সার্থক উপস্থিতি। মানুষের ভালবাসার অকৃপণ উৎস কবিকে ভালোবাসার অপরাজেয় শক্তি যুগিয়েছে। বিদায় তাঁকে নিতেই হবে, এ সত্য জেনেও তিনি ভালোবাসার কাছে দাঁড়িয়ে লিখেছেন—
‘এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি।
এ ভালবাসাই সত্য এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।’
কবি বলেন, ‘জীবনকে সত্য বলে জানতে গেলে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার পরিচয় পেতে হবে। যে মানুষ ভয় পেয়ে মৃত্যুকে এড়িয়ে জীবনকে আঁকড়ে রয়েছে, জীবনের পরে তার যথার্থ শ্রদ্ধা নেই বলে জীবনকে সে পায়নি। যে লোক নিজে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বন্দি করতে ছুটেছে, সে দেখতে পায়, যাকে সে ধরেছে সে মৃত্যুই নয়, সে জীবন’। রবীন্দ্রনাথ মূলত জীবন অনুসন্ধানের দিকেই গুরুত্বারোপ করেছেন। আর তাই জীবন-মৃত্যুর নিঃশব্দ প্রণয়খেলা কবির কাছে নবজীবন, নবযৌবন লাভের আহ্বান নিয়ে এসেছে। এসেছে নান্দনিক বোধের উৎস হয়ে।