অমিত মুখোপাধ্যায়
কী করে লাজলো ক্রাজনাহোরকাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় কলকাতার? আকস্মিক না হলেও তাঁকে আবিষ্কার করা হয় ঘটনাক্রমে এবং চিত্রনাট্যকার হিসেবে। সেটা ২০০৪ সাল, চলচ্চিত্র উৎসবের সূচিতে তাবড় সব নাম, আছে ইস্তভান জাভোর পূর্বাপর প্রদর্শনীও। দেখা গেল বেলা তার নামে পরিচালকের অনেকগুলো কাজ দেওয়া আছে তারই সঙ্গে। অন্তত একটা চেখে বিচার করা যাক ভেবে কিছু উৎসাহী সিনেপ্রেমী প্রথম যে ছবি দেখতে যায়, তার নাম ‘ড্যামনেশন’। নামের মতোই কুৎসিত পরিবেশ, ভাঙাচোরা কয়লাখনির একঘেয়ে আওয়াজের মাঝে সশব্দে কয়লা বয়ে নিয়ে চলে ট্রলি, অন্যদিকে বৃষ্টি পড়েই চলে সজোরে। তার মধ্যে বিপত্নীক বেকার নায়ককে প্রত্যাখ্যান করে খ্যাতির স্বপ্ন দেখা বিবাহিত বার-গায়িকা। টেনে রাখার পরিচিত উপাদান নেই, অথচ কিছুতেই চোখ সরানো যায় না। শেষে ব্যর্থ নায়ক যখন ঝুঁকে বসে কুকুরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টানা চেঁচায়, আবর্জনাভরা কাদাময় নির্জন জমিতে বৃষ্টি আরও জোরে আছড়ে পড়ে, তখন প্রতিবাদ বা সমবেদনা নয়, পণ্যসভ্যতার পেছনের নির্মম অবস্থা প্রকট হয়ে ধরা দেয়, যেন স্যামুয়েল বেকেটের চরিত্ররা নেমে এসেছে।
মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে খবর, পরদিন লোকটার সাত ঘণ্টার একটা ছবি আছে, আজব নাম সেটারও, ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’। নন্দনের তিন নম্বর হলে যারা দেখল, মোহিত হয়ে গেল। তারও পরের দিন এক নম্বরে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে লোকে দাঁড়িয়ে দেখল ‘ওয়ার্কমেইস্টার হারমোনিস’ (দ্য মেলানকলি অব রেসিস্ট্যান্স থেকে)। শুরু হয়ে যায় খোঁজ, মেলে লেখক হিসেবে লাজলো ক্রাজনাহোরকাইয়ের পরিচয়। জানা যায়, কেমন করে বন্ধু ক্রাজনাহোরকাইয়ের লেখার মূল ধারা হয়ে উঠল বেলা তারের চলচ্চিত্রের আদতশৈলী। তাঁদের সম্পর্কে পড়া শুরু হল। কয়েক বছর পরে এলো ‘দ্য ম্যান ফ্রম লণ্ডন’ এবং শেষে ‘তুরিন হর্স’ দেখার জন্য ঠেলাঠেলি পর্যন্ত হয়।
যে উপন্যাস পড়ে বেলা তার ছবি করতে পাগল হয়ে উঠেছিলেন, নয় বছরেরও বেশি লড়ে গেছেন সুযোগ পাবার জন্য, তা ওই ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ (১৯৮৫)। ‘ট্যাঙ্গো’ তো রিও দে লা প্লাতা (রুপোর নদী), অর্থাৎ আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের মাঝে পারানা আর উরুগুয়ে নদীর আঠালো মোহনা অঞ্চলে উনিশ শতকের শেষ ভাগে চালু হওয়া সামাজিক এক যুগ্ম নাচের নাম। সাধারণত গরিবদের এলাকায় বন্দরের মদের আসরে বা লালবাতি অঞ্চলে বিনোদনের জন্য করা এই নাচ পরে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। লাজলো ক্রাজনাহোরকাই ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ বলতে বুঝিয়েছেন শয়তানের নাচ! উপন্যাসটি এই নাচের ছয় পা এগোনো, আর ছয় পা পেছোনোর অসরলরৈখিক শৈলীতে বারোটি অধ্যায়ে বলা হয়, যা আদতে আবার বারোটি অতিদীর্ঘ অনুচ্ছেদ! জর্জ সিয়ারটেস-এর ইংরেজি অনুবাদে ২৮৮ পাতার এই উপন্যাসে যতিচিহ্নের অতি অভাব, যেন ঘনসন্নিবদ্ধ শব্দস্রোত, অথচ তাতে বর্ণনার কোনও খামতি নেই বলে কখনো ধীরে, কখনো দ্রুতলয়ের টানে পাঠককে আটকে রাখে।
খানিকটা পোড়ো খামার, খানিকটা অচল কৃষি কারখানা নিয়ে অতি ছোট এক গাঁয়ে নয় দশটি চরিত্র পুরনো সমাজব্যবস্থার অবশেষের মাঝে আটকে পড়ে যেন মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছে। মূলত তিন দম্পতি, দুই মেয়ে আর এক মদ্যপ ডাক্তার মুক্তি চায়, অথচ তারা মেরুদণ্ডহীন, চিন্তাহীন, উদ্যোগহীন। তাই তারা অস্থির, পালাতে ব্যস্ত একে অন্যকে ঠকিয়ে বাড়তি ভাগ নিতে, অথচ সংশয়ের আবর্ত তাদের স্থবির করে রাখে। পাশাপাশি ঘুরে বেড়ায় গরুর দল, বৃষ্টি পড়তেই থাকে। তবু এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে না, বরং মানুষ যেন চারপেয়ের মতো কেবল শরীরী অস্তিত্বে টিঁকে থাকে।
ক্রাজনাহোরকাই কখনো জনপ্রিয়তার কথা ভেবে লেখেন না, তাই প্রায় সব লেখায় এক বিষন্ন শূন্যতা, দিশাহীন অসারতা এবং পতনশীল অসঙ্গতির আবহে পুতুলের মতো আচরণ করে চরিত্ররা। তাই পাঠক শুরু থেকেই একাত্ম হবার বদলে বিচ্ছিন্ন হয় এবং দীর্ঘ ছড়ানো বাক্য, টানা সর্পিল বিবরণ আর অপ্রথাগত গঠনশৈলীতে হোঁচট খেতে থাকে। পাঠক চরিত্রদের মতো একইরকম অন্ধকারে বৃষ্টি কাদাময় সত্তাতাত্ত্বিক অনিশ্চয়তায় ঘুরপাক খায়। সে বুঝতেই পারে না লেখক তাঁকে কোথায় নিয়ে চলেছেন। যেন নিরানন্দ বর্ণহীনতায় নিয়ে যেতে আচমকা তীব্র ও বিচিত্র কৌতুকের বিদ্যুতরেখায় চোখ ধাঁধিয়ে উপন্যাসের পরিসরে ঠেলে দিচ্ছেন! একটু কষ্ট করে এগোবার পরে এলোমেলো অপ্রত্যাশিত আলেখ্য কোথা থেকে উদয় হয়ে নতুনভাবে তৈরি হওয়া বোধকে ফের সূত্রহীন করে দেয়। আরও কিছুটা এগোতে টের পাওয়া যায় যে এই গদ্যে এক অনন্য ছন্দোবদ্ধ স্বরনিয়ন্ত্রণ আছে, যা মন্দগতির, কিন্তু কূট ও সূক্ষ্ম। আবার কখনো সেই আখ্যানরীতিতে তাৎক্ষণিকভাবে অসংলগ্নতা আসে, কিন্তু সেই ক্ষতিপূরণ করতে আশ্চর্য সুসংহতি দেখা যায় দিকনির্দেশের ক্ষেত্রে।
সত্যি কথা বলতে গেলে, ক্রাজনাহোরকাইয়ের লেখার মূল সুর ও শৈলী নির্ধারিত করে দেয় ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’। অন্য উপন্যাসেও মেলে সে-ই সাময়িকভাবে সময়ের স্থগিতকরণ, চরাচরব্যাপী সংকটের জাল আর ক্ষয়, অপচয় ও অধঃপতন। এখানে প্রাথমিক স্তরে যে কুয়াশা ও প্রাণীদের অলস চলাফেরা দেখা যায়, তা ক্রমে প্রতীকী হয়ে ওঠে। শুরুর বাক্যগত জমাটভাব ক্রমে সহজ হয়ে আসে ডাক্তারের উপস্থিতিতে। বাক্যের দীর্ঘতা কমে, তা সংহত হয় এবং বিরামচিহ্নে নিশ্চয়তা থাকে। হয়ত তার অন্যতম কারণ এখানে হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক ভূবিদ্যার ইতিহাসের বই থেকে উদ্ধার করা অংশ দেখানো হয়। সেই বই পড়ার সময় এমনকি ডাক্তারের পর্যন্ত মনে হতে থাকে, সে ভূবিদ্যার ইতিহাস নাকি এক অশুভ পূর্বাভাস পড়ছে! ডাক্তার এই নির্বোধ কার্যকলাপে সরাসরি অংশ নেয় না, বরং নির্দিষ্ট জানলায় বসে যা দেখে তা লিখে রাখতে থাকে। হয়ত সে প্রতীকী আখ্যানকার, অথবা কেউ যেন পরে তার কাছ থেকে পূর্বাপর সব জানতে চাইবে। অন্য দিকে বাকি চরিত্ররা তাদের গোপন ও অর্থহীন কাজকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। ঠকানো, অবৈধ প্রণয়, ভুল বোঝানো থেকে নির্মমতা ঘটে যায় প্রায় নীরবে।
এখান থেকেই বোঝা যায় একই ঘটনাকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাবার প্রয়োজনে ওই ছয় পা এগোনো ও পেছনোর খেলায় কখনো ডাক্তারের দর্শন, গণনৃত্য বা কখনো বা এস্টিকে নামে ছোট মেয়েটির চোখ দিয়ে নতুন করে দেখানো হয়। দমবন্ধ করা জনপদে বড়দের একে ওপরের এবং নিজের ক্ষতি করার নিত্যনৈমিত্তিক কারবার দেখে ভালোবাসাহীন অত্যাচারিত এস্টিকে ভয়ংকরভাবে মেরে ফেলে নিরীহ বেড়ালকে, পুঁতে দেয় এবং নিজেও মরে! তার আগে মেয়েটিকে দাদাস্থানীয় একটি ছেলে বলে মুদ্রা পুঁতলে মুদ্রার গাছ হয়! এস্টিকে তেমন করলে ছেলেটি খুঁড়ে তুলে নেয় ও প্রশ্ন করলে হুমকি দিয়ে থামায়। অর্থনৈতিক ধ্বংসের সঙ্গে আধ্যাত্মিক প্রবণতার অবসান প্রতিফলিত হয় বস্তুনিষ্ঠ নীরবতায়।
তবু বেবোধ লোকগুলো অলীক আশা করে যায় দিনবদলের, যা কোনও মসিহা এসে তাদের হয়ে করে দেবে! প্রস্তাবনায় কাফকার কথা তুলে দিয়ে এই ব্যাপারেও লেখক ইঙ্গিত দিয়ে রাখেন পাঠককেঃ সেক্ষত্রে আমি অপেক্ষা করতে চেয়ে মুক্তিকেই হারিয়ে ফেলব! মসিহা সেজে আসে দু’বছর আগে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ইরিমিয়াস ও তার সহকারী পেট্রিনা। গোটা এক অধ্যায় জুড়ে ইরিমিয়াস বক্তব্য রাখে এবং সেই লগ্ন থেকে আখ্যানের প্রবাহের স্থবিরতা কেটে গতি পেতে থাকে। বলার অভিনবত্বর মাঝে প্রতারণা লুকিয়ে সে অধিবাসীদের ব্যক্তিগত দোষ উহ্য রেখে বলে দলগত অপরাধবোধের কথা এবং একই সঙ্গে মুক্তির আশ্বাস দেয়! সে আরেক যৌথজীবনের লোভ দেখায় এবং অজ্ঞ লোকগুলো সমাজ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৃত্তাকার ব্যর্থতা দেখেও তাকে মেনে নিয়ে একে দুইয়ে দাবিমতো টাকা দিতে থাকে, যেমন দুনিয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লোভ দেখিয়ে টাকা হাতানো হয়। মজার ব্যাপার হল, তথাকথিত এই ত্রাতার দ্বারা বশ হলেও সে যখন মস্তানের ভঙ্গিতে কাকে কখন কোথায় কীভাবে যেতে হবে নির্দেশ দেয়, তখন সন্দিহান হয়ে একজন অসমসাহসে টাকা ফেরত চায়। তীব্র কৌতুকে লেখক দেখান কেমন করে বাকিরা লোকটিকে বোঝায়, ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে, বলে ভুল বলছে বা ভুল বুঝেছে, আদতে ফেরত চায়নি! তার হয়ে বাকিরা ক্ষমা পর্যন্ত চায়! ইরিমিয়াস সম্বিত ফিরে পেয়ে বলে সে নিশ্চয় ফেরত দেবে, আর কেউ চায় কি না বলুক! সে তো নিজের জন্য নয়, মানবতার স্বার্থে এ সব করছে! কী, চেনা চেনা লাগে কোথাও! পচন কেমনভাবে ভেতর থেকে ধরানো হয় এবং কাল্পনিক জগতে ঠেলে দিয়ে যা খুশি করানো যায় তা অনুচ্চকিত স্বরে তুলে ধরেন লেখক।
আনন্দে দীর্ঘ ট্যাঙ্গো নাচতে থাকা মিসেস স্মিত, যে কিনা শহুরে আধুনিকতার স্বপ্নে বিভোর, অথচ নিজের সীমাবদ্ধতায় চিন্তিত, অন্যদের অনুকরণ করতে বলে, নাচই আমার একমাত্র দুর্বলতা! আদতে এ তো তাদের মরণ-নাচ! উল্টানো মাছির মতো আশা নিরাশার দোলায় লাগাতার এগিয়ে পিছিয়ে নাচে আর গিয়ে পাত্র থেকে পান করে আসে। এই হল স্যাটানট্যাঙ্গো, সরাইখানায় তারা নিজেদের সর্বনাশের নৃত্যে মেতেছে, যার মধ্যে মিশে থাকে বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, হতাশা আর অসহায়তা! মিসেস হ্যালিকাস গোপন ইচ্ছে নিয়ে বাইবেল-হাতে স্বঘোষিত নৈতিক বিচারক হতে চায়, অন্য দিকে স্বামীর মদ চুরি করে খায়! হর্গোস পরিবারের বায়ো-শক্তি দেখিয়ে চূড়ান্ত নাটকীয়তা করে, দুই মেয়েকে পতিতাগিরিতে ঠেলে দেয়। ডাক্তারের মদ্যপানের কথাও বলা যেতে পারে, চিকিৎসা ছেড়ে অতি আলস্যে দিনলিপি লেখা ছাড়া ওই একটি পবিত্র কাজই সে নিষ্ঠায় করে থাকে। চূড়ান্ত ঝড়বৃষ্টিতে বেসামাল হয়ে পড়তে পড়তেও উঠে টলোমলো পায়ে পাবে গিয়ে নেশার তরল জোগাড় করে আনে এবং বেতের সুন্দর ঝুড়িতে রাখা কাচের পাত্র ড্রয়ারের ভেতর থেকে অতি যত্নে বার করে ছোট বোতলে ঢালে, গেলাসে নেয় আর চুমুক দেবার ফাঁকে অবলোকিতেশ্বর সাজে। এরা পতনশীল চরিত্রের হরেক উদাহরণ হয়ে থাকে। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ক্লীবতার চোরাস্রোতের দিকে এভাবেই আঙুল তুলে লেখক দেখান যে ভোগবাদের শঠতা স্রেফ এই সম্মিলিত আহাম্মকির সুযোগ নেয়।
সব কিছু হাতিয়ে ইরিমিয়াস ও পেট্রিনা গরুর পালের মতোই বাসিন্দাদের নিয়ে চলে, রয়ে যায় মেকি বুদ্ধিজীবি ডাক্তার, সে যে মেকি মসিহার বিপরীত মেরুর লোক, আপন সুরভিতে আচ্ছন্ন ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে আছে! সে মনে করে শব্দ গেঁথে অস্তিত্বকে অর্থ দেবে, অংশগ্রহণ না-করে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং লিখে পৃথিবীকে পাল্টে দেবে! ভাঙাচোরা অন্তহীন পথের দু’পাশ পাল্টে নিসর্গ কেবল শূন্যতা আনে, ঝড়ো হাওয়া বাধা দেয়, তবু এক ছদ্ম-মুক্তি আনে অবাধ পরিসর। বিপর্যয়, দেশভাগ, ব্যবস্থার বদলের সময় অভিবাসন খুবই পরিচিত ঘটনা, লোকগুলো জানে তাদের নতুন ভূখণ্ডে ফের এক দুই থেকে শুরু করতে হবে এবং তার জন্যও নির্ভর করতে হবে সন্দেহজনক নেতার ওপরে, যেহেতু সে স্থানীয়! লেখক দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেন এই দ্বৈততার দুর্বলতা, ভবিষ্যতের আশাপ্রদতা আর নেতৃত্বের প্রতি সন্দেহ। নতুন ঘেটোতে শুরু হয় পুনর্বাসনের ধাঁধাময় আরেক পর্ব : নানা দপ্তরে, টেবিলে, টাইপরাইটারে, অজস্র আবেদনের কাগজে হারিয়ে যেতে থাকে যাবতীয় নিশ্চয়তা! সবই এখন রহস্যময়, ঠকে যাওয়ার গন্ধে ভরা এবং মরমী ক্রাজনাহোরকাই কেবল দূর থেকে তাঁর বিম্ব পেশ করে চলেন।
শেষে ডাক্তার যায় পাথরের গির্জায়, ঘন্টার শব্দ শোনে, ফিরে এসে ঘরে ঢোকে এবং উপন্যাসের প্রথম বাক্যগুলোকেই বদলে দিতে চায়! পরিণতিতে সে নিঃসঙ্গ, ভাঁড়ার শেষ, তবু সে আশাবাদী, যন্ত্রণায় পাওয়া অভিজ্ঞতায় সে নতুন করে লিখবে মানুষের ইতিহাস, তাই শেষ অধ্যায়ের নাম: বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়! বৃত্তান্ত ছয় থেকে একে ফিরে যেতে থাকে। তাই প্রথম বাক্যগুলো দিয়েই সে ফের শুরু করে: তুর্কিরা আসছে! তুর্কিরা আসছে! মেটা-ফিকশনের ভেতর ও বাইরে দেখিয়ে লেখক তার বার্তা পৌঁছে দেন। পাঠক তার নিজের মতো করে যেন বুঝে নিতে পারে এবং তা করতে গিয়ে পাঠক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে হাজির হয়। সে হাঙ্গেরির ইতিহাসের মুখোমুখি হয় যেখানে ১৫২৬ সাল থেকে তিন তিন বার অটোমান তুর্কির আক্রমণ হয়েছে, বার বার ভেঙে গেছে দেশ, অত্যাচারিত ও স্থানান্তরিত হয়েছে মানুষ।
১৬৯৯ সালে অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্য তুর্কিদের তাড়িয়ে তথাকথিত স্বাধীনতা আনার পরেও অসন্তোষ থাকে। পরে ১৮৬৭ থেকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি দ্বৈত শাসন জারি হয়। আরও বিদ্রোহ ও দমনপর্ব চলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯১৮-তে স্বাধীনতা আসে, কিন্তু ১৯২০ সাল লেগে যায় খর্বাকার ও আধুনিক হাঙ্গেরির চেহারা পেতে। তারও পরের ইতিহাস অবশ্য সকলের জানা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, ১৯৪৫ সালে নাজিদের তাড়াতে গিয়ে লালফৌজের কর্তৃত্ব করা এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তা চালু থাকা। কিন্তু তার পরের তিন দশকেও কি বদল হল কিছু! শেষের অভিঘাতে এত ইতিহাসের ওঠাপড়া ছুঁয়ে যেতে চান লেখক, যেখানে সাধারণ মানুষের বোধোদয় কিছুতেই ঘটে না।
‘দ্য মেলানকলি অব রেসিস্ট্যান্স’ যেন আগের উপন্যাসের সুর ও তাল নিয়েই এগিয়ে নিয়ে চলে। মিসেস প্লাউফ হেঁটে চলে নোংরা অন্ধকারে সতর্ক হয়ে, প্রতি লগ্নে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করে। তার ছেলে বোকা ভালুস্কাকে ভালোবাসে কেবল বন্ধু এজতার, যে আবার সঙ্গীতপাগল, কদাচিৎ বিছানা ছেড়ে ওঠে। কিন্তু এজতারকে ছেড়ে যাওয়া তেজি বউ টুণ্ডে জনপদে নৈতিক মানসিকতা ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে জোয়ার আনতে সেই ছোট শান্ত জনপদে আনে এক রহস্যময় সার্কাস এবং সঙ্গে করে আনে চাপা ভয়, উদ্বেগ ও বিশৃঙ্খলা। তীব্র শীতের মাঝে মিসেস প্লাউফ দেখে পরিচিত গান, নাচিয়ে হাতি, ক্লাউন, পাখির বদলে আছে কেবল এক ট্রাকের ওপরে এক সুবিশাল তিমিমাছের খোলস! ভালুস্কা রাতে সেই তিমি দেখতে গিয়ে ভেতরে চাপা গলা শোনে এবং বোঝে যে প্রিন্স নামের বক্তাকে দিয়ে জনপদে গণ্ডগোল বাধাবার আয়োজন চলেছে।
তিরিশ পাতাজোড়া অনুচ্ছেদ, পুরো এক পাতাজোড়া বাক্য, তবু মনোযোগ টেনে রাখে পরিবেশের উত্তেজনা। লোক খেপিয়ে ষড়যন্ত্র সফল করে অশান্তি আনা হয়। লোকে ভয়ে ঘরে লুকিয়ে থাকে, ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে। উন্মত্ত জনতা চারদিকে ধ্বংসলীলা চালায়, ট্যাঙ্ক নামে রাস্তায়, টুণ্ডে ঘোরে তাদের নির্দেশ দিতে। পরে তাকে পুলিশের সঙ্গে নাচতেও দেখা যায়। এদিকে আক্রমণে মৃত হারারের বউ ভালুস্কাকে সতর্ক করে দেয় যে তাকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে। ভালুস্কা ছোটে মাঠ পেরিয়ে, রেললাইন ধরে, কিন্তু হেলিকপ্টার তাকে অনুসরণ করে ধরে।
প্রিন্সের ছায়া ছাড়া কিছু দেখা যায় না, তার দলও থাকে নেপথ্যেই, তবু বিশৃঙ্খলার চূড়ান্ত হয়। বাসিন্দারা কেউ সঙ্গীতে, মহাকাশবিদ্যায়, স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাস করে, কেউ মার খেয়ে বা হতাশা আর সন্দেহে নেতিয়ে পড়ে থাকে। সব সময় ভালুস্কার মতো লোককে সাজিয়ে মিথ্যে দোষী খাড়া করা হয়। এই উপন্যাসে চরিত্ররা যেন অনেক বেশি চেনা, আরও সমকালীন এবং এই রাজনৈতিক রূপকে তাই সামাজিক বিশৃঙ্খলার শেকড় খুঁজে পাওয়া সহজ। শাসক সব সময় নতুন ফন্দি বার করে, যেমন এখানে সার্কাস আসে মুখোশ পড়া বহিরাগত শক্তি হয়ে। দু’এক জন এজেন্ট নেওয়া হয় টুণ্ডের মতো। আর বিশৃঙ্খলা তৈরি করে হাতিয়ে নেওয়া হয় সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ। দারিদ্রের কারণে থাকা আবর্জনা, নিষ্ক্রিয় বাসিন্দা, বেহাল শহর আর ব্যপ্ত অবক্ষয় তুলে ধরা হয় আরও স্পষ্ট করে। মিসেস এজতারের চরিত্র দেখাতে লেখক বলেন যে সে তার চাতুরি দিয়ে সঠিকভাবে বিপক্ষের মেরুদণ্ডহীনতা, তাদের লোভী দাসত্বের মনোভাব বুঝতে পেরেছিল। বিরোধীরা যে অযৌক্তিক ভয়ে নতুন পদক্ষেপ নিতে দ্বিধায় আছে, আরও খারাপ ব্যবস্থা সব কিছু টুকরো করে দেবে বলে ভাবছে, টের পেয়েছিল।
কোনো পরিকল্পিত অমঙ্গল ঘটার আগে জনমানসে কী ধরনের মিশ্র অনুভুতি কাজ করে তা মূলত ভালুস্কার চোখ দিয়ে দেখানোর ফলে আবহটি বিস্তার পায়। কোনো খোঁজ নেওয়া, আলোচনা বা চিন্তা করার বদলে নিজের মতো করে সকলে নীরবে অশুভের যেন প্রতীক্ষা করতে থাকে। এই আত্মসমর্পণকেই বারংবার ব্যঙ্গে বিদ্ধ করেছেন লেখক। অত মানুষ জড়ো হয়ে অস্থির, অথচ উদাসীন এবং বোবা! তাদের যেন অদৃশ্য শৃঙ্খল দিয়ে পুতুল করে রাখা হয়েছে, পালানো বা সম্মুখীন হওয়া অসম্ভব, তাই নিজেদের মধ্যে কথা বলা অর্থহীন! এটাও কি খুব অচেনা লাগে আমাদের কাছে?
বিশিষ্ট চিত্রকল্প, শব্দের প্রয়োগ, বাক্যের দীর্ঘ গঠন, সংকটের অতি-আধিক্য, পরিস্থিতির আপাত-অবাস্তবতা এবং অনুচ্ছেদের প্রসারতা স্পষ্ট করে দেয় যে, ক্রাজনাহোরকাই মনে করেন শাসক ও তার অনুচরদের সহজ কথা সহজে বলার অবস্থায় আর নেই। স্তরে স্তরে গভীরে গিয়ে কেবল সর্বনাশের নকশা বুঝলেই হবে না, আত্মসমীক্ষাও চালিয়ে যেতে হবে পাশাপাশি। কেন যুগে যুগে জনতা বিপর্যয় ষড়যন্ত্র আর লোভের হাত থেকে পালাতে নতুন আকালের সন্ধানে গিয়ে পড়বে। কেন প্রাণপণ সংগ্রামের পরেও জাগরী হবে না দেশ, উল্টে নির্মমভাবে ভাগ হবে আর সাধারণ মানুষ তার লক্ষ্যের নাগাল পাবে না!
তাই ক্রাজনাহোরকাইয়ের লেখার প্রেরণা আসে তিক্ততার অভিজ্ঞতা থেকে এবং তিনি পৌঁছতে চান ইতিবাচকতায়। তাই সমস্তরকম ক্লীবতার বিরুদ্ধে আঘাত হানতে চান। তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাস ২০২৩ সালে লেখা ‘সমলে ওডাভান’, অর্থাৎ সমলে অপেক্ষায় আছে, তীব্রভাবে ব্যঙ্গধর্মী, যেখানে একানব্বই বছরের অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ বিদ্যুৎ-মিস্ত্রি জোসি কাডা আদতে গোপনীয়তার আড়ালে থাকা রাজরক্তের উত্তরপুরুষ। তিনি সিংহাসন দাবি করতে পারেন, অথচ নিজেই উধাও হয়ে যান। সমলে সেই মানুষটির কুকুরের নাম, সে কি অন্ধকারে লুকিয়ে অপেক্ষা করে আছে? কাডার ভক্তরা কেউ রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, কেউ প্যারামিলিটারি আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এক সময় তাকে হাঙ্গেরির এক অখ্যাত গ্রামে খুঁজে পাওয়া যায়।
সামগ্রিকভাবে সারা পৃথিবীর মুষ্টিমেয় অথচ আগ্রহী পাঠকের মতামত বিচার করলে বলা যায় যে, নোবেল যদি না-ও পেতেন লাজলো ক্রাজনাহোরকাই একইরকম প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে থেকে যাবেন।