হারিয়ে যাচ্ছে বাঙ্গালির খেরোর খাতা

বিক্রি হচ্ছে খেরোর খাতা-(ছবি-দিলীপ দত্ত)

লাল কাপড়ে মোড়া,দড়ি দিয়ে বাঁধা এক হিসাবের খাতা, সারাবছর খুলে রাখা থাকে দোকানির সামনের কাঠের ডেস্কটির উপর – খেরোর খাতা বাঙ্গালির প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এক নস্টালজিয়া।

বাংলা নববর্ষের সন্ধ্যে মানেই হালখাতা। সারাবছরের গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে পুরনো ধারদেনা চুকিয়ে এক নতুন খাতার সূচনা, নতুন বছরের হিসাবের সঙ্গে এইভাবেই জড়িয়ে বাঙ্গালির আবেগ ও অনুভূতি। ব্যবসায়ীদের কাছে এ এক শুভ দিন – তাই বছরের আগামী দিনগুলি ভাল কাটার আশায় খেরোর খাতাকে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে পুজোও করা হয়।

খেরোর খাতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আপাদমস্তক বাঙ্গালিয়ানা। খাজাঞ্চিবাবুদের নস্যিটানা, নাকের থেকে ঝুলে থাকা পন্ডিতি চশমা, আর অসম্ভব মনোযোগের সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখে রাখা নিত্যদিনের হিসাব। খেরোর খাতা এক ইতিহাসের পান্ডুলিপি। বাঙ্গালির বিবর্তনের ইতিহাসের এক জ্বলন্ত প্রমাণ।


তবে আধুনিকতার যুগে খেরোর খাতা হারিয়ে যেতে বসেছে। দিস্তে কাগজ বাঁধাই করে, তার উপর এক টেঁকসই কাপড় জড়িয়ে তৈরি হত খেরোর খাতা। পরে অবিশ্যি খরচ কমানোর জন্য লালশালু মুড়েই কাজ চালানো হত।

তবে ইদানিং কম্পিউটারেই রাখা হয় হিসেব। যদিও হালখাতা এক অর্ধ-বিস্মৃত ট্র্যাডিশন হিসেবে বেঁচে রয়েছে। মার্কেটিং-এর অঙ্গ হিসেবে তাই এখন ব্যবসায়ীরা খাদ্যরসিক বাঙ্গালিকে সুস্বাদু খাবারের প্যাকেট দিয়ে তুষ্ট করার স্ট্র্যাটেজি নিয়েছে – এ এখন এক প্রতিযোগিতা। কিন্তু এর সঙ্গে নেই কোন আত্মিক যোগাযোগ, নেই বাচ্চাদের সারাবছর জুড়ে অপেক্ষা দোকানে দোকানে গিয়ে নতুন ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার আর চিরাচরিত বাঙালি মিষ্টি সংগ্রহের অনাবিল আনন্দ।

খেরোর খাতার সঙ্গে সঙ্গে তাই বাঙ্গালির জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আশেপাশের মানুষের সঙ্গে জুড়ে থাকার মানবিক টান – কেবল ব্যবসায়িক বা আর্থিক সম্পর্কের বদলে আপনজনের মত নির্ভর করে থাকার অঙ্গীকার। পোস্টমডার্ণ যুগের বাঙালি এখন বড়ই যন্ত্রনির্ভর, যান্ত্রিক আর প্র্যাগম্যাটিক – আলগোছে একটুখানি মন দিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার তেষ্টাটা বুঝি খেরোর খাতার মতই ডুবতে বসেছে বিস্মৃতির অতলে।