শর্বরী দত্ত বসু
ফেলে আসা ইতিহাসের পুনঃউন্মোচনের একমাত্র অবলম্বন হল অপর্যাপ্ত তথ্য সংকলন; কিন্তু সময়ের বিবর্তন এবং সঠিক তথ্যের অভাব— এই দুইয়ের সমন্বয়ে ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় নানা মতবাদের জটিলতা।
আমাদের আশপাশের বিভিন্ন শহরের নামকরণের ইতিহাস বর্তমানে বেশ চর্চিত। এই যেমন, আমাদের ‘কলকাতা’ শহরটির নামকরণ নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে, তেমনই একদা ফ্রেঞ্চ অধ্যুষিত শহর ‘চন্দননগর’, এই নামটির সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে অনেক লৌকিক কাহিনি।
ব্রিটিশ অধ্যুষিত সমগ্র ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব দিকের ছোট্ট একটি শহর ‘চন্দননগর’ ছিল ফরাসি শাসকদের দখলে। যদিও এই ফরাসিদের আগমনের কারণেই তৎকালীন সময়ে এই শহরটি ‘ফরাসডাঙা’ নামে পরিচিত ছিল। তবে, ‘ফরাসডাঙা’ বলতে কিন্তু বর্তমান সময়ের সমগ্র চন্দননগর শহরকেই বোঝানো হতো না। এই শহরের ভেতরে ফরাসিদের নিজস্ব যেটুকু ভূখণ্ড ছিল, শুধুমাত্র সেই অংশটুকুই ফরাসডাঙা নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফরাসিদের উদ্যোগে এই শহরে অন্যান্য ব্যবসা–বাণিজ্যের পাশাপাশি কাপড়ের ব্যবসাও বেশ ভালোই প্রসার লাভ করে। ধীরে ধীরে ‘ফরাসডাঙার কাপড়’ বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
একদিকে যেমন বাণিজ্যিক উন্নয়নের কারণে এই শহরটি বেশ পরিচিত ছিল, ঠিক তেমনই ফরাসডাঙা এবং চন্দননগর নাম দুটির একাধিকবার বিবর্তনও ছিল বহুচর্চিত, যা বারংবার উঠে এসেছে ইতিহাসের পাতায়। যেমন— রবার্ট ক্লাইভ এই ফরাসডাঙা শহরটিকে ‘ফরাসডাঙ্গি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। পাশাপাশি, পুরনো তথ্যের অবলম্বনে, এই ফরাসি পরিচালিত ছোট্ট শহরটির নামকরণের বিষয়ে বেশ কিছু অজানা কাহিনির সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন—
প্রথম তথ্য অনুযায়ী, ‘চন্দননগর’ নামটির পেছনে শোনা যায় চাঁদ সওদাগরের কাহিনি। এই ‘চন্দননগর’ শহরটি হুগলি নদীর (বর্তমানে, গঙ্গা নদী) তীরে অবস্থিত। এই নদী দিয়ে যাওয়ার সময়, চাঁদ সওদাগর নৌকো থামিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বোড়াইচণ্ডীর মন্দির। মনে করা হয়, এই মন্দিরের নাম থেকেই এই এলাকার নামকরণ হয় ‘চণ্ডীর নগর’, যা পরবর্তীকালে বিবর্তিত হয় ‘চন্দর নগর’ নামে। বিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ‘চুঁচুড়া বৃত্তান্ত’ নামে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, চাঁদ সওদাগরের বাসস্থান থেকে এই জায়গাটিকে বলা হত ‘চাঁদের নগর’, যা পরবর্তীকালে ‘চন্দননগর’ নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় তথ্যের ভিত্তিতে, ১৬৬০ সালে ভ্যান ব্রোকের তৈরি মানচিত্রে চন্দননগর শহরটির অবস্থান, এখানকার নানা কুঠির অবস্থানের পাশাপাশি একটি পতাকাও আঁকা আছে। এছাড়াও উল্লেখ রয়েছে ত্রিবেণী, সাতগাঁ, চন্দননগর প্রভৃতি অঞ্চলের নাম। এই মানচিত্রে ‘চন্দননগর’-এর বানান দেখা যায়, ‘Chandernegur’। যদিও, এই মানচিত্রে চন্দননগরকে গঙ্গার ওপারে দেখানো হয়েছে। রাধারমন মিত্র এবং হরিহর শেঠ দুজনেই এই চিহ্নিত অংশটি সঠিক নয় বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। ১৬৬০ সালে ভ্যান ব্রোকের তৈরি এই মানচিত্রে এই ধরনের একাধিক ভুল তথ্যের সংশোধন কেন করা হয়নি, সেই প্রশ্নের উত্তর আজও অধরা।
তৃতীয় তথ্য জানা যায় ইউরোপীয় পর্যটক হ্যামিলটনের লেখা থেকে। ‘New Account of The East India’ নামক বইটিতে চন্দননগর শহরটির উল্লেখ রয়েছে ‘চরনগর’ নামে। মনে করা হয়, সেই সময় এই ‘চরনগর’ নামটি লোকমুখে বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল, যেখান থেকে ফরাসিরা উচ্চারণ করেছিলেন, ‘স্যাঁদরনগর’। এই ‘চরনগর’ নামটি মনে করা হয় এক বিশেষ কারণ থেকে এসেছে।
‘চর’ + ‘নগর’ = ‘চরনগর’। এই ‘চর’ শব্দের অর্থ হল, নদী দ্বারা বেষ্টিত স্থলভাগ। সাধারণত, নদীর আপন গতিশীলতায় অথবা মোহনায় পলি জমাট বাঁধার কারণে যে স্থলভাগের সৃষ্টি হয়, তাকেই আমরা ‘চর’ বলে থাকি। আর এই চরকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে জনপদ। ত্রিবেণী নামক স্থলভাগ থেকে বহমান জলধারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যথা— সরস্বতী নদী এবং হুগলি নদী। আর এই দুই নদীর ঠিক মাঝখানের পলি নির্মিত চরটি প্রাচীন অধিবাসীদের চোখের সামনে ক্রমশ নগরে পরিণত হয়ে ওঠে, ফলে এই স্থলভাগটির নামকরণ হয় ‘চরনগর’।
উল্লিখিত তথ্যাদি ছাড়াও, এই ‘চন্দননগর’ নামটির পেছনে কিছু লৌকিক ধারণাও দেখা যায়। যেমন, কিছু ফরাসি গ্রন্থে চন্দননগরকে ‘Land of Sandelwood’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যার কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয় যে, এই শহরটিতে একসময় চন্দন কাঠের বন ছিল, কিংবা বলা যেতে পারে, চন্দন কাঠের ব্যবসা ছিল। আর একটি তথ্য থেকে জানা যায়, চন্দননগরের অবস্থান গঙ্গার বুকে অর্ধচন্দ্রের মতো ছিল, যার কারণে এই শহরটি ‘চন্দ্রনগর’ এবং পরবর্তীকালে ‘চন্দননগর’-এ পরিণত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
১৬৯৬ সালটিকে ‘চন্দননগর’-এর জন্মসাল হিসেবে ধরা যেতে পারে। কারণ, এই সালটির পিছনে একটি ঐতিহাসিক সত্যতা থাকায় সালটিকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। তৎকালীন বিদেশি শক্তি অর্থাৎ ইংরেজ, ওলন্দাজদের মতো ফরাসিরাও এই শহরে ‘ফর দ’রলেয়াঁ’ (Fort d’Orléans) দুর্গ নির্মাণ করেন। চন্দননগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মঁসিয়ে মাতাঁ (Monsieur Martin), মঁসিয়ে অন্দ্রে-ফ্রঁসোয়া ব্যুরো দেলঁ (Monsieur Andr-François Boureau – Deslandes) এবং মঁসিয়ে পেল (Monsieur Pele )— এই তিন সাহেব ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টর ‘ফ্রঁসোয়া কারোঁ’কে (François Caron) যে পত্র লেখেন, সেইখানে তাঁদের স্বাক্ষরের নীচে স্থানের নাম হিসেবে ‘চন্দননগর’ নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও তাঁরা ফরাসি ভাষায় ‘TCHANDERNAGORE’ এই বানানটি প্রয়োগ করেছিলেন। কাজেই আমরা এটা ধরে নিতেই পারি যে, ‘চন্দননগর’ নামটির প্রথম কাগজে কলমে উল্লেখ ও জন্ম, ফরাসি সাহেবদের লেখা এই পত্রের হাত ধরেই।
কোনো স্থানের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে, সেখানকার অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি তার ভৌগোলিক অবস্থান, সীমানা, নদী ও ভূ-প্রকৃতির প্রসঙ্গও স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। ‘চন্দননগর’ শহরটির প্রাচীনত্ব খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বিপ্রদাস পিপলাই রচিত ‘মনসামঙ্গল’ বা দাশরথি রায়ের ‘পাঁচালী’ বা অন্যান্য প্রাচীন কাব্যগন্থে।
‘চন্দননগর’-এর প্রাক্ঔপনিবেশিক ইতিহাসের বিবরণে পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ, দিনেমার, ফরাসি প্রভৃতি বণিকদের রাজত্বের যেমন আমরা উল্লেখ পাই, ঠিক তেমনই এই বিদেশি বণিকদের আসার আগে দেশীয় শক্তি কখনও কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে আবার কখনও স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছে। মুঘল ফৌজদারের শাসনকালে এই ভূমিখণ্ড ‘চন্দননগর’ নামে পরিচিত ছিল না, বরং সেইসময় এখানে বিলকুলি, নবগ্রাম, খলিসানী, গর্জি, ব্যাজড়া, মাধবপুর, আলতারা প্রভৃতি কতগুলি প্রাচীন গ্রামের অবস্থিতির কথা জানা যায়। বৌদ্ধ পর্যটক কবিরাম তাঁর গ্রন্থ ‘দ্বিগবিজয় প্রকাশ’-এ লিখেছেন, ‘খলিসানী মহাগ্রাম, যত্র রাজা চ ধীবর।’ যার অর্থ হল, খলিসানী একটি বড় গ্রাম যেখানে ধীবর রাজাদের বসবাস ছিল। এই স্থানটির আওতায় বেশ কয়েকটি জনবসতিপূর্ণ গ্রাম ছিল, যেখানে বসবাসকারী ধীবর শ্রেণির লোকেরা মাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে এই গ্রামগুলির কথা বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য থেকে জানা যায়। খুব সম্ভবত, পাঠান রাজত্ব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ধীবর রাজাদের পতন ঘটে বলে মনে করা হয়। দ্বাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দেখা যায়, সরস্বতী নদীর ধার ঘেঁষে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল সেন রাজবংশের অধীনে। এর মধ্যে ডিঙ্গল হাট ছিল সপ্তগ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র। সুলতানি যুগে এইখানেই ছিল দুর্গ। আজকের চন্দননগর ছিল সেন রাজবংশ দ্বারা প্রভাবিত সমৃদ্ধ অঞ্চলের প্রান্তভাগ। সেন বংশের পরে, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি’র সৈন্যরা সরস্বতী নদীর দুপারেই ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন।
১২৯৮ সালে জাফর খাঁ এবং ১৩২৩ সালে ইজুদ্দিন খাঁ সপ্তগ্রাম দখল করার পর সরস্বতী নদীর তীরবর্তী ভূখণ্ডে পাঠানরা প্রবেশ করে। পরে পার্শ্ববর্তী গ্রামে তারা ছড়িয়ে পড়ে। ফলত সরস্বতী নদীপথ ধরে ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাব এই নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলিতে ক্রমশ বিস্তার লাভ করে। পাঠান নবাবদের মধ্যে দাউদ খাঁ ছিলেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যাঁর পুত্র বায়জিদ খাঁ ১৪৯৯ সালে প্রতাপশালী শাসনকর্তা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং একসময়ে, বিলকুলি নামক এই স্থানটিতে তাঁর অসম্ভব প্রভাব দেখা যায়। সপ্তদশ শতকে মুঘল শাসন দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হলে, পাঠানদের প্রভাব ক্রমশ কমতে থাকে।
এলাহাবাদ শহরে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী নদীর মিলনস্থল যেমন ‘ত্রিবেণী’ নামে পরিচিত, ঠিক তেমনই বাংলার হুগলি জেলায় অবস্থিত গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী নদীর মিলনক্ষেত্রটিও ‘ত্রিবেণী’ নামে পরিচিত। আবার এই স্থান থেকে তিনটি নদী তিনদিকে মুক্ত হওয়ার কারণে একে ‘মুক্তবেণী’ও বলা হত। একদিকে যেমন, গঙ্গা নদীর মূল ধারাটি ‘ভাগীরথী’ বা ‘হুগলি’ নামে দক্ষিণ দিকে বয়ে গিয়েছে, ঠিক তেমনই গঙ্গা নদীর আরেকটি শাখা ‘যমুনা’ নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে উত্তর চব্বিশ পরগনার চারঘাটে ইছামতী নদীতে মিশে যায়। যদিও পরবর্তীকালে, এই যমুনা নদীর অস্তিত্ব বঙ্গ থেকে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায়। গঙ্গা নদীর অপর একটি শাখা ‘সরস্বতী’ নামে পশ্চিম দিক দিয়ে হুগলি থেকে মগরার ভেতর দিয়ে পোলবা, সিঙ্গুর ও চণ্ডীতলা থানার মধ্যে দিয়ে ক্রমশ প্রবাহিত হয়ে হাওড়া জেলার ডোমজুড় থেকে ৭৭ কিমি পথ প্রবাহিত হয়ে সাঁকরাইলের পাশ দিয়ে পুনরায় হুগলি নদীতে এসে মিশে যায়। অষ্টম শতাব্দীতে সরস্বতী নদী তার গতিপথ আরও একবার পরিবর্তন করেছিলো।
সরস্বতী নদী ছিল মধ্যযুগের প্রধান বাণিজ্যপথ। ফলত এর তীরেই বিগত সহস্রাব্দে গড়ে উঠেছিলো বাংলার অন্যতম আন্তর্জাতিক বন্দর ‘সপ্তগ্রাম’ এবং দক্ষিণবঙ্গের প্রধান নগরী। তবে বিদেশি বাণিজ্যতরী আসার আগে থেকেই সপ্তগ্রামের সমৃদ্ধি ছিল ঈর্ষণীয়। বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গল কাব্য’-এ চাঁদ সওদাগর ত্রিবেণীতে ডিঙা থামিয়ে সপ্তগ্রাম ভ্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘দেখিব কেমন সপ্তগ্রাম।’ সেই নগরের প্রতি চাঁদ সওদাগর এতটাই মোহিত হয়ে পড়েছিলেন যে, এইখানে তিনি দিন দুয়েক থেকে গিয়েছিলেন। এর বহু পরে নিত্যানন্দ ধর্মপ্রচার করতে হাজির হয়েছিলেন এই সপ্তগ্রামে। এই দুটি উদাহরণই বিদেশিদের সপ্তগ্রামে আগমনের আগের কথা।
লেখক দিলীপ সাহা তাঁর ‘সপ্তগ্রামের সন্ধানে’ বইটিতে কনৌজরাজ প্রিয়বন্তের সাত পুত্র— অগ্নিত্র, মেধাতিথি, বপুষ্মান, জ্যোতিষ্মান, দ্যুতিষ্মান, সবন ও ভব্য-এর উল্লেখ করে বলেছেন যে, তাঁরা নিজেদের রাজকীয় জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং অবশেষে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে উপস্থিত হয়ে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত স্থানের সন্ধান পান। তপস্যার উপযুক্ত স্থান হিসেবে সাতটি গ্রামকে তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন। যথা, বাসুদেবপুর, বাঁশবেড়িয়া, শিবপুর, কৃষ্ণপুর, দেবানন্দপুর, ত্রিশবিঘা ও বলদঘাঁটি— যেটি ‘সপ্তগ্রাম’ নামে পরিচিত।
পুরাণে ‘সপ্ত’ সংখ্যাটিকে মঙ্গলসূচক শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই কারণে, ‘সপ্তগ্রাম’ নামটির সার্থকতা প্রসঙ্গে লেখক দিলীপ সাহা, পঞ্চদশ শতকের কবি শঙ্কর-কিঙ্কর মিশ্র রচিত ‘গৌরীমঙ্গল’ কাব্যের দুটি পঙক্তি উল্লেখ করেছেন— ‘গৌর মধ্য সপ্তগ্রাম মহাপুণ্যস্থান, ত্রিবেণীর তীরে সপ্তঋষির বিশ্রাম।’ সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, বন্দর হিসেবে পরিচিতি লাভের আগে ‘সপ্তগ্রাম’ স্থানটি ধর্মীয় ক্ষেত্র হিসেবেই প্রসিদ্ধ ছিল। অনুমান করা হয় যে, তাম্রলিপ্ত বন্দরের পতনের পরই, বন্দর হিসেবে উল্লখযোগ্য হয়ে ওঠে এই ‘সপ্তগ্রাম’। সেইসময়, সরস্বতী নদীর তীরে প্রচুর ঘাট থাকায় বাণিজ্যতরী পণ্য নিয়ে সেইখানেই থামত। ব্যাজরার বাঁধাঘাট ছিল সেখানকার একটি উল্লেখযোগ্য ঘাট।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে, দশরথ বসুর বংশধর করুণাময় বসু, তাম্রলিপ্ত শহর পরিত্যাগ করে চন্দননগরের বিলকুলি গ্রামে বাণিজ্যসূত্রে আসেন। আবার এটাও অনুমান করা হয় যে, সেইসময় কররানি বংশের সুলতান দাউদ খাঁয়ের সঙ্গে করুণাময় বসুর পূর্ব পরিচিতির কারণে, দাউদ খাঁ তাঁকে এই শহরে বাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন। দাউদ খাঁর পুত্র বায়জিত খাঁ ছিলেন সেইসময় হুগলি অঞ্চলের প্রভাবশালী শাসক, যিনি করুণাময় বসুকে উপদেষ্টার পদে আসীন করে তাঁকে ‘খলিসানি’ গ্রামটি উপহার দিয়েছিলেন।
চন্দননগরের প্রাক্ঔপনিবেশিক ইতিহাসে ‘খলিসানি’ এবং ‘গন্দলপাড়া’ গ্রামদুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল। করুণাময় বসুর সময়কালে ‘খলিসানি’ গ্রামটি তিনভাগে বিভক্ত হয়— খলিসানি, বিষ্ণুবাটি, নন্দনবাটি। তাঁর শাসনকালে সঞ্চিত অপর্যাপ্ত পুঁজি দিয়ে তিনি বেশকিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলেন। যেমন— বিশালক্ষী মন্দিরের নির্মাণ, বিভিন্ন বিগ্রহের প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সরস্বতী নদীর তীরে কলু, তিলি, মালাকার প্রভৃতি জাতির বসতির পত্তন করে ‘বহুবাজার’ বা ‘বউবাজার’ নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন।
সেইসময় খলিসানি অঞ্চলের বিপুল জনসংখ্যার বেশিরভাগ ছিলেন শ্রমজীবী এবং কৃষিজীবী। বিশালক্ষী মূলত ছিলেন শাক্ত দেবী। তিনি কৃষিজীবী মানুষদের দ্বারা পূজিতা ছিলেন। করুণাময় বসু নিজে বৈষ্ণব হওয়া সত্ত্বেও তাদের আবেগের মর্যাদা রেখে শাক্ত পূজার প্রচলন করে দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রকুমার বসুর লেখা থেকে জানা যায়, ১৫০৮ সালে তাম্রলিপ্তে প্রতিষ্ঠিত পৈতৃক শারদীয়া শ্রীশ্রীদুর্গাপূজার পুনরায় প্রচলন করেন করুণাময় বসু এই ‘খলিসানি’ অঞ্চলে। খুব সম্ভবত, করুণাময় বসুর দুর্গাপূজাই পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপূজা। কারণ, সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দুর্গাপূজার সূচনাকাল ১৬১০ সাল।
করুণাময় বসুদের বংশধারার কার্যকলাপ চন্দননগরের প্রাক্ঔপনিবেশিক ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ, সেই সময়ে আমরা বহমান এক গ্রামীণ সভ্যতার সাক্ষী হয়ে থাকি, যেখানে বৈষ্ণব ও শাক্ত, শৈব এবং বৌদ্ধ পরস্পরের মধ্যে মিশে গিয়েছিলো। এমনকি, মুসলমান নবাবও বিশালক্ষী পূজার জন্য বার্ষিক অনুদান দিতেন। পাঠানদের পর মুঘল আমলেও অনেকদিন পর্যন্ত এই ‘সপ্তগ্রাম’ বিখ্যাত ছিল। জ্যাড-দ্য-বারোস-এর মতে, গৌড় এবং চট্টগ্রামের পর এই সপ্তগ্রামই ছিল বাংলার তৃতীয় বড় শহর।
সপ্তগ্রামকে একসময় বলা হত ‘সাতগাঁ’ বন্দর এবং এর পার্শবর্তী সরস্বতী নদী পরিচিত ছিল ‘সাতগাঁ রিভার’ নামে। সেই সময়ে, সপ্তগ্রাম বন্দরে পর্তুগিজ বণিকেরা সমুদ্র থেকে সরস্বতী নদী দিয়ে প্রবেশ করত। সিজার ফ্রেডরিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেইসময় সাতগাঁ বন্দরে অনেক পণ্যবাহী জাহাজ আসত এবং সাধারণত চাল, কাপড় এবং মরিচের ব্যবসার উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিলো। সেইসময় সরস্বতী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল অপেক্ষা হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ছিল অনেকটাই নির্জন।
একসময়ে, প্রচণ্ড ভূমিকম্পের জেরে ভূমিরূপের পরিবর্তনের কারণে হুগলী নদীর জলধারা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলত, সরস্বতী নদীতে জলধারা কমে গিয়ে সেইখানে ক্রমশ পলি জমার কারণে, ধীরে ধীরে নদী তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলে। যার ফলে, বাণিজ্যের জাহাজ আর ঢুকতে না পারায়, সেখানে ক্রমশ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। সেই কারণে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই সপ্তগ্রাম বন্দরে আস্তে আস্তে ভাঙন ধরতে থাকে।
‘সপ্তগ্রাম’ বন্দরের পতনের আরেকটি অন্যতম কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে এই অঞ্চলে সুবর্ণবণিকদের উপস্থিতি। সেই সময়ে, সপ্তগ্রামে সুবর্ণবণিকরা বসবাস করতেন। প্রভু নিত্যানন্দ তাঁদের বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দিয়ে সমাজে অনেক উচ্চ স্থান দেন। ফলত, তাঁদের পুঁজি বৈষ্ণবদের মধ্যে ঢুকে পড়ে। পরবর্তীকালে, হুগলি থেকে ব্যবসায় লাভের সম্ভাবনা বেশি দেখে সুবর্ণবণিকরা সপ্তগ্রাম ছাড়লে, তাঁদের পুঁজিও সপ্তগ্রাম ছেড়ে চলে যায় হুগলির দিকে এবং ক্রমশ হুগলির উত্থানের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন তাঁরা। সুতরাং, এই ঘটনা থেকে অনুমান করাই যায় যে, ‘সপ্তগ্রাম’ বন্দরের পতনের কারণ হিসেবে সুবর্ণবণিকদের স্থানান্তরও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও, ‘সপ্তগ্রাম’ বন্দরের জৌলুস হারিয়ে যাওয়ার পিছনে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে মনে করা হয় যে, সরস্বতী নদী তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলার আগেই পর্তুগিজ বণিকেরা সপ্তগ্রাম থেকে সরে যেতে থাকে। সপ্তগ্রামের অবনতি দেখা দিতে শুরু করলে পর্তুগিজ বণিকদের যত্নেই হুগলি শহরের গোড়াপত্তন হয়। পর্তুগিজরা এইখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একটি দুর্গ নির্মাণ করেন এবং এই দুর্গ থেকেই আধুনিক হুগলি শহরের সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ভাগীরথীর তীরবর্তী বহু জায়গায় ইউরোপীয় বণিকেরা উপনিবেশ গড়েছিলেন, তার মধ্যে এই জায়গাটি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। কিন্তু ঠিক কোন সময়ে হুগলির উৎপত্তি হয়েছিলো, সেটা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি।
হুগলির নামকরণ নিয়ে নানা মতবিরোধ থাকলেও, অনেকে মনে করেন প্রচুর হোগলা গাছের অবস্থানের ফলে হুগলি নামকরণ হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে হুগলি নদীর জলধারা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত এই নদী শতাব্দীর সভ্যতা, বাণিজ্য এবং রূপান্তরের নীরব সাক্ষী।
সপ্তগ্রাম থেকে পর্তুগিজ বণিকদের সরে আসার আরও একটি কারণ ছিল। মুঘলদের কর্তৃত্ব থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার জন্যই সপ্তগ্রাম থেকে সরে এসে, হুগলি নদীর তীরবর্তী স্থানে বসতি স্থাপন করেন পর্তুগিজ বণিকরা এবং গড়ে তোলেন হুগলি বন্দর। এরপর দেখা যায়, অন্যান্য বিদেশি উপনিবেশকারী অর্থাৎ ওলন্দাজ বণিক, ইংরেজ, দিনেমার, ফরাসিরা এই বন্দরে আসতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে মুঘল শাসনের দুর্বলতার কারণে পর্তুগিজ শক্তির উত্থান ঘটলেও, ১৬৩৭ সালে মুঘলদের সঙ্গে পর্তুগিজদের যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়। পরবর্তী বেশকিছু বছর বাংলায় মুঘলরা শক্তিশালী শাসক হিসেবে রাজত্ব করলেও, ১৬৬৩ সালে বাংলার সুবেদার মীর জুমলার মৃত্যু হওয়ার পর থেকে বাংলায় মুঘল শক্তির প্রভাব আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
ইতিমধ্যে, ১৬৮৬ সালে, মুঘলদের সঙ্গে ইংরেজদের তীব্র সংঘর্ষ বাধে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে মুঘল প্রশাসনের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে এবং ইব্রাহিম খাঁর দুর্বল শাসন প্রাক্ঔপনিবেশিক যুগের অবসান ঘটিয়ে চুঁচুড়া এবং চন্দননগরকে ঘিরে যথাক্রমে— ওলন্দাজ ও ফরাসি শক্তির উত্থানের পথ সুগম হয়ে ওঠে। ইংরেজরা সেই সময়ে ওলন্দাজ এবং ফরাসিদের সঙ্গে অনবরত সংঘর্ষ এড়াবার জন্য কলকাতায় আশ্রয় নেন। করমণ্ডলের ওলন্দাজ ডিরেক্টরের নির্দেশে হুগলিতে ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেন। সেই সময়ে হুগলির দিকে পর্তুগিজদের প্রভাবের ক্রমবিস্তারকে প্রতিহত করতে মুঘলরা সাহায্যের উদ্দেশ্য নিয়ে ওলন্দাজ বণিকদের কোনওরূপ বাধা দেননি। আনুমানিক ১৬৫৬ সালে, চুঁচুড়ায় ওলন্দাজরা পাকাপাকিভাবে কুঠি স্থাপনের অনুমতি পেলে ওলন্দাজ শক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত
হতে থাকে এবং সেই কুঠি পরে ‘গুস্তাভাস’ দুর্গ হিসেবে গড়ে ওঠে। তখনও পর্যন্ত চন্দননগরে ফরাসি উপনিবেশ গড়ে ওঠেনি।