বগুলার ‘কুশোর বিদ্রোহ’, ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়

ফাইল চিত্র

গৌতম অধিকারী

ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, নীল বিদ্রোহের আগুন ১৮৫৮ সালে প্রথম জ্বলেছিল নদিয়া জেলার বগুলা নীলকুঠিকে কেন্দ্র করে। তার আগে এখানে-সেখানে নীলকরদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠলেও তা প্রতিরোধের স্তরে উন্নীত হয়নি। অর্থাৎ বিক্ষোভ সরাসরি বিদ্রোহে পরিণত হবার উপাচারে সমৃদ্ধ হয়নি। শ্যামনগর, গাড়াপোতা, ছোটো চুপড়িয়া, বড়ো চুপড়িয়া প্রভৃতি এলাকার চাষীরা বগুলা নীলকুঠির ভারপ্রাপ্ত টুইডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহে সংগঠিত করতে শুরু করে। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘সংবাদপ্রভাকর’-এর পাতায় সেই বিদ্রোহের সংবাদ রয়েছে। বিদ্রোহের আগুন সাময়িকভাবে স্তিমিত হলেও বেশিদিন তা থামিয়ে রাখা যায়নি। উপযুক্ত সমিধের জোগান হতেই ১৮৫৯ সালে চৌগাছার দিগম্বর বিশ্বাস, পোড়াগাছার বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও হাঁসখালি-গোবিন্দপুরের গোপাল তরফদারের নেতৃত্বে সেই আগুন কার্যকরীভাবে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। এবং নীল বিদ্রোহ একটা সাফল্যজনক পরিণতির সীমানা স্পর্শ করে। খানিকটা কাকতালীয় ঘটনা হলেও সত্য যে এর ঠিক আশি বছর পরে রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ কৃষক সংগঠন ‘সারা ভারত কৃষক সভা’র পতাকাতলে বাংলাদেশে প্রথম কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয় বগুলাকেই কেন্দ্র করে। আখচাষীদের এই বিদ্রোহ আঞ্চলিক ভাষায় ‘কুশোর বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। (নদিয়া-যশোর জেলায় ‘আখ’ কুশোর নামে পরিচিত।) কোথাও কোথাও বিদ্রোহের সামান্য উল্লেখ থাকলেও কখনও পরবর্তী কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব কিংবা ইতিহাস-রচয়িতাদের কাছে কোনো এক অজানা কারণে তা উপেক্ষার অন্ধকারে রয়ে গেছে।

১৯৩৬ সালে সারা ভারত কৃষক সভা গঠনের পরে বাংলা প্রদেশের প্রথম সংগঠন তৈরি হয় ১৯৩৭ সালে বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়রে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মধ্য দিয়ে। সম্মেলনে প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজাফ্‌ফর আহমেদ কৃষক সভার কাজ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা উপস্থিত করেন। এগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল কৃষক সমিতিগুলো গ্রামে গ্রামে তাঁদের নেতৃত্বেই তাঁদের জীবনের সঙ্কট, চাহিদা সম্পর্কে সচেতন থেকে জোতদার-জমিদারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবে। এই সম্মেলনে বগুলার মামজোয়ান বা বড়ো মুড়াগাছা থেকে কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন কি না আমরা জানি না। কিন্তু ১৯৩৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এইসব অঞ্চলে কৃষকরা সংগঠিত হতে শুরু করে কতকগুলো বাস্তব সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ এ-বৎসরেই দর্শনাতে কেরু এণ্ড কোম্পানির চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। চিনিকলের কাঁচামাল হিসেবে আখ বা ইক্ষু, নদিয়ার আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলা হয় ‘কুশোর’ তা প্রচুর পরিমাণে দরকার হয় কোম্পানির।


মাথাভাঙা-চূর্ণী-ইছামতী-গোরাগাঙনি-ডিঙিটানা বিধৌত নদিয়ার এই অঞ্চলের মাটি কুশোর চাষের উপযোগীও বটে। ফলে কোম্পানি স্থানীয় জমিদারের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে দাদন প্রথার মাধ্যমে চাষীকে আখ বা কুশোর চাষে বাধ্য করতে চায়।

কেরু এ্যাণ্ড কোম্পানি স্থানীয় জমিদার ও জোতদারদের কাছ থেকে জমির মালিকানা স্বত্ব নিয়ে আখচাষের ফার্ম তৈরি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করে। এইসব জমির নব্বই শতাংশ ভাগচাষীরা উটবন্দী ও শস্য কড়ারে ভাগচাষ করত। আবার অনেক জমি ছিল যার স্বত্বই ছিল চাষীদের। ছিল চাষীদের নিজস্ব মালিকানাধীন বাগান। এসব কোম্পানি জোর করে দখল করে এবং সেখানে নামানো হয় যন্ত্রচালিত লাঙল বা ট্রাক্টর। ফলে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। আন্দোলন সংগঠিত হয় কতকগুলো ন্যায্য দাবি সামনে রেখে। তাঁরা চাইলেন দখলকৃত জমির বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে চাষীর জন্য আবাদী জমি। আখ চাষে ইচ্ছুক চাষীদের ন্যায্য দামে ভালো আখবীজ প্রদান ও আখের ন্যায্য দাম। এবং কোম্পানির কর্মচারীদের আখের ওজন-সংক্রান্ত কারচুপি বন্ধ করা।

দীর্ঘস্থায়ী এই আন্দোলনের সূত্রপাত বগুলা-মুড়াগাছাতে। সমসাময়িক এই কৃষক আন্দোলনের সর্বক্ষণের কর্মী ও অগ্রণী নেতা সেদিনের তরুণ কমিউনিস্ট অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘প্রথমে হাঁসখালি থানার মুড়াগাছা কৃষককর্মী অফিসকে কেন্দ্র করে হাঁসখালি থানার বিভিন্ন গ্রামে আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরে এই আন্দোলন দর্শনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র দামুরহুদা থানা, কৃষ্ণগঞ্জ থানার ব্যাপক অঞ্চল, চুয়াডাঙ্গা থানার নীলমণিগঞ্জ, আলমডাঙা থানার বিভিন্ন গ্রামে প্রসারিত হয়।’ (কৃষক আন্দোলনে নদীয়া জেলা, ‘পশ্চিমবঙ্গ’, নদীয়া জেলা সংখ্যা, ১৯৯৭)। সম্প্রতি ‘Communist Movement in Nadia’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্রে এই কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ভবানন্দ রায় লিখেছেন, ‘‘At first, a movement was formed in different villages of the Hanskhali police station through the farmers’ organization of Muragachha village of the Hanskhali police station. Later,’’ দুর্ভাগ্যের বিষয় কুমুদনাথ মল্লিকের ‘নদীয়া কাহিনী’ নতুন করে সম্পাদনা করতে গিয়ে সংযোজন অংশে সম্পাদক মোহিত রায় ‘কৃষক আন্দোলনে কুষ্টিয়া’র বিস্তৃত বিবরণে নদিয়া জেলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস বিবৃত করলেও বগুলার এই আন্দোলন সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি। অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর রচনায় সবিশেষ গুরুত্বসহ এই ঘটনার কথা উল্লেখ করলেও বিস্তারিত বিবরণ দেননি। কিন্তু তাঁর লেখা থেকে এটাও পরিষ্কার যে ‘প্রথমে হাঁসখালি থানার মুড়াগাছা কৃষককর্মী অফিসকে কেন্দ্র করে হাঁসখালি থানার বিভিন্ন গ্রামে আন্দোলন গড়ে ওঠে’। স্বাভাবিকভাবেই এই ‘কৃষককর্মী অফিস’ গড়ে ওঠার ইতিহাসটি একটা স্বতন্ত্র গুরুত্ব দাবি করে। সেই দাবির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ১৯৩৮ সালে ১০ ডিসেম্বর সংখ্যার ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের একটি লেখা— ‘বগুলায় গিয়া কি দেখিলাম?’ আপাতত আমাদের নজর সেই লেখা অথবা একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলের দিকে।


সদ্য বিলেত-ফেরত তরুণ কমিউনিস্ট কর্মী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত এবং আরও অনেকেই হাজির হন বগুলায় চাষীদের কাছে। এবং এখানে থেকে কৃষকদের সংগঠিত করে আন্দোলন শুরু করেন। সঙ্গে পেলেন নদিয়ার অবিসংবাদী কৃষক নেতাদের, যাঁরা তখন বয়সে তরুণ সেই সুশীল চট্টোপাধ্যায়, অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়, মাধবেন্দু মোহন্তসহ অনেককেই। ১৯৩৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সংখ্যার ‘দেশ’ পত্রিকায় ইন্দ্রজিৎ লিখেছেন ‘বগুলায় গিয়া কী দেখিলাম’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন। তিনি লিখেছেন, ‘‘দর্শনার চিনির কলের কর্ত্তৃপক্ষের স্বার্থ আর স্থানীয় জমিদারের স্বার্থ একত্র মিলিত হ’য়ে চাষীদের একেবারে সর্ব্বস্বান্ত করবার উপক্রম করেছে।…ব্যাপারটা কী– ভালো করে জানবার জন্য বিগত ৩রা ডিসেম্বর কলিকাতা থেকে রওনা হলাম। বিকেলবেলায় ট্রেন বগুলা স্টেশনে আমাদের পৌঁছে দিলো। গ্রামের মধ্যে গিয়ে শুনলাম, নিকটেই এক আমবাগানে উৎপীড়িত কৃষকদের সভা বসেছে। সভায় গিয়ে প্রজাদের অভিযোগের যে বিবরণ শুনলাম, তার মর্ম্ম হচ্ছে, দীর্ঘকাল ধ’রে কৃষকেরা যে সব জমিতে চাষ ক’রে আসছিল– সেগুলিকে তাদের অধিকার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দর্শনার চিনির কলের মালিকদের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’ খুব স্বাভাবিকভাবেই নীল বিদ্রোহের সূতিকাগার বগুলাতে নতুন করে কৃষক-নিপীড়নের এই ঘটনার সঙ্গে নীলকর-নিপীড়কদের একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ইন্দ্রজিৎও লিখেছেন, ‘‘আমার চোখের সামনে অতীত দেখা দিলো তার নীলকর সাহেব আর নীলকুঠগুলি নিয়ে। সে-দিনও বাঙলার পল্লীগুলি বিদেশী কোম্পানীর ধনলিপ্সার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে বোধহয় আজিকার মত পরিত্রাহি ডাক ছেড়েছিল।’’ এই তুলনা বা প্রতিতুলনায় কোনো অতিশয়োক্তি নেই। কারণ বেঙ্গল ইণ্ডিগো কোম্পানি এবং কেরু এণ্ড কোম্পানি নামে আলাদা হলেও শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতনের চরিত্রে এক। এবং উভয়েই স্থানীয় জমিদারদের সমর্থন পেয়েছে। নীলকরদের সঙ্গে জমিদারীর সীমানা প্রভৃতি নিয়ে জমিদারদের কারো কারো সংঘাত তৈরি হলেও এক্ষেত্রে জমিদাররা ছিলেন সম্পূর্ণভাবেই কেরু এণ্ড কোম্পানির পাশে। তাঁরাই উদ্যোগী হয়ে চাষীর জমি কেড়ে নিয়ে কেরু এণ্ড কোম্পানির হাতে তুলে দেয়। এবং কোম্পানি জোর করে চাষীদের ফসলের জমিতে নামিয়ে দেয় ট্রাক্টর; যন্ত্রচালিত লাঙল। বগুলা থেকে হাঁসখালি যাবার পথের পাশের গ্রাম মুড়াডাছায় পৌঁছে ইন্দ্রজিৎ প্রত্যক্ষ করেছেন সেই যন্ত্রদানবকে, যা আসলে ভেঙেচুরে দিচ্ছে চাষীদের বুকের পাঁজর— ‘‘এক জায়গায় দেখি, বিদেশী কোম্পানীর কলের লাঙল রবিশস্যগুলিকে নিষ্পেষিত ক’রে মাঠের মধ্যে ইতস্তত মাতালের মতো যাতায়াত করছে। যে দুর্ভাগা কৃষকের রবিশস্য এমন নির্দয়ভাবে বিনষ্ট হয়েছে, তার অন্তহীন বেদনার কথা ভেবে মন বিচলিত হয়ে উঠলো।

নিষ্পেষিত গাছগুলির সঙ্গে হতভাগা চাষীর কত যে আশা নির্মূল হয়ে গেছে।’’ ঈষৎ কাব্যিক ভাষায় ইন্দ্রজিৎ আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন, ‘‘এই কি আমার চিরপরিচিত বাঙলাদেশ? বাঙলাই যদি হবে তবে মাঠে বাঙালি কৃষক কই? সেই লাঙল কই? বলদ কই? বাঙালি কৃষকের কণ্ঠে সেই আকুল করা বাউলের সুর কই? মাথার উপরে জেগে আছে সোনার বাঙলার চির-নির্ম্মল আকাশ! কিন্তু আকাশের সেই নীরবতা কোথায়? ট্র্যাক্টরের গগনবিদারী গর্জ্জন শ্যামলবনানীপরিবৃত প্রান্তরের মধুর নীরবতাকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে।’’ এই আক্ষেপ এক স্বদেশপ্রেমিক তরুণের আবেগের প্রকাশ তো বটেই! কিন্তু সেখানে দেশপ্রেমের ধর্মবাদী মেরুকরণ নেই, আছে বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের পরম্পরার উত্তরাধিকার— ‘‘বগুলার মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল এই কথায় মনে হতে লাগল— চণ্ডীদাসের আর বিদ্যাপতির, বঙ্কিমচন্দ্রের আর মধুসূদনের, হেমচন্দ্রের আর রবীন্দ্রনাথের বাঙলা পর্দ্দার ছবির মতো মিলিয়ে যাচ্ছে, আর যে বাঙলা চোখের সামনে উঠেছে সে কবির বাঙলা নয়, অর্থলোলুপ ধনকুবেরের বাঙলা।’’ তবুও বলতে হবে, সেদিনের তরুণ কমিউনিস্ট ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত আবেগের চূড়ায় উঠে তদানীন্তন বাংলাদেশ ও বাঙালি কৃষকের সমস্যার কাব্যিক সমাধানের পথ বাড়াননি। বরং সমস্যার গভীরকে দেখার চেষ্টা করেছেন তাঁর কিশোরবয়সের মার্কসবাদ-অনুশীলিত মন ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। ব্যাখ্যা করেছেন সমস্যার মূলকে। লিখেছেন, ‘‘সরল কৃষকেরা জমিজমা হারিয়ে শহরের কলকারখানায় দিনমজুরে পরিণত হচ্ছে এবং পুরাকালের দোর্দ্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারগণের বংশধরেরা জমিকে মিলের মালিকের কাছে জমা দিয়ে সাধারণ সুদখোরের পর্যায়ে নেমে গিয়েছে।’’

ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের এই লেখাটি ‘ইতিহাস’ নয়, তবে ইতিহাসের উপকরণ তো বটেই। সাল-তারিখ মেনে ইতিহাসের মতো বর্ণনা দিলেও তিনি উল্লেখ করেননি, মামজোয়ানে কোন বন্ধুর পরামর্শক্রমে তিনি বগুলা এসেছিলেন! জমিদারদের উল্লেখ সত্ত্বেও অন্তত পারিবারিকভাবে কোন জমিদার হিসেবে তাদের চিহ্নিত করা যায়, তার সুলুক-সন্ধান নেই। এইসব তথ্য পেতে আমাদের খানিকটা সম্ভাবনার সত্যের উপর জোর দিতে হয়। মামজোয়ানে ওই সময়ে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু বিপ্লবী আন্দোলনে ততদিনে দীক্ষা নিয়েছেন বিপ্লবী মহাদেব সরকার। মূলত জাতীয় কংগ্রেস-ঘরানায় তাঁর রাজনৈতিক জীবন অতিবাহিত হলেও জীবনের প্রাথমিক পর্বে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বলশেভিক পার্টির দ্বারা খানিকটা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। বিশেষ করে ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা অবিদিত নয়। আবার রাজনৈতিক জীবন থেকে তিনি যখন অনেকদূরে তখন কাকাবাবু মুজাফ্ফর আহমেদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের যে সাক্ষ্য পাওয়া যায়, তাতে বামপন্থী আন্দোলনের শুরুর এই সময়কালে (১৯৩৮-৩৯) মামজোয়ানে রাজনৈতিকভাবে এতটা এগিয়ে থাকা মানুষ হিসেবে মহাদেব সরকার ছাড়া আর কাউকে কল্পনা করাও মুশকিল। ফলে এই কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে বিপ্লবী মহাদেব সরকারের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

কৃষকদের প্রতিপক্ষ হিসেবে কেরু এণ্ড কোম্পানিকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হলেও জমিদারদের বংশধর সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কথা ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত বলেননি। কিন্তু এলাকার পরিচয় বুঝে এটা চিহ্নিত করা অসম্ভব নয়। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে মামজোয়ান পরগণার জমিদারী কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির হাত থেকে বারহাট্টা বিশ্বাসদের হাতে এসে পৌঁছায়। আর মুড়াগাছার জমিদার ছিলেন বিতর্কাতীতভাবে ঘোষেরা। অন্যদিকে বগুলা কুঠিপাড়া, শিবচন্দ্রপুর, ময়ূরহাট, কৌতুকনগর, বংশীনগর, পায়রাডাঙা, গৌরনগরসহ বিভিন্ন গ্রামে নতুন জমিদার রামগোপাল চেৎলাঙ্গীর বংশধর বদ্রীনারায়ণ চেৎলাঙ্গীর দাপটে পরিত্রাহি রব তুলেছে। শক্তপোক্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইটা সহজ এবং স্বল্পসময়ের নয়, এটা বুঝতে পেরেছিলেন সংগঠকেরা। ফলে স্থায়ী আন্দোলনের সংগ্রামী শক্তি বা প্লাটফর্ম হিসেবে কৃষক সমিতি গড়ে উঠেছিল, এমন ইঙ্গিত কিন্তু রয়েছে ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের লেখাটিতে। গড়ে তোলা হলো একটি কার্যালয়। কারণ, বিভিন্ন এলাকা থেকে কর্মীরা আসতে শুরু করেছে এবং অনেকেই আসবেন। তাঁদের থাকার জন্য আশ্রয় একটা দরকার বাগান পরিষ্কার করে একটা পরিত্যক্ত বাড়িকে ব্যবহারোপযোগী করে তোলা হলো। ইন্দ্রজিৎ লিখেছেন, ‘‘গ্রামের মাঝে জঙ্গলে-ঢাকা একটা পুরনো বাড়ী ছিলো। গ্রামবাসীরা সেই পুরনো বাড়ী কর্ম্মীদের থাকার জন্য দিতে চাইল।… দেখতে দেখতে গ্রামের ছেলে-বুড়ো— সবাই দা, কুড়োল, কোদাল ইত্যাদি নিয়ে উপস্থিত হলো। আমাদের চারণদলের যিনি সর্দ্দার তিনিই সর্ব্বপ্রথম দা দিয়ে জঙ্গলের গায়ে আঘাত করলেন। তারপর আরম্ভ হয়ে গেলো বন আর আগাছার উপর গ্রামবাসীদের প্রবল আক্রমণ।’’ এভাবেই অব্যবহৃত ঘরবাড়ির ঝুল ঝেড়ে বসবাসের উপযোগী করে তোলা হলো সেদিন। আন্দোলনে মুড়াগাছায় তৈরি হওয়া অফিসটির গুরুত্ব সম্পর্কে নদিয়ার কৃষক আন্দোলনের অগ্রণী মানুষ ও এই আন্দোলনের সর্বক্ষণের নেতা কমরেড অমৃতেন্দু মুখার্জি (গদাইদা) লিখেছেন, ‘‘প্রথমে হাঁসখালী থানার মুড়াগাছা গ্রামে কৃষককর্মী অফিসকে কেন্দ্র করে হাঁসখালী থানার বিভিন্ন গ্রামে আন্দোলন গড়ে ওঠে, পরে এই আন্দোলন দর্শনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র দামুরহুদা থানা, কৃষ্ণগঞ্জ থানার ব্যাপক অঞ্চল, চুয়াডাঙা থানার নীলমণিগঞ্জ, আলমডাঙা থানার বিভিন্ন গ্রামে প্রসারিত হয়।’’ আর প্রচণ্ড প্রাণস্ফুর্তির এই প্রকাশ দেখে কিশোর ইন্দ্রজিৎ অনুমান করতে পারছিলেন, ‘‘বগুলার সমস্যা অচিরে সারা বাঙলার সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।’’ এবং তিনি মনে করেছিলেন, ‘‘এই সমস্যার সমাধান হবে জনসাধারণের অন্তর্নিহিত শৌর্য্যকে জাগিয়ে তোলার পথে এবং শৌর্য্যের এই জাগরণ একান্তভাবেই নির্ভর করছে মধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষিত যুবকদের সঙ্গে গ্রামের জনসাধারণের মিলনের উপরে।’’ বলা বাহুল্য, এই ভাবনার বাস্তবায়ন হতে খুব বেশিদিন আমাদের দেরি করতে হয়নি। অতীত এবং চলমান বাস্তবতা অচিরেই এনে দিয়েছিল দাবি আদায়ের জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হবার চেতনা। বলা যেতে পারে নদিয়া জেলার বামপন্থী চেতনাসমৃদ্ধ কৃষক আন্দোলনের সূত্রপাত হলো এখানেই, মুড়াগাছার সেই অচিহ্নিত ‘কৃষককর্মী’ অফিসটিই হয়ে উঠলো বগুলার বাম আন্দোলনের সূচনাপীঠ।


নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্য দিয়ে অত্যাচার ও অত্যাচারীর মুখোমুখি দাঁড়াবার একটা উত্তরাধিকার নদীয়ার মাটি বোধহয় অর্জন করেছিল অনেক আগেই। রক্তের মধ্যে কথা বলে গেছে বারবার সেই ভাষা। ১৮৭০-এ পাবনা প্রজাবিদ্রোহের আঁচ এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল লাগোয়া নদিয়া জেলার কুষ্টিয়া অঞ্চলে। লক্ষ্যনীয় বিষয় ১৯২০ সালেই; অর্থাৎ নীল বিদ্রোহের মাত্র ষাট বছরের মুখে জেলার কৃষকদের সংগঠিত হতে দেখা যাচ্ছে। ১৯২০ সালে দামুরহুদা থানার কাপাসডাঙাতে বলা যায় কৃষকের সংগঠন গড়ে তোলার প্রথম প্রক্রিয়া শুরু হয় পাদ্রী ফাদার রাবেত-এর নেতৃত্বে। উত্তর-পূর্ব নদিয়ার কুষ্টিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেশিরভাগ কৃষক এই সম্মেলনে যোগদান করেন, এবং বলা যায় নদিয়া জেলার কৃষক আন্দোলনের এটাই প্রথম বিশশতকীয় উদ্যোগ। ফাদার বারেত এই সম্মেলনে কৃষকদের সংগঠিত হবার আহ্বান জানিয়েছেন বারবার, এবং লক্ষ্য করা গেছে গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠছে ‘কৃষক সমিতি’র সংগঠন। কিন্তু এই সংগঠনের কর্মপ্রয়াস কতদিন পর্যন্ত চলেছিল, স্পষ্টভাবে তা বলা যাচ্ছে না।

অনেকটাই রাজনৈতিক সাংগঠনিক উদ্যোগে বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলনের জন্ম ১৯২৫ সালে। তার দ্বিতীয় অধিবেশন বসে নদিয়ার কৃষ্ণনগর শহরে ১৯২৯-এর ৩-৪ ডিসেম্বর। প্রধান উদ্যোক্তা হেমন্তকুমার সরকার। এই অধিবেশনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গীয় বিধান পরিষদে প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধনীতে রায়ত, কৃষক ও প্রজার মতামত প্রদানের অধিকার প্রতিষ্ঠা। বলা যায় এই ১৯২৯-এই নদিয়ার কৃষক আন্দোলনের মধ্যে একটা অভিমুখ পরিবর্তনের সূচনা ঘটে যায় বলা চলে। এই বৎসরের ফেব্রুয়ারি মাসে কুষ্টিয়ায় যে কৃষক সম্মেলন হয় মূলত কমিউনিস্ট কর্মী ও নেতাদের উদ্যোগে, সেখানে যোগ দেন গ্রেট বৃটেন কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম সদস্য ফিলিপ স্প্রাট। এই সম্মেলনে জননেতা হেমন্তকুমার সরকার ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফফর আহমেদ, কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও ত্রিপুরার কৃষক নেতা ওয়াসিমউদ্দিন। এই সম্মেলনে ‘বঙ্গীয় কৃষক লীগ’ গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে মুজাফফর আহমেদ ও অন্য কয়েকজন কমিউনিস্ট কর্মী গ্রেফতার হবার জন্য সেই সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ করা যায়নি। তখনও সারা ভারত কৃষক সভা তৈরি হয়নি বটে, কিন্তু বাংলার কমিউনিস্ট কর্মীরা কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এবং তার ফলশ্রুতিতে মেদিনীপুরের ঘাটালে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে কৃষকনেতা বঙ্কিম মুখার্জির সভাপতিত্বে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানেও নদিয়া জেলার কুষ্টিয়া থেকে হেমন্তকুমার সরকারের উদ্যোগে কৃষক প্রতিনিধিদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।

১৯৩৬ সালে সারা ভারত কৃষক সভা প্রতিষ্ঠিত হবার মধ্য দিয়ে ভারতের কৃষক আন্দোলনে একটা রাজনৈতিক অভিপ্রায় যুক্ত হয় বলা যেতে পারে। ১৯৩৭-এ বাঁকুড়ার পাত্রসায়রে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন, সারা ভারত কৃষক সভার পতাকাতলে। তখন পর্যন্ত নদিয়া জেলার কৃষকরা এই সংগঠনের পতাকাতলে সংগঠিত হয়নি ঠিক, কিন্তু কর্মীরা নিজেদের উদ্যোগে সম্মেলনে প্রতিনিধি পাঠান। ১৯৩৮ সালের ২-৩ ডিসেম্বর হুগলির বড়া গ্রামে কৃষক সভার দ্বিতীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের পরে ১৯৩৮ সালেই কুষ্টিয়ার মোমিনপুর গ্রামে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা, নদিয়া জেলার প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নদিয়া জেলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ। নদিয়া জেলার কৃষক আন্দোলনের এই তারিখ ও স্থান নিয়ে কিঞ্চিৎ মতান্তর লক্ষ্য করা যায়। মোহিত রায় ‘নদীয়া কাহিনী’ সম্পাদনা করতে গিয়ে সংযোজন অংশে তারিখটি বলেছেন ডিসেম্বর ১৯৩৮। কিন্তু অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘নদিয়া জেলা কৃষক সম্মেলন সংগঠিত হয় ১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, তিলকপুর গ্রামে।’’ তিনি খুব স্পষ্টভাবে লিখেছেন, ‘‘তিলকপুর জেলা কৃষক সম্মেলনে নদিয়া জেলা কৃষক সমিতি গঠিত হয়। ব্রহ্মনগর গ্রামে কৃষক সমিতির অফিস খোলা হয়।’’ নির্বাচিত জেলা কমিটিতে ছিলেন— সভাপতি : সুশীল চ্যাটার্জি, সহসভাপতি : পূর্ণ পাল, অনন্ত ঘোষ, সদরুদ্দিন বিশ্বাস, মাধবেন্দু মোহন্ত; সম্পাদক : অমৃতেন্দু মুখার্জি, সহ-সম্পাদক : বিপুল পাল, মুরারী গোস্বামী; কোষাধ্যক্ষ : অমিয় রায়। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার অন্যতম নেতা কমরেড আব্দুল মোমিন। সম্মেলনে কৃষকদের উৎসাহ সম্পর্কে অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ছয় জোড়া (১২ বলদের ) গাড়িতে কমরেড আব্দুল মোমিনকে সম্মেলনে আনা হয়।’

নদীয়া জেলার প্রথম কৃষক সম্মেলনের সাল-তারিখ ও সময় নিয়ে যে বিভ্রান্তি সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আমরা জেলার প্রথম সম্পাদক অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়ের প্রদত্ত তথ্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এবং কোনো সংশয় নেই, জেলার এই সম্মেলন জেলার কৃষক আন্দোলনে একটা ধারাবাহিক আন্দোলনের পরম্পরায় সংগঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনের আগে আগেই নবদ্বীপ থানার মাজদিয়া, সজিনপুর, তিওড়খালি, বামনপুকুর এবং কোতোয়ালি থানার ব্রহ্মনগর, উসিদপুর, নিজামপুর, কাশীবাস, গঙ্গাবাসে সংগঠিত হয়েছে তাদের দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে। গঙ্গার চরজমিতে কৃষকের দখল প্রতিষ্ঠা, হাট-বাজারে আইন বহির্ভূত তোলা আদায় বন্ধ করা, আবাদী জমির জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি। এই সঙ্গে যুক্ত হয় মৎস্যজীবীদের দাবি, শ্লোগান ওঠে ‘জাল যার, জল তার।’ জঙ্গি আন্দোলন গড়ে ওঠে চাপড়া থানার তিলকপুর, পুকুরিয়া, মহৎপুর, জামিরডাঙায়। এবং অবশ্যই হাঁসখালি থানার মুড়াগাছায়।

কিন্তু মুড়াগাছার কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠার ইতিহাস কিঞ্চিৎ স্বতন্ত্র। প্রথমত কেরু এণ্ড কোম্পানির চিনিকল মালিক ও জমিদারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এখানে কৃষকদের এতকালের অধিকারে হাত পড়ে। আক্রমণটা তাৎক্ষণিক এবং সরাসরি। দ্বিতীয়ত, প্রথমদিকে এই আন্দোলন ছিল এই এলাকার কৃষকদের নিজস্ব উদ্যোগ, এবং সীমাবদ্ধ ছিল ছোট্ট এলাকার মধ্যেই। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট কর্মীরা ও জেলার কৃষক আন্দোলনের কর্মীরা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে গোটা জেলাব্যাপী না হলেও জেলার একটা বৃহৎ অংশে ছড়িয়ে দিতে পারে। কেরু এণ্ড কোম্পানির ভূমিকার মধ্যে দেখা গেল, তাঁরা স্থানীয় জমিদার ও জোতদারদের কাছ থেকে আবাদী জমি মালিকানা স্বত্ব খরিদ করে আখচাষের ফার্ম তৈরি করার জন্য দখল নেয়। যেসব জমিতে চাষীর নিজস্ব স্বত্ব ছিল, সেগুলো; বিশেষ করে বাগানগুলো ধ্বংস করে আখচাষের জন্য চাষযোগ্য করে তোলে। কিন্তু কোনো ক্ষতিপূরণ তাঁরা দিতে রাজি নন, ন্যায্য দরে আখের বীজ প্রদানের ব্যবস্থা করবেন না এবং দাদনের টাকার সুদের নির্দিষ্ট পরিমাণ ঠিক করবেন না। এই আক্রমণ আকস্মিক এবং প্রত্যক্ষ। এই প্রত্যক্ষ আন্দোলনে কৃষক সভার জেলার কর্মী ও নেতারা যুক্ত হয়ে দর্শনা চিনিকলের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত চাষীদের এলাকায় ছড়িয়ে দেন। অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায় কৃষক সভার জেলা সম্পাদক হিসেবে ছিলেন আন্দোলনের সর্বক্ষণের দায়িত্বে। সঙ্গে ছিলেন সন্তোষ পাল, বিমল পাল, পাঁচু বিশ্বাস, ধীরেন দাশগুপ্ত প্রমুখ।

দেখা যায় একটা পর্যায়ে মুড়াগাছার কৃষক আন্দোলন যেমন মুড়াগাছা এলাকায় যেমন সীমাবদ্ধ নেই, তেমনই তা শুধু কৃষকের আন্দোলন হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে না। তা ক্রমশ কৃষক ও শ্রমিকদের যৌথ আন্দোলন হিসেবে একটা স্বতন্ত্র চেহারা নিতে শুরু করেছে। কেরু এণ্ড কোম্পানির চিনিকলে ততদিনে গড়ে উঠেছে কারখানা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন। ফলে দুই শক্তির সমবেত আন্দোলনের ফলে কৃষকদের দাবির বেশিরভাগটাই আদায় হয় এবং শ্রমিকদের বেশকিছু দাবিও মেনে নেওয়া হয়। আন্দোলনের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে সংগঠন শক্তিশালী করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিকটা লক্ষ্য রেখে ১৯৩৯-এর জুন মাসে দর্শনাতে অনুষ্ঠিত হয় নদিয়া জেলা কৃষক সমিতির বিশেষ কনভেনশন। এই কনভেনশনে মোজাফফর আহমেদ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জ্যোতি বসু, মহম্মদ ইসমাইল প্রমুখ প্রকৃত প্রস্তাবে মুড়াগাছা কৃষক অফিসকে কেন্দ্র করে যে উদ্দীপনা তৈরি হয়, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত নদিয়া জেলার কৃষক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কুষ্টিয়া মহকুমার হরিনারায়ণপুরে জেলা কৃষক সভার দ্বিতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যার নতুন পর্বের সূচনা বলা যায়। ঘটনা পরম্পরা নিশ্চিত করে যে সারা ভারত কৃষক সভার কোনো জেলা সংগঠন

গড়ে ওঠার আগেই বগুলার কুশোর বিদ্রোহ সংঘটিত হয় বামপন্থী কম্যুনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বে। জেলার বাম কৃষক আন্দোলনে এই বিদ্রোহ ‘ভ্যানগার্ড’।