মনুয়া ও তার প্রেমিকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

মহেন্দ্র প্রতাপ সিং চৌহান

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে অনুপম সিংহ হত্যা মামলার রায় ঘােষণা করল আদালত। বৃহস্পতিবার সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনা করে বারাসতের চতুর্থ ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের বিচারপতি বৈষ্ণব সরকার এই হত্যাকাণ্ডে নিহতের স্ত্রী মনুয়া মজুমদার এবং তার প্রেমিক অজিত রায়কে দোষী সাব্যস্ত করেন।

এরপর শুক্রবার এই মামলার রায় ঘােষণা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয় আদালতের তরফে। ফলে ২০১৭ সালের ২ মে সংঘটিত হওয়া নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কী রায় দেয় আদালত সেদিকেই তাকিয়ে ছিল অনুপমের পরিবার সহ গােটা রাজ্যবাসী।

এ বিষয়ে নিহত অনুপ সিংহের পরিবার অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবিতে সােচ্চার হয়। ফলে অনেকেই মনে করেছিলেন জঘন্যতম এই অপরাধের জন্য দোষীদের ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তির ঘােষণা করবে আদালত। কিন্তু এদিন বিচারপতি বৈষ্ণব সরকার এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত মনুয়া ও তার প্রেমিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি পঞ্চাশ হাজার টাকা করে জরিমানার নির্দেশ দেন এবং জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছর কারাবাসের নির্দেশ দেন। 


এদিকে বিচারপতির দেওয়া এই রায়ে বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের কেউই খুশি নয় বলে জানা গিয়েছে। এক্ষেত্রে দোষীদের ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবনের সাজার কথা শােনার পর নিহত অনুপম সিংহের মা ও বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁদের দাবি, সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাঁরা।

অন্যদিকে এদিন আদালতে দাঁড়িয়ে মনুয়া নিজেকে নির্দোষ দাবি করে জানান, তিনি সফট টার্গেটের শিকার। বৃহস্পতিবারের মতাে এদিনও সাজা ঘােষণার সময় ভাবলেশহীন ছিল মনুয়া। সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে প্রেমিক অজিতের দিকে বরং খানিকটা ভেঙে পড়তে দেখা যায় অজিতকে।

মনুয়ার প্রেমিক এদিনও বিচারপতিকে জানিয়েছে যে, ‘যাকে খুনের অভিযােগে আড়াই বছর সাজা খাটছি, তাকে চোখেই দেখিনি। আমি নির্দোষ’।

প্রসঙ্গত , প্রায় দু’বছর আগে একটি বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থার কর্মী অনুপমকে তাঁর বাড়িতেই মাথা থেতলে নৃসংসভাবে খুন করা হয়। আর এই খুনের সময় মনুয়া তার বাবার বাড়িতে ছিল। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুকালীন আর্তনাদ নিজ কানে শােনার জন্য হত্যাকারী প্রেমিক অজিতকে তার ফোন অন করে রাখতে বলে খুনের সময়।

এরপর ফোনে স্বামীর আর্ত চিৎকার শুনেই তার মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হয় মনুয়া। আর এই ঘটনায় ব্যাপক হইচই পড়ে যায় গােটা রাজ্যে। পরকীয়ার কারণে স্ত্রীর এহেন নৃশংস আচরণে স্তম্ভিত হয়ে যায় সুশীল সমাজও।

ফলে, এই ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য সর্বস্তরের মানুষ দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবিতে সরব হয়। শেষে ঘটনার ১৩ দিন পর নিহতের স্ত্রী মনুয়া ও তার প্রেমিক অজিতকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, তাঁর মাথায় ভারী অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তাঁকে খুন করা হয়েছিল। খুনি হিসেবে প্রেমিক অজিতকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করতে পুলিশ সময় নেয় প্রায় দু’সপ্তাহ। কারণ পুলিশ তদন্তের বেশ কয়েকটি দিক ছিল, তবে অর্থ ভ্রমণসংস্থার কর্মী এবং আর্থিকভাবে অবস্থাপন্ন অনুপমের খুনের পেছন টাকাপয়সার প্রত্যক্ষ সংযােগ পুলিশ খুঁজে পায়নি।

তবে নােট বাতিলের সময় হুন্ডির সঙ্গে অনুপমের সংস্থার প্রত্যক্ষ যােগাযােগ ছিল বলে জানা গেলেও খুনের সঙ্গে এই বিষয়ের যােগসূত্র পাওয়া যায়নি।

খুনের সময় তাঁর স্ত্রী বাপের বাড়িতে থাকলেও ঘটনার দিন দুপুরে হৃদয়পুরে অনুপমের বাড়িতে অনুপমের অনুপস্থিতিতে অজিত-মনুয়া একসঙ্গে থাকা, স্বামীর এনগেজমেন্ট রিং অন্তর্ধানসহ একাধিক বিষয় পুলিশকে স্ত্রী মনুয়া ও অজিতের দিকে নজর ফেরাতে ও তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে বাধ্য করেছিল।

জানা যায়, মনুয়া ওই বাড়ি থেকে বারাসতে বাপের বাডি ফিরলেও থেকে গিয়েছিল অজিত। পুলিশ এই সূত্র ধরেই তদন্তের জাল গুটিয়ে আনতে থাকে। সূত্রের খবর, ছাত্র হিসেবে বা নাগরিক হিসেবে কোনওভাবেই মনুয়ার প্রেমিক অজিতের পরিচিত বা স্বচ্ছতা ছিল না।

মাধ্যমিক অনুত্তীর্ণ এবং অশােকনগর এলাকার বাসিন্দা অজিত ও মনুয়া দীর্ঘদিন ধরেই অনুপমের চোখ এড়িয়ে প্রেমটা বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছিল। হৃদয়পুর তালতলা এলাকার বাসিন্দা আদি বাংলাদেশের লােক অনুপম বাড়িতে না থাকলেই হাজির হত অজিত। বিষয়টি অনুপমের নজরে আসার পরে পথের কাটা অনুপমকে সরিয়ে দিতে মনুয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে অজিত চক্রান্ত করে ও সেইমতাে হত্যার রাতে ভারী অস্ত্র দিয়ে একাধিক আঘাত করে অজিত।

আরও একটি বিষয় তদন্তে বেরিয়ে আসে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল। তার উপরে প্রণয়ীর সঙ্গে সম্পর্কে বিধিনিষেধ জারির চেষ্টা। অনুপমের ওপরে প্রত্যাঘাত আসে নিষ্ঠুরভাবে। একটি দাঁতও অবশিষ্ট ছিল না মৃত শান্ত প্রকৃতির অনুপমের মুখে। পুরাে থেতলে দেওয়া হয় তাঁকে।

আততায়ী যাওয়ার আগে শুধু নিয়ে যায় তাঁর মনুয়াকে দেওয়া স্মারক আংটি, যা নিহতের আঙুলে শােভা পাচ্ছিল, যার ফলে পুলিশের সন্দেহ ঘনীভূত হয় তৃতীয় ব্যক্তি ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে ঘিরে।

তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, খুনের সময় স্ত্রী মােবাইলে অনলাইনে ছিল ও স্বামীর শেষ আর্তনাদ নিজের কানে শুনেছে।

অভিযুক্ত দুজনকেই নেওয়া হয় পুলিশি হেফাজতে। অবশেষে হত্যার ৮৬ দিন পরে চার্জশিট জমা দেয় বারাসত থানার তদন্তকারী পুলিশ। এর মধ্যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ফরেন্সিক রিপাের্টও ছিল। ৩০২ ও ১২০বি ধারায় খুন ও ষড়যন্ত্রের মামলা চলে। ২৭ জন সাক্ষী ছিলেন। ৪৬৯ পাতার চার্জশিটের পরে আবার জমা পড়ে সাপ্লিমেন্টারি শিট।

এই দীর্ঘ শুনানির পর বৃহস্পতিবার বারাসত ফাস্ট ট্রাক আদালতের বিচারপতি উভয়কে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ও ১২০বি ধারা মেনে খুনের অভিযােগে দোষী সাব্যস্ত করেন। এবং শুক্রবার তাদের যাবজ্জীবনের সাজা ঘােষণা করে আদালত।

যদিও আদালতের এই রায়ে মােটেও খুশি নন নিহত অনুপম সিংহের পরিবার। তারা এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন।