ভোটব্যাঙ্কে আঁধার কাটিয়ে আলো জ্বালাতে খড়গপুরে নীরব বিপ্লব চায় তৃণমূল

শুভেন্দু অধিকারী (Photo: Twitter/@AITCofficial)

শুরুটা টেস্টম্যাচের ঢঙে হলেও আসলে টি টোয়েন্টির মেজাজে খড়গপুর সদর বিধানসভার উপনির্বাচন ম্যাচ খেলতে চায় শাসকদল তৃণমূল । হাতে আর সময় বেশি নেই। ফলে আর দেরি না করে অনেকটা টি টোয়েন্টির মেজাজে খেলে ম্যাচ পকেটে পুরার জন্য ক্রমশ মরিয়া হচ্ছে রাজ্যের শাসকদল।

এই বিধানসভা আসনটি নিজেদের পকেটে পুরতে তৃণমূল কতটা মরিয়া তা অবশ্য বাইরে থেকে দেখলে বােঝার কোনও উপায় নেই। কিন্ত শাসকদলের অন্দরে কান পাতলেই এই ম্যাচের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বিধানসভা আসনটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে তৃণমূল সুপ্রিমাে তাঁর অন্যতম সেরা সৈনিককে মাঠে নামিয়েছেন। ফলে সদ্য শেষ হওয়া লােকসভা নির্বাচনে খড়গপুর সদরে ৪৫ হাজারেরও বেশি পিছিয়ে পড়া আসনটিও রাজ্যের শাসকদলের কাছে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে।

এর আগে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিকে দলের অনুকুলে নিয়ে এসে যিনি নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছে রাজ্যমন্ত্রিসভার তিন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী সেই শুভেন্দু অধিকারীর সাংগঠনিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করে এই আসনটিতে ভালফল শুধু করাই নয়, যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন দেখছে তৃণমূল।


ইতিমধ্যে খড়গপুর সদর বিধানসভা উপনির্বাচনে জয় পাওয়ার জন্য নীল নকশা তৈরি করে ফেলেছে তৃণমূল। বুথ ভিত্তিক সংগঠন মজবুত করতে উপনির্বাচনের দিনক্ষণ ঘােষণার আগে থেকেই দলীয় পর্যবেক্ষক নিয়ােগ করে নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার করা। সেই সঙ্গে খড়গপুর সদর বিধানসভার খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করা যাবতীয় যা সবকিছুই করছেন শুভেন্দুবাবু দলীয় এবং নিজস্ব সাের্সকে কাজে লাগিয়ে।

ব্যস্ততার কারণে সর্বক্ষণ সশরীরে খড়গপুরে উপস্থিত থাকা শুভেন্দুবাবুর পক্ষে সম্ভব না হলেও মােবাইল ফোনের মাধ্যমে যাবতীয় পরামর্শ, নির্দেশ তিনি দিয়েই চলছেন। খালি চোখে দেখলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে বেশ কয়েকটি কৌশলের উপর নির্ভর করে এই কেন্দ্রে ঝাপাতে চাইছে রাজ্যের শাসকদল।

প্রথমত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যজুড়ে য়ে উন্নয়ন করেছেন সেইসঙ্গে খড়গপুর সদর বিধানসভার উন্নয়ন মানচিত্রে যে পরিবর্তন এনেছেন উন্নয়নের সেই কাহিনীকে সামনে রেখে খড়গপুর সদরে (মিনি ইন্ডিয়া) যুদ্ধজয় সুনিশ্চিত করতে চান শুভেন্দু অধিকারী। নিজের ব্যক্তিগত ইমেজ, সাংগঠনিক ক্ষমতা সেই সঙ্গে মানুষের সঙ্গে নিবিড় যােগাযোগকে মূলধন করে খড়গপুর সদর বিধানসভার বহু ভাষাভাষীর মন ছুঁতে চান শুভেন্দু অধিকারী।

এক্ষেত্রে শুভেন্দুর দেখানাে পথেই অনেকটা নির্বাচনী প্রচার সারছেন তৃণমূল প্রার্থী। যদিও এই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী প্রদীপ সরকারকে জয়ের দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে দিতে ভােটকুশলী প্রশান্ত কিশােরের টিমের লােকজন রয়েছেন।তাঁরাও ঘাঁটি গেড়েছেন খড়গপুরে। বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পিকের লােকজন তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে। রীতিমতাে কর্পোরেট কায়দায় চলছে এই প্রচার। পিকের টিমের এই প্রচার অবশ্য মনিটরিং হচ্ছে। কলকাতা থেকে নির্বাচনী প্রচারের শুরুতে পিকের টিমের লােকজনের সঙ্গে স্থানীয় তৃণমুল নেতৃত্বের তাল-মিলের অভাব হলেও ধীরে ধীরে সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।

এদিকে অন্য আরও বেশ কয়েকটি কৌশল চোখে পড়ছে শাসকদলের। শুভেন্দু অধিকারী পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শাসকদলের সব শীর্ষস্তরের নেতাদের খড়গপুর সদরে বিধানসভা উপনির্বাচনের প্রচারে নামিয়ে দিয়েছেন। তারফলে খড়গপুর সদরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একাধিক সভা তৃণমূল প্রার্থীর সমর্থনে চলছে। সেই সঙ্গে তিনি নিজে গিয়েও সভা করছেন।

শনিবার রাতে বুলবুলে কোথায় কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার নজরদারি শুভেন্দুবাবু করেছেন রাত জেগে। সকালে দিনের আলাে ফুটতে না ফুটতেই পুর্ব মেদিনীপুর জেলায় বুলবুল প্রভাবিত অঞ্চল যে সব এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি সেখানে ছুটে গিয়েছেন। তারপর সন্ধেতে খড়গপুরে মথুরাকাটি এবং পরে ইন্দায় তৃণমূল প্রার্থীর সমর্থনে সভা করেন শুভেন্দু।

বুলবুলের কারণে শুভেন্দুর নির্বাচনী প্রচারে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ২৪ ঘন্টার কম সময়ের মধ্যে খড়গপুর শহরে শুভেন্দুবাবুর দুটি নির্বাচনী সভার আয়ােজন করা হয়। দুপ্রান্তের দুটি নির্বাচনী সভাতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। এই দুটি সভাতে বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা খড়গপুর সদরের প্রাক্তন বিধায়ক বর্তমান মেদিনীপুর লােকসভার সাংসদ দিলীপ ঘােষকে তীব্র আক্রমণ করেন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। খড়গপুরের বিজেপির প্রাক্তন বিধায়ক দিলীপ ঘােষকে সবচেয়ে অপদার্থ বিধায়ক বলেও মন্তব্য করেন শুভেন্দু। তৃণমূল কংগ্রেসের এই শীর্ষ নেতার মন্তব্য খড়গপুর সদর বিধানসভা উপনির্বাচনের প্রচারে পারা বাড়িয়ে দিয়েছে।

একদিকে নির্বাচনী প্রচারে ধার বাড়িয়ে জনগণকে শাসকদলের পক্ষে প্রভাবিত করা, দলীয় কর্মীদের হতাশা কাটিয়ে তাদেরকে উদ্যমী করা আর অন্যদিকে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে অঙ্ক কষে প্রতি বুথে কীভাবে ভােটব্যাঙ্কে লিড পাওয়া যায় তার রণকৌশল ছকছেন শুভেন্দু। যদিও অতীত অভিজ্ঞতা বলছে এই অঙ্কে রাজ্যে শুভেন্দু অধিকারীর জুড়ি মেলা ভার। মুর্শিদাবাদ জেলার লােকসভা নির্বাচনের ফলাফল তৃণমূলের অনুকুলে আসাটা বর্তমান সময়ে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

লােকসভা নির্বাচনের নিরিখে বিজেপির কাছে ৪৫ হাজারেরও বেশি ভােটে পিছিয়ে পড়া আসনে জয় নিশ্চিত করতে অনেক কঠিন অঙ্ক সহজ করতে খড়গপুর শহরে বসে নয়, পূর্ব মেদিনীপুর, কখনও মালদা, মুর্শিদাবাদ জেলায় বসে ঠান্ডা মাথায় অঙ্ক কষছেন শাসকদলের এই হেভিওয়েট নেতা।

শুভেন্দু অঙ্কিারীর ঘনিষ্ঠমহলে কান পাতলে একটা কথা প্রায়ই শােনা যায়, দাদা যদি কোনও কাজের দায়িত্ব নেন। সেই কাজ সফল করার জন্য চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেন না। নিজেই জনসংযােগ করতে ভালবাসেন। প্রচন্ড পরিশ্রমী। পারফরমেন্সই করেই দাদা নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছেন। সেই ধারাই অক্ষুন্ন রাখার জন্য দাদা যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। এটাই শুভেন্দু অধিকারীর ক্যারিশ্মা। সহজাত এই ক্ষমতাই শুভেন্দু অধিকারী জনপ্রিয় করেছে বাংলা জুড়ে। সে কারণেই তৃণমূল সুপ্রিমাে তাঁর দলের অন্যতম এই বিশ্বস্ত সৈনিকটির উপর গুরু দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। শুভেন্দুকে দায়িত্ব দেওয়া মানে ও কিছু করে দেখাবে। তৃণমূল সুপ্রিমোর এই অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস তৃণমূল কংগ্রেসের এই হেভিওয়েট নেতার মনােবল বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই বাড়তি মনােবলকেই সঙ্গে করেই পিছিয়ে পড়া আসনে যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে তৃণমূলের কাছে। যদিও বিজেপির রাজ্যসভাপতি তথা খড়গপুর বিধাসভার প্রাক্তন বিধায়ক দিলীপ ঘােষ তৃণমূল কংগ্রেসকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে নারাজ। খড়গপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে দিলীপ ঘােষকে সবচেয়ে অপদার্থ বিধায়ক বলার জবাবও শুভেন্দুকে দিলীপ ফিরিয়ে দিয়েছেন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। খড়গপুর সদরে মানুষকে শুভেন্দুবাবু এখনও ঠিকমতাে চেনেন না। বিধায়ক হিসেবে দিলীপ ঘােষ কি কাজ করেছে তা খড়গপুরের মানুষ ভাল ভাবে জানে। সে কারণে খড়গপুরে পর তিনটি নির্বাচনে মানুষ বিজেপিকে সমর্থন করেছে। এই নির্বাচনের পরে শুভেন্দুবাবু বুঝবেন সত্যিকারের অপদার্থ কে বা কারা।