• facebook
  • twitter
Sunday, 13 October, 2024

প্রশান্ত কিশােরের ফর্মুলায় ২০০ কেন্দ্রে তৃণমূলের নতুন মুখের সম্ভাবনা

প্রাথমিকভাবে কাজ করছে প্রশান্ত কিশােরের টিমে। এছাড়া স্থানীয় পেশাদারি বেশ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে গাটছড়া বেঁধেছে প্রশান্ত কিশােরের ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি।

প্রশান্ত কিশাের (File Photo: IANS)

এ রাজ্যে প্রশান্ত কিশােরের পথ চলা শুরু হয়েছে ৬ জুন। এক মাসও অতিক্রান্ত হয়নি, তার মধ্যে জঙ্গলমহলের জেলাগুলি থেকে কী কারণে তৃণমূল কংগ্রেসের ভােট ব্যাঙ্কে ধস, তার রিপাের্ট ইতিমধ্যেই চলে এসেছে প্রশান্ত কিশােরের কাছে ৪০০ জন।

প্রাথমিকভাবে কাজ করছে প্রশান্ত কিশােরের টিমে। এছাড়া স্থানীয় পেশাদারি বেশ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে গাটছড়া বেঁধেছে প্রশান্ত কিশােরের ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি। একেবারে তৃণমূল স্তরে গিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে এই স্ট্যাটিসটিক্স সংস্থার ছদ্মবেশী তরুণ-তরুণীরা।

তাঁদেরকে প্রথমেই বলা হয়েছে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার জন্য। কোনও ধরনের নেতা কিংবা দলের দিকে ঝুঁকে যেন কাজ না করেন। প্রকৃত বাস্তব চিত্রটা তুলে আনতে হবে বাংলার বুক থেকে। যাঁদের সঙ্গে প্রশান্ত কিশােরের সংস্থার গাঁটছড়া বেঁধেছে তাদেরকে সাফ বলা হয়েছে, তাঁরা যে রিপোর্ট পাঠাচ্ছে, সেই তথ্য সঠিক কিনা, তা যাচাই করে দেখবে প্রশান্ত কিশােরের নিজস্ব টিম।

প্রাথমিকভাবে দেড় থেকে দু’মাসের চুক্তিতে শাখা সংস্থাগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে আই-পাক। তারপর পারফরমেন্স চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তবেই তাদের পরবর্তী ক্ষেত্রে কী করতে হবে, তা জানিয়ে দেওয়া হবে। ভুল তথ্য পরিবেশন করলে তাঁদের সঙ্গে চুক্তি পুনর্নবীকরণ করা হবে না, এমনটাই জানা যাচ্ছে।

প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছে, এলাকা ধরে ধরে কোন নেতার জনপ্রিয়তা বেশি, মানুষ কী চায়, কী হলে সমাজের ভালাে হবে এরকম নানাবিধ তথ্য তুলে আনতে হবে। সে অর্থে কোনও ক্যাটাগরি ঠিক করে দেওয়া হয়নি স্থানীয় সংস্থাগুলিকে।

জঙ্গলমহলে এত উন্নয়ন সত্ত্বেও কেন মানুষের মন পেল না তৃণমূল তার বিশদ বিবরণ ইতিমধ্যে রিপাের্টে উঠে এসেছে বলে জানা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে শাসক নেতাদের আর্থিক স্ফীতি সেইসঙ্গে অজপাড়াগাঁয়ে কিংবা স্থানীয় শহরের বুকে দোতলা-তিনতলা পাকাবাড়ি এবং সেই সঙ্গে গাড়ি সাধারণ মানুষ ভালােভাবে নিচ্ছে না। এই তথ্যও উঠে এসেছে জঙ্গলমহলের জেলাগুলি থেকে।

কোন কোন নেতার জন্য দলের ভাবমুর্তি খারাপ হয়েছে, কিন্তু সেই নেতার জন্য তৃণমূলকে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে, সেই তথ্যও এই স্ট্যাটিসটিক্স সংস্থার হাতে বিশ্বস্ত সূত্রে এমনটাই জানা গিয়েছে।

বাড়ির গােয়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছে এসইউভি গাড়ি, যা দেখে এলাকার মানুষের চক্ষু চড়কগাছ! রাতারাতি এই আর্থিক স্ফীতি শাসক দলের নেতাদের একাংশের ভাবমূর্তি তৃণমূলকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।

আগামী দিনে সংস্থার রিপাের্টের উপর ভিত্তি করে খােলনলচে শাসক দল তাদের সংগঠনে বদলে দেবে, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ঠিক যেমনটি জঙ্গলমহলের বিশেষত ঝাড়গ্রাম জেলা এবং পুরুলিয়া জেলায় তৃণমূলের সংগঠনে বদলে দেওয়া হয়েছিল।

লােকসভা নির্বাচনের আগে ঝাড়গ্রাম ব্লকের সব ব্লক সভাপতিকে সরিয়ে নতুন মুখ আনা হয়েছিল। অনেকটাই ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে পেরেছিল তৃণমূল। কিন্তু গড়বেতায় ভালাে ফলাফল হওয়ায় ঝাড়গ্রাম লােকসভা কেন্দ্রটি তৃণমূলকে হারতে হয়। ২০২১-এর কথা মাথায় রেখে শীর্যস্তর থেকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সংগঠন ও সেই সঙ্গে মন্ত্রিসভায় বড়সড় রদবদলের পথে হাঁটতে পারে তৃণমূল। 

২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের ১২৮টিতে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে লােকসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে। চায়ের কাপের সঙ্গে ঠোটের যে পার্থক্য, রাজ্যের ক্ষমতা পাওয়ার স্বাদ থেকে এতটাই দূরত্বে রয়েছে বিজেপি, এমনটাই দাবি করছেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস একথা মানতে নারাজ।

তবে তৃণমূলের থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে প্রশান্ত কিশােরের উপস্থিতি বেশ কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে বিজেপিকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজেপি’র শীর্ষনেতার কথায়, প্রশান্ত কিশােরের মুকুটে সাফল্যের ভাগ যথেষ্ট রয়েছে। তবে এটাও ঠিক, অসফলতাও রয়েছে। প্রশান্ত কিশাের যে যে পরামর্শগুলি তৃণমূলকে দেবে, তার যদি ৭৫ শতাংশও শাসক দল মেনে চলে, আখেরে লাভ হবে তৃণমূলেরই।

আগামীর কথা ভেবে খুব দ্রুত বড়সড় রদবদলের পথে হাঁটতে পারে তৃণমূল। ঝাকুনি দেওয়া হতে পারে দল এবং প্রশাসনের সর্বস্তরে। বিশেষত, যারা জনপ্রতিনিধির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েও জনসংযােগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছেন।

২০২১-এ ২০০টি বিধানসভা কেন্দ্রে শাসক দলের হয়ে নতুন মুখ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, এমনটাই খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে এত বড় ঝুঁকি তৃণমূল শেষ পর্যন্ত নেবে কিনা, তা সময়ই বলবে।

সেই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মও যাঁরা দলে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন, মানুষ চায় এমন অনেককেই শাসকদলের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হওয়ার জন্য পরামর্শ যাচ্ছে শাসকদলের কাছে। ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৃণমূল যাতে একসঙ্গে বিরােধীদের কীভাবে মােকাবিলা করতে পারে, তা নিয়েও আলােচনা চলছে।

সম্প্রতি কাটমানি ইস্যু থেকে শুরু করে বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলােচনা করার যে প্রবণতা তৃণমূল সুপ্রিমাে দেখাচ্ছেন, তার নেপথ্যেও প্রশান্ত কিশােরের পরামর্শ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে চাকরির ক্ষেত্রে শুন্যপদগুলি পূরণ করার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে রাজ্য সরকারের তরফে।

আগামীতে এই ধরনের পদক্ষেপ তৃণমূলের পক্ষেই যাবে, এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ। এক ব্যক্তি এক পদ এই নীতি চালু করা যায় কিনা তা নিয়েও ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে। আরও অনেককে সুযােগ করে দিতে পারলে অনেকেই নতুনভাবে তৃণমূল করার উৎসাহ পাবে।

ইতিমধ্যে প্রশান্ত কিশােরের টিমের পক্ষ থেকে বাংলায় একটি ফর্ম সােশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আপনি রাজনীতিতে ইচ্ছুক কিনা, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বয়স, শিক্ষাগত যােগ্যতা এবং বয়সেরও একটা নির্দিষ্ট মাপকাঠি ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।

প্রশান্ত কিশাের তৃণমূলের হয়ে কাজ করলেও এই ফর্মে কোথাও বলা নেই তৃণমূলের কথা। যদি আপনি নিজেকে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে যুক্ত করতে চান, সৎভাবে কাজ করতে চান, তাহলে ফর্মটি পূরণ করে পাঠিয়ে দিন।

ফলে যিনি ফর্ম পূরণ করবেন, তিনি তৃণমূল করবেন, নাকি অন্য কোনও দল করবেন, তা পরবর্তী ক্ষেত্রে বিবেচিত হবে। এই ভাবে বাংলার তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে আনতে প্রশান্ত কিশাের সােশ্যাল মিডিয়াকে আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

এদিকে কাটমানি নিয়ে যে বিক্ষোভ সংক্রামিত হচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়, তার নেপথ্যে সত্যিই সাধারণ মানুষ আছে, নাকি বিজেপি এটি পরিকল্পিত করে করাচ্ছে, তার উপর নজর রেখেছে প্রশান্ত কিশােরের টিম।

এমনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, শাসকদলের এক গােষ্ঠী অন্য গােষ্ঠীর বিরুদ্ধাচারণ করছে বলে খবর মিলেছে। এমনকি, সম্প্রতি এক মন্ত্রীর বাড়ির সামনে কাটমানি নিয়ে অবস্থানে বসল বিজেপি। স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব এই অবস্থানে খুব একটা শামিল হয়নি। বিজেপির অন্য গােষ্ঠী এই কাজ করেছে বলে জানা যাচ্ছে।

গ্রামাঞ্চল কিংবা জেলাগুলির মধ্যে কাটমানি ইস্যুকে নিয়ন্ত্রিত না রেখে এবার কলকাতায় আনার যে পরিকল্পনা বিজেপি গ্রহণ করেছে, তার পিছনেও রয়েছে অন্য অঙ্ক। কারণ, গ্রাম কিংবা জেলা অশান্ত হয়ে উঠলে বিজেপি যে লাভবান হবে এমন কোনও কথা নেই। তৃণমূলও তার হারানাে জায়গা পুনরুদ্ধার করতে পারে। কারণ কাটমানি ইস্যু নিয়ে যা চলছে, তা এই কর্পোরেট সংস্থার দেওয়া পরামর্শ এমনটাই মনে করা হচ্ছে।

তৃণমূলের এই পাতা ফাঁদে বিজেপি পা না দিয়ে এবার একটু অন্য পথ অনুসরণ করতে চলেছে। আসলে, বর্তমানে শাসক দল যখনই কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ করছে অন্য পথে গিয়ে, তার পিছনে কর্পোরেট সংস্থার পেশাদারিত্বের ছোঁয়া রয়েছে বলে অনেকে মনে করছে।

বর্তমানে যাঁরা জনপ্রতিনিধি রয়েছেন শাসক দলের পক্ষ থেকে শীর্ষস্তর থেকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত তাঁদের বায়ােডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে তাঁদের নৈতিক চরিত্র, তাঁরা আর্থিকভাবে কতটা ক্ষমতাবান হয়েছেন ২০১১ থেকে ২০১৯ এই সময়সীমার মধ্যে তারও তথ্য সংগ্রহ করার কাজ প্রায় শেষের দিকে।

এছাড়া অবৈধ বালিখাদান, কয়লা, গরুপাচার এইসব কাজে কারা কারা জড়িত, তাদের কার কার জন্য তৃণমূলের ভােটব্যাঙ্কে প্রভাব পড়েছে, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সব মিলিয়ে ঠিক পুলিশের চিরুনি তল্লাশির মতাে তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যায়ক্রমে শাসক দলের কাছে রিপাের্ট পেশ করবে এই পেশাদারি সংস্থা। সেই সঙ্গে কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়, তাও বলে দেওয়া হচ্ছে। এলাকাভিত্তিক রিপাের্টও থাকছে।

সব মিলিয়ে প্রশান্ত কিশােরের সেই রিপাের্ট যদি শাসক দল অধিকাংশটা মেনে নেয়, তাহলে সংগঠন ও মন্ত্রিসভায় বড়সড় পরিবর্তন আগামীতে সময়ের অপেক্ষা, এমনটাই জানা যাচ্ছে।