ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ার এনুমারেশন ফর্ম পূরণের প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। রাজ্যে শুরু হয়েছে শুনানির প্রথম পর্যায়ের প্রক্রিয়া। ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় রয়েছে নাম, এনুমারেশন ফর্মও পূরণ করেছেন কিন্তু তারপরেও শুনানিতে ডাকা হচ্ছে একাধিক ভোটারকে। এই শুনানিতে ডাক পাওয়ার পরেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ফের আত্মঘাতী হচ্ছেন অনেকেই।
সোমবার হাওড়া, পুরুলিয়া ও নদিয়ার মতো জেলাগুলিতে শুনানির আতঙ্কে একাধিক ভোটারের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। পুরুলিয়ার বাসিন্দা ৮২ বছরের বৃদ্ধ দুর্জন মাঝি ও হাওড়ার বাসিন্দা বছর ৭০-এর শেখ জামাত আলি ও নদিয়ার জহরলাল মাহাতোর মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। আর তারপর থেকেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক জল্পনা। ঘটনা নিয়ে সরব হয়েছে রাজ্যের শাসক দল।
২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম ছিল আনাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের চৌতালা গ্রামের বাসিন্দা দুর্জন মাঝির। যথাযথভাবে এনুমারেশন ফর্মও ফিল আপ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরও শুনানির ডাক আসায় হতাশাগ্রস্ত ছিলেন দুর্জন। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছিলেন না বলেও জানায় তাঁর পরিবার। সোমবার সকালে এই শুনানির জন্য বাড়ি থেকে বের হন তিনি। কিন্তু তারপর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন ওই বৃদ্ধ।
খোঁজ শুরু করতেই আদ্রা ডিভিশনের আনাড়া-রুকনি শাখায় চৌতলা গ্রামের অদূরে ট্রেনে কাটা বৃদ্ধের দেহ উদ্ধার করা হয়। বৃদ্ধের ছেলে কানাই মাঝির দাবি, শুনানির ভয়েই বাবা আত্মহত্যা করেছেন বলে তিনি মনে করেন।
এরপরেই বৃদ্ধের মৃত্যুর জন্য নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করে বিক্ষোভ শুরু করেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বরা। স্থানীয় বিডিওকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।
খবর পেয়ে বৃদ্ধের বাড়িতে যান তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি কিরীটি আচার্য, প্রাক্তন তৃণমূল নেতা শান্তিরাম মাহাতো, জেলা পরিষদের সভাধিপতি নিবেদিতা মাহাতো সহ তৃণমূলের জেলা ও ব্লক নেতৃত্ব। পুরুলিয়ার পাশাপাশি শুনানির নোটিস পাওয়ার পরে দেশছাড়ার আতঙ্কে ভুগছিলেন ৭০ বছর বয়সী হাওড়ার বাসিন্দা শেখ জামাত আলিও। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই হাওড়ায় পরিবারের সঙ্গে বাস করেন ওই বৃদ্ধ। পরিবারের অভিযোগ, ৫০ বছর ধরে ভোট দিয়েছেন বৃদ্ধ জামাত আলি। কিন্তু নাম ছিল না ২০০২ সালের ভোটার তালিকায়।
আর এরপরেই রবিবার স্থানীয় বুথের বিএলও বৃদ্ধকে জানান যে তাঁকে শুনানিতে যেতে হবে। শুনানির ডাক পেতেই দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে বলে ভয় পাচ্ছিলেন তিনি। বৃদ্ধের পুত্রবধূ জানান, শুনানিতে যেতে হবে শুনে বৃদ্ধ বারবার তাঁকে বাংলাদেশে যেতে হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকেন। আর এরপরেই রবিবার গভীর রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় বৃদ্ধার। ঘটনাকে ঘিরে এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।
সোমবার শুনানিতে হাজিরা দেওয়ার পরে মৃত্যু হয়েছে নদিয়ার বাসিন্দা এক ভোটারের। কল্যাণী বিধানসভার কাঁচরাপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বছর ৭২-র বাসিন্দা জহরলাল মাহাতো। অভিযোগ, ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম থাকার পরেও শুনানিতে ডাক পড়ে তাঁর। তারপরেই সোমবার অসুস্থ শরীর নিয়ে বৃদ্ধ শুনানিতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপরেই মৃত্যু হয় তাঁর।
রাজ্যে শুনানি প্রক্রিয়া শুরু হতেই একাধিক জেলায় মৃত্যুর খবর মিলছে। কেউ আতঙ্কে আত্মহত্যা করছেন। আবার কেউ ভয়ে, আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছেন। এসআইআর শুরুর পর থেকেই ভোটার থেকে শুরু করে কাজের অতিরিক্ত চাপের জেরে বিএলও-রা আত্মহত্যা করেছেন। এবার শুনানি প্রক্রিয়া শুরু হতেই সেই একই চিত্র দেখা যাচ্ছে জেলায় জেলায়।
এসআইআর প্রক্রিয়া ঘিরে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় রাজ্যজুড়ে উদ্বেগ বাড়ছে। শুনানি, নোটিস ও প্রশাসনিক চাপ সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের জীবনেও যে গভীর প্রভাব ফেলছে, এই ঘটনাগুলি তারই করুণ উদাহরণ হয়ে উঠছে। ভোটার তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও, এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করার পরেও কেন ভোটারদের শুনানি প্রক্রিয়ায় ডেকে কেন হেনস্থা করা হচ্ছে তা নিয়ে সরব হয়েছে তৃণমূল। এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও জানিয়েছে রাজ্যের শাসক দল।