সংঘের নজরদারিতে ‘তৎকাল নেতা’দের বাড়বাড়ন্ত, দলে শুরু ঠান্ডা লড়াই

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

বঙ্গ বিজেপির ভেতরে নব্য নেতাদের দাপট কি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছে? আর সেই কারণেই কি বিরক্ত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ? দলের পুরনো শিকড় উপেক্ষা করে নতুন নেতাদের হাতে সংগঠনের রাশ চলে যাওয়ায় আরএসএসের অস্বস্তি ক্রমেই প্রকট হচ্ছে বলে রাজনৈতিক অন্দরের দাবি। সেই জল্পনাকে আরও বাড়িয়ে দিল সংঘের ইংরেজি মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি নিবন্ধ। সেখানে নাম না করে শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারদের পরোক্ষে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, বঙ্গে বিজেপির যে আজকের সাংগঠনিক শক্তি, তা একমাত্র ‘তৎকাল’ নেতাদের কৃতিত্ব নয়; এর ভিত স্থাপন করা হয় জনসংঘের যুগে। আরএসএসের প্রাথমিক সংগঠন বিস্তারের হাত ধরেই।

নিবন্ধে বলা হয়েছে, রাজ্যে বর্তমানে রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রকট। ক্রমেই তৃণমূল ও বিজেপির সংঘাত বাড়ছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, বঙ্গে বিজেপির শিকড় বহু পুরোনো। সেই ইতিহাস তুলে ধরতেই উল্লেখ করা হয়েছে বঙ্গ বিজেপির মহীরুহদের—শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আচার্য দেবপ্রসাদ ঘোষ, হরিপদ ভারতী, তপন শিকদার, বিজয় কুমার মণ্ডল— অনেকে জনসংঘের সময় থেকেই বাংলায় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভিতকে শক্ত করেছেন। মেদিনীপুর যাকে এখন শুভেন্দু অধিকারীর ‘গড়’ বলা হয়, সেখানেই জনসংঘের সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন দুর্গাচরণবাবু। এই তালিকা উল্লেখ করেই সংঘের বার্তা, দলের আজকের এই অবস্থান বহু পুরনো ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এখন প্রশ্ন উঠছে, হঠাৎ এই বার্তা কেন? এটা কি নব্য নেতাদের উদ্দেশে প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি? নাকি বিজেপির ‘স্বনির্ভরতা’-র জোরালো দাবি সত্ত্বেও সংঘ বোঝাতে চাইছে যে, তাদের সহযোগিতা ছাড়া বঙ্গে টিকে থাকা কঠিন?


কয়েক মাস আগে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা বলেছিলেন, দল এখন ‘প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ’, সংঘের দৈনন্দিন হস্তক্ষেপ দরকার নেই। কিন্তু লোকসভার ফলাফল দলের ভিতরের করুণ অবস্থা প্রকাশ্যে এসেছে, বাংলা থেকে দেশজুড়ে আরএসএসের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ‘অর্গানাইজার’-এর এই নিবন্ধকে অনেকেই সংঘের পরোক্ষ সতর্ক বার্তা বলেই মনে করছেন।

তৃণমূল অবশ্য এটাকে সরাসরি শুভেন্দু অধিকারীদের বিরুদ্ধে বড় ধাক্কা হিসেবেই দেখছে। দলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘এটা শুভেন্দুকে কার্যত রেড কার্ড দেখানো। নব্য নেতাদের দাপটে পুরনো নেতারা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আরএসএস এবার সেটা প্রকাশ্যে বুঝিয়ে দিল।’

সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলছেন, ‘গোটা দেশেই আরএসএসের মনোভাবেই বিজেপি চলে। বাংলার বিজেপি আবার তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের নিয়ে এক আলাদা ধান্দাবাজির রাজনীতি যোগ করেছে। ফলে সংঘ ও বিজেপির মধ্যে ঠান্ডা লড়াই যে চলছে, তা স্পষ্ট।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, বিজেপি কি বিজেপি হওয়ার চেয়ে বেশি তৃণমূল হয়ে যাচ্ছে?

একে কংগ্রেসও আরএসএস এবং বিজেপিকে আলাদা করে দেখতে নারাজ। প্রদেশ কংগ্রেস মুখপাত্র অশোক ভট্টাচার্য মন্তব্য করেন, ‘আমাদের কাছে আরএসএস-বিজেপি একই ধারা। সেই বিভাজন আর ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই।’

বিজেপির পুরনো নেতৃত্ব এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও দ্বন্দ্বের কথা অস্বীকার করেছে। দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা বলেন, ‘বাড়ির ছাদ যেমন ভিত ছাড়া হয় না, তেমনই ভিত আর ছাদ— দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। সকলের মিলিত পরিশ্রমে বিজেপি আজকের জায়গায় এসেছে।’

তবে রাজনৈতিক মহলের মতে, সংঘের এই বার্তা স্পষ্ট, নব্য নেতাদের ইগো ও একক নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা আরএসএসের পছন্দ হয়নি। আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই অন্তর বিরোধ দলকে কতটা চাপে ফেলে, এখন সেটাই দেখার।