জনবিজ্ঞান আন্দোলনের এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ মজুমদার

Written by SNS March 31, 2024 1:00 pm

নিত্যানন্দ ঘোষ

পশ্চিমবঙ্গে গণবিজ্ঞান আন্দোলনের ধারা তৈরি হয়ে যায় নকশাল আন্দোলনের ভাটার পর্বে জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর৷ এই পর্বেই নকশাল আন্দোলনে যুক্ত থাকা বা না থাকা বেশ কয়েকজন কৃতী ব্যক্তি বা বামপন্থী দলে যুক্ত থাকা গোষ্ঠী গণবিজ্ঞান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন৷ তাঁদের বেশ কয়েকজন যুক্তিবাদী, কুসংস্কার-বিরোধী অবস্থান বজায় রেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা ও বিজ্ঞান মানসিকতা গড়ে তুলতে বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন মাতৃভাষায় (এক্ষেত্রে বাংলা ভাষায়)৷ মনে রাখতে হবে, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তি ছিলেন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু৷ তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান পরিষদও গড়ে ওঠে৷ যে প্রতিষ্ঠান তাঁরই ভাবধারায় আজও গণবিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে৷ ১৯৭৭ পরবর্তী পর্যায়ে বা ওই সময় যাঁরা হাতেকলমে বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ কিংবা কুসংস্কারবিরোধী ও যুক্তিবাদী মননে গণবিজ্ঞান আন্দোলনের প্রসার ও প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন সমর বাগচি, অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ মজুমদার, মনীন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, সুজয় বসু, সিদ্ধার্থ ঘোষ, ভবানীপ্রসাদ সাহু, প্রবীর ঘোষ, অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ৷ এঁদের অনেকেই আজ প্রয়াত৷ সমরদা ২০২৩-এ, অশোকদা ২০০৮-এ এবং রবীনদা এই বছর মাসখানেক আগে প্রয়াত৷

এই আলোচনা সদ্যপ্রয়াত রবীন্দ্রনাথ মজুমদারকে নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকছে৷ অশোকদার আগে রবীনদা বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৯৭৭-র জুলাই মাসে৷ অশোকদা শুরু করেন ১৯৮০ সালে৷ প্রথমজন ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’ ও অশোকদা ‘মানুষ’ (১৯৮১ ‘উৎস মানুষ’ নামে রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পরে)৷ বলতে দ্বিধা নেই ‘উৎস মানুষ’ প্রচার ও প্রসারে অনেকটাই এগিয়ে ছিল ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’র থেকে৷ অশোকদা ‘উৎস মানুষ’-এর একটা গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন যাঁরা প্রত্যেকে দ্বিগুণ উৎসাহে পত্রিকার প্রকাশ ও প্রচার প্রসারে উদ্যোগী ছিলেন৷ এমনকী গোষ্ঠীর মধ্যে না থেকেও ১৯৮০-র শুরুর দিকে লিটল ম্যাগাজিন অন্তপ্রাণ বন্ধু চন্দন ঘোষ (প্রয়াত) ও এই প্রতিবেদক ময়দানের বইমেলাতেও ‘উৎস মানুষ’ ভালোবেসে বিক্রি করেছে৷ রবীনদাকে সেভাবে সাহায্য করার কেউ ছিলেন না৷ একমাত্র সত্য (পদবি মনে নেই) ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’র অন্যতম রবীনদার সহযোগী ছিল৷ বন্ধু সত্যের ১৯৯০-র দশকেই অকালপ্রয়াণও হয়৷ সে কাজ করত পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফে, ডালহৌসিতে৷ একই সঙ্গে রবীনদার সঙ্গে ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’ পত্রিকাও করত৷

দ্বিমাসিক পত্রিকাটি রবীনদা প্রথম পর্বে ১৯৭৭-র জুলাই থেকে জুন ১৯৮৩ পর্যন্ত প্রতি বছর ছয়টি করে সংখ্যা নিয়মিত বের করেছেন৷ কিন্ত্ত ১৯৮৩-তে বের করেছেন মোট ৫টি সংখ্যা— সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর একটি যুগ্ম সংখ্যা ধরে৷ এরপর থেকেই কখনও একক এবং বেশিরভাগ সময় যুগ্ম সংখ্যা হিসাবে ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’ বেরিয়েছে৷ এরপর ১৯৯৩ সালে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায় এবং পুনরায় ১৯৯৪ থেকে নতুন ফরম্যাটে পত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে৷ তা দ্বিমাসিক থেকে ত্রৈমাসিকে পরিণত হয়৷ ত্রৈমাসিক ও যুগ্ম সংখ্যা হয়ে বেরিয়েছে ডিসেম্বর ১৯৯৭ পর্যন্ত৷ তারপর পত্রিকাটি বছরে একটি সংখ্যা হয়ে বেরিয়েছে ২০২২ সাল পর্যন্ত কিন্ত্ত তারপরে আর কোনও সংখ্যা বেরোয়নি৷ বিষয়বস্ত্ততে দেশ দুনিয়ার খবর থাকলেও তা প্রকৃত অর্থে স্থানীয়দের যা কাজে লাগে সেই উদ্দেশ্য নিয়েই বের করতেন৷ সুন্দরবনে রাসায়নিক সার কারখানা গড়ে ওঠার বিরুদ্ধে বা পরমাণু বিদু্যৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধেই হোক রবীনদা পত্রিকাতে বিষয়বস্ত্ত হিসাবে জনমত যেমন গড়ে তুলেছেন, নিজেও গণবিজ্ঞান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে থেকেছেন৷ এমনও দেখা গিয়েছে পোখরান বিস্ফোরণের (১৯৯৮) পর ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’ পত্রিকায় রবীনদা ৪১টি নিবন্ধ ও রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন৷ আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১৯৯৮ এর ৬ আগস্ট হিরোশিমা দিবসে কলকাতায় গণবিজ্ঞান আন্দোলনের তরফে শিয়ালদহ থেকে বিড়লা

প্ল্যানেটোরিয়াম পর্যন্ত যে বিশাল মিছিল সংগঠিত হয়েছিল রবীনদা তাতেও সামিল হয়েছিলেন৷ সাধারণ মানুষের স্বার্থে ভোপাল মিক (মিথাইল আইসোসায়ানাইড) গ্যাস দুর্ঘটনা সহ বহু গণবিজ্ঞানের আন্দোলনে ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’কে যেমন সামিল করিয়েছেন, নিজেও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন৷
‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’ হোমিওপ্যাথি এবং আকুপাংচার চিকিৎসার পদ্ধতি হিসাবে কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখে সেই বিষয়ে মূল্যায়ন করেছে৷ একইসঙ্গে প্রথম বিশ্বের দেশ ড্রাগ ট্রায়ালে তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের যেভাবে গিনিপিগ করে তারও সমালোচনা করেছে৷ এই দেশেও যাঁরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত তাদের অভাব অভিযোগ পত্রিকার পাতায় তুলে ধরেছেন রবীনদা৷ পশ্চিমবাংলায় বিজ্ঞানের পাঠ্যসূচি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অবৈজ্ঞানিক বিষয়বস্ত্ত পাঠ্য পুস্তকগুলিতে যেভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছিল ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’ সেগুলিও মূল্যায়ন করেছে৷ একইসঙ্গে অচিরাচরিত বিজ্ঞান শিক্ষা, বিশেষ করে পরীক্ষামূলক যাকে বলা হয় হাতেকলমে বিজ্ঞান শিক্ষা— মধ্যপ্রদেশের বিজ্ঞান সংগঠন ‘একলব্য’ যা করে থাকে, রবীনদাও তাঁর পত্রিকার মধ্য দিয়ে এ রাজ্যে করার চেষ্টা করেছেন৷ ‘একলব্য’-এর মতো অন্যান্য জনআন্দোলন যেমন ছত্তিশগড়ের শহিদ হাসপাতাল কিংবা লাতিন আমেরিকার জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের মতো আন্দোলনগুলিতে ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’ যুক্ত থেকেছে৷ এসবের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবাংলায় গণবিজ্ঞান আন্দোলনের ধারাকে পোক্ত ও পুষ্ট করার কাজ করেছেন রবীনদা৷

বর্ধমান জেলার মেমারি অঞ্চলের এক গ্রামে ১৯৪৬ সালের ২৪ নভেম্বর রবীনদার জন্ম৷ নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে রসায়ন শাস্ত্রে সাম্মানিক স্নাতকে ভর্তি হন এবং প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন৷ এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বি.টেক ও এম.টেক ডিগ্রিলাভ এবং উভয় ক্ষেত্রেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে৷ একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে পিএইচডি এবং ১৯৭৪ সালে কেমিক্যাল টেকনোলজি বিভাগে শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ ইংলন্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৪-৮৫ সালে পোস্ট ডক্টোরাল ফেলোশিপে যোগ দেন৷ ফিরে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন একই বিভাগে এবং ১৯৯৩-৯৫ পর্যন্ত কেমিক্যাল টেকনোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন৷ তাঁর পড়াশোনা ক্লাসরুমের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ যেমন ছিল না, গবেষণাও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে নিবদ্ধ ছিল না৷

‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’ এবং রবীনদাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না— যেতও না৷ ওইরকম একজন কৃতী মানুষকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি একজন অসাধারণ মানুষ৷ যেকোনও বিজ্ঞান আন্দোলনে কিংবা গণআন্দোলনের কর্মসূচিতে দেখা হলে সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন এবং পত্রিকা যাঁরা পাননি তাঁদের দিতেন ঝুলি থেকে বের করে৷ শেষের দিকে পত্রিকা প্রকাশ যখন বন্ধ করে দিয়েছেন দেখা হলে বিনা পয়সাতেই শেষ সংখ্যাটি বিতরণ করতেন৷ ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’র বহু সংখ্যার বিষয়বস্ত্ত ছোট পুস্তিকাকারেও বের করে বিলি করেছেন৷ সেরকমই একটি পুস্তিকা ছিল ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ‘বিজ্ঞান শিক্ষা ও প্রাথমিক হালচাল’, ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘বিজ্ঞান শিক্ষা ও মাধ্যমিক হালচাল’৷ পরিবেশ দূষণের উপর ১৯৯৮ সালে বই লিখেছিলেন ‘পরিবেশ দূষণ পরিচিতি ও পরিমাপ’৷ মণিদার (মণীন্দ্র মজুমদার) সঙ্গে পরিবেশের উপর পরিবেশবিদ্যা সংক্রান্ত বই ‘পরিবেশবিদ্যা পরিচয়’ লিখেছেন ২০০২ সালে৷ এই বই পশ্চিমবাংলার স্নাতক স্তরে পরিবেশবিদ্যা হিসাবে অবশ্য-পাঠ্য ছিল৷ অন্যান্য পুস্তিকাগুলির মধ্যে ‘বিজ্ঞান আন্দোলনের সন্ধানে’ (১৯৭৯) এবং ২০১৬ সালে লেখা ‘ভারতের আমআদমির জনবিজ্ঞান ও প্র.যুক্তি’ এবং ‘বিজ্ঞান আন্দোলন অথবা কূপমণ্ডুকতার চর্চা’ উল্লেখযোগ্য৷ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অবদান ও স্বপ্ন নিয়ে একটি দৈনিকে বেশ কয়েকটি উত্তর সম্পাদকীয় লিখেছিলেন৷ আচার্য যেমন বিজ্ঞান, সমাজ ও মানব এই ত্রিফলার উপর জোর দিতেন তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে রবীনদা ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’তে ‘বিজ্ঞান সমাজ ও মানুষ’ শিরোনামে ২০০৬ সালে বেশ কিছু লেখা ছেপেছিলেন৷

রবীনদার মৃতু্যর পর খুব বেশি চর্চা হয়নি৷ ‘ফ্রন্টিয়ার’ (সমর সেন প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত ইংরেজি সাপ্তাহিক, বর্তমানে তিমির বসু সম্পাদক) পত্রিকায় সব্যসাচী চ্যাটার্জি একটি প্রতিবেদন লিখেছেন৷ মানুষের জন্য যাঁরা নীরবে নিঃশব্দে কাজ করে যান তাঁদের কথা কেই-বা ভাবে? শুধু ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী’ পরিবারেই নয়, রবীনদার স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে থাকবে জনবিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মীসমর্থকদের মধ্যেও৷