যে রবির অস্ত নেই৷

Written by SNS February 20, 2024 4:20 pm

সঞ্জীব দত্ত
ও দাদা, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদারের বাড়িটা চেনেন?
— কার বাড়ি? না না ও নামে এ পাড়ায় কেউ থাকে না৷
আমি দোনোমোনো করছি দেখে একজন জানতে চাইলেন, তা ওনার কি করা হয়?
আমি উত্তরে বললাম, যতদূর জানি হাস্যকৌতুক অভিনেতা৷
ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ও ভাঁড় খুজছেন, তা এ দেশে তো সকলেই কম বেশি তাই…. কিন্ত্ত তারপর যতবার ওনার সঙ্গে দেখা করেছি, ওঁকে পেয়েছি অন্য এক মাত্রায়৷
আপনারা কি চিনতে পারলেন ওনাকে? আশুতোষ কলেজের ছাদে বন্ধুদের সঙ্গে নাটকের মহড়ায় ব্যস্ত ছোটখাটো ছেলেটাকে? চিনলেন না তো?
দেখতে ছোটখাটো হলেও শারীরিক গড়ন ছিল বেশ পেশীবহুল, তাই ভেবেছিলেন ‘বডিবিল্ডার’ হবেন, ভাগ্যে হননি, না হলে বাংলা হারাতো অনন্য এক অভিনেতাকে৷ এবার কি আপনারা তবে… চিনতে পারলেন?
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন উনি আমাদের সবার প্রিয়, ‘বাঘা দা’, মানে আমাদের রবি ঘোষ৷
নাটকের ঘরানা থেকে উৎপল দত্তের হাত ধরে যাঁর উঠে আসা, তাঁকে কি শুধু ‘হাস্যকৌতুক’ এর মধ্যে বেঁধে রাখা যায়৷ যায় না, এর অন্যতম উদাহরণ ‘সত্যজিৎ রায়’ এর পরিচালনায় একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যতিক্রমী চরিত্রে তাঁকে নির্বাচন এবং সেখানে তাঁর অনবদ্য অভিনয়৷
প্রথম আসি, ‘মহাপুরুষ’ সিনেমার সেই অনবদ্য গুরুদেবের চেলার ভূমিকায় অভিনয়ে… সেই নির্বাক ঢুলু-ঢুলু চাউনি, কখনো এক চোখ বন্ধ করে মেয়েদের দিকে তাকানো আবার ধরা পড়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাধনের ভান করা, অথবা নকল হাত লাগিয়ে নটরাজ সাজার চেষ্টা করা৷ সবেতেই সাবলীল৷ চোখ-মুখের ভাবভঙ্গিতে অসাধু সত্তার প্রকাশ স্বতঃস্ফূর্ত৷ এ কোন অভিনয়! এ কি শুধু ভাঁড়দের দিয়ে সম্ভব?
আবার আসি, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সিনেমায়, সেখানে শেখরকে নিশ্চয় সবার মনে আছে৷ অন্যদের থেকে বহরে ছোট হয়েও কেমন চুটিয়ে অভিনয় করে গেলেন৷ হরির সঙ্গে সখ্যতা, ছদ্ম ঝগড়া, গান গাইতে গাইতে কুয়োর ধারে স্নান, ডোরাকাটা জামা ও হাফ প্যান্ট পরে জঙ্গল ঘোরা সবকিছুই কত সহজে করা, অমন প্রাণ চঞ্চল ‘শেখর’ই তো হাসতে হাসতে সভ্যতার সঙ্গে সব সম্পর্ক অবলীলায় ছেদ করতে পারে৷ তাই না…. তাঁর এই অভিনয় দক্ষতা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে এবং যে কোনো ফ্রেমেই তাঁর থেকে চোখ সরানো যায়নি৷ এখানেই সত্যজিৎ রায় প্রথম দেখালেন ‘ডার্ক কমেডি’কে রবি ঘোষ এর মাধ্যমে৷ উত্তরণ ঘটলো রবির… কি সত্যি তো?
এর পর আসি, আগন্ত্তকের সেই জামাইবাবু ‘রঞ্জন’ এর ভূমিকায় তাঁর অভিনয়ে, যেখানে সত্য গোপন করার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে খুব ছোট ছোট ক্লোজ শটে, যা খুবই শক্ত৷ হাসতে হাসতে এমন অভিনয়, সত্যিই অসাধারণ..
এবার বলি সেই ছবি, যা তাকে বিখ্যাত করছে, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’৷ যেখানে তার অভিনয় মন কেড়েছে আবাল বৃদ্ধ বনিতার, কি সাবলীল সেই অভিনয়৷ ঠিক যেমন সত্যজিৎ চেয়েছিলেন… You just behave don’t act.
আর তা সততই করেছিলেন বলেই তাঁর অভিনয় দাগ কেটে গেছে সবার মনে৷ এ ছাড়া ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’, ‘হীরক রাজার দেশে’তেও  তিনি সমান উজ্জ্বল৷
আপনাদের মনে আছে, ‘অভিযান’ সিনেমায় সৌমিত্রের পাশাপাশি দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন, আমাদের প্রিয় হাস্য কৌতুক শিল্পী, যেখানে কোথাও তার অভিনয় এতটুকু বেমানান হয়নি৷ অথচ সত্যজিৎ রায় স্বয়ং তার নানান সময়ে improvising shot-এর তারিফ করেছেন৷
এবার বলি সত্যজিৎ ছাড়া অন্যদের পরিচালনায় যে সকল সিনেমাতে আমরা অন্য রবি ঘোষকে পেয়েছি সেগুলি হলো… তপন সিনহার ‘গল্প হলেও সত্যি’৷ এই বইতে সমস্ত শরীর দিয়ে, অভিব্যক্তি দিয়ে, যেভাবে তিনি হাস্যরসের জন্ম দিয়েছেন তা এক কথায় অনন্য সাধারণ৷ হাস্যকর উপস্থাপনাতেও যে কতটা ব্যথা লুকিয়ে রাখা যায়, তা তাঁর অভিনয় দক্ষতা দিয়ে দেখিয়েছেন, যা কখনো ভোলা যাবে না৷
‘তিন ভুবনের পারে’ সিনেমায় অমন নাচ কেউ ভুলে গেছে বলে মনে হয় না৷ আবার ‘মর্জিনা আবদুল্লা’ ছবিতে অন্য নাচের মুদ্রা, অভিনয় শৈলী, সবার মন কেড়েছে নিশ্চয়ই?
আমরা কি ভুলে গেছি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র মুসলিম চাচা আমিন উদ্দিনের অভিনয়? জেলেদের জীবন যাত্রা, তাদের দোলাচল কি শান্ত ব্যথাতুর অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে তিঁনি দেখিয়েছেন তা ক’জন পারে? অন্যদিকে তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছেন সমান তালে দীর্ঘ সময় ধরে৷ এটা সম্ভব হয়েছে ঐকান্তিক নিষ্ঠা, নিজের প্রতি বিশ্বাস, কাজের প্রতি অসম্ভব দায়বদ্ধতা থাকার কারণে৷ তাই তাকে শুধু কৌতুক শিল্পীই হয়ে থাকতে হয়নি৷ পেয়েছেন অকৃপণ ভালোবাসা সাথে পুরস্কারও৷ তাই তিনি এমন এক অভিনেতা, যে কাজের মাধ্যমে পেয়েছেন অমরত্বের স্বাদ৷
বিনোদন জগতে সব মাধ্যমে তিনি রেখে গেছেন তাঁর প্রতিভার ছাপ৷ নাট্য মঞ্চে, টিভির পর্দায় (টেনিদা) এবং সেলুলয়েডের দুনিয়ায় তিঁনি ছিলেন, আছেন ও  থাকবেন আমাদের সবার মনের মণিকোঠায়৷ কি, ঠিক বললাম তো…?